ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খেলার মাঠে ঘটনাবহুল বছর

খেলার মাঠে ঘটনাবহুল বছর

পুরোনোকে বিদায় করে দেয়াল থেকে নেমে গেল আরও একটি ক্যালেন্ডার, বিদায় নিয়েছে পুরোনো বছর। আজ ড্রইং রুমে জায়গা করে নিয়েছে ২০২৩ সালের ঝকঝকে ক্যালেন্ডার। নতুন ক্যালেন্ডারটা ঝোলানোর আগে চাইলে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন ২০২২ সালে। কারণ, ফুটবলের লম্বা মাঠে, ক্রিকেটের বাইশ গজের উইকেট, টেনিসের হার্ড, ক্লে কিংবা ঘাসের কোর্টে- এত ঘটনাবহুল ৩৬৫ দিন আগে এসেছে কি না, সেটা হতে পারে আপনার ক্রীড়াপ্রেমী মনের চিন্তার খোড়াক।

এই বছর দিয়ে গেছে খেলার মাঠের অনন্য সব স্মৃতি। ক্রীড়াঙ্গনে এত ঘটনাবহুল বছর আগে এসেছে কি না, তা নিয়ে জরিপও করে ফেলা যায় চাইলেই। ফুটবল বিশ্বকাপ, ক্রিকেটের এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, টেনিসের গ্র্যান্ডস্ল্যাম- বছরজুড়ে ব্যস্ত ছিল খেলার মাঠ। দারুণ সব স্মৃতির সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদায়ের সুর। পথচলায় হারিয়েছি চিরপরিচিত মুখ। অবাক করেছে মাঠ ও মাঠের বাইরের কিছু ঘটনা, দেখার পর অস্ফুটস্বরে হয়তো বলে উঠেছেন ‘এমনও হয় নাকি!’ কোনো ঘটনা দেখে হয়তো হেসেছেনও বেশ, কিংবা অবিশ্বাসে মুখও চেপেছেন হয়তো!

বছরের শেষ প্রান্তে এসে খেলার মাঠের সব অর্জন, অঘটন, চমক কিংবা বিদায়ের সুরটা আবারও মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়াস প্যাভিলিয়নের।

মেসির বছরের বিদায়টা বেদনার

এমনিতে বছরের শেষ দিকে বিদায়ের করুণ সুর বাজে। সেই সুর আরও বিষাদময় করে দিয়েছে পেলের বিদায়। ফুটবলের আরেক কিংবদন্তি ডিয়াগো ম্যারাডোনার বিদায়ের ১৩ মাস পর (৩০ ডিসেম্বর) ফুটবলবিশ্বকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন রেকর্ড তিনটি বিশ্বকাপজয়ী পেলে। বিশ্বকাপ দিয়ে তার বৈশ্বিক মঞ্চে উত্থান, বিশ্বকাপের কারণেই অনন্য, বিশ্বকাপ এলে তার মতো খুশি মনে হয় না পৃথিবীতে আর কেউ হতেন। সেজন্যই কি পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার জন্যও বিশ্বকাপের সময়টাকে এড়িয়ে গেলেন এই কিংবদন্তি। বিশ্বকাপ শেষ হলো, কিছু দিন পরই ৮২ বছর বয়সে আজ চলে গেলেন পেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো। তার অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকেও জানানো হয় এ খবর। অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরে, বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা ছিল, কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছিল কোলন ক্যান্সার। মরণব্যাধির সঙ্গে লড়ে কেউ কেউ জিতে যান। পেলেও লড়েছেন কয়েক বছর। কিন্তু বয়সটা যে তার পক্ষে ছিল না। তবে বছরটা ছিল নিঃসন্দেহে লিওনেল মেসির। বিশ্বকাপটা এমন এক ট্রফি, যার জন্য মেসিকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর। শুনতে হয়েছে সমালোচনার পর সমালোচনা। আরাধ্য শিরোপা এ বছর শেষ দিকে জিতে মেসি কি শুধু নিজের অপূর্ণতাই ঘুচিয়েছেন? না, সম্ভবত সর্বকালের সেরার বিতর্কেরও অবসান ঘটিয়েছেন। এ বছর তাই শুধু মেসিরই। বলতে পারেন, মেসির সব পাওয়ার বছর।

সব পাওয়াটা রূপক অর্থে বলা। আসলে বিশ্বকাপ জিতে মেসি ফুটবল বিশ্বেরই অপেক্ষা ঘুচিয়েছেন। যদিও এ বছরের শুরুতে তেমন আভাস মেলেনি। ২০২১-২২ মৌসুমটা মেসির ভালো কাটেনি, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৪ ম্যাচে ১১ গোল। অন্তত ৩০ ম্যাচ খেলেছেন, হিসাব করলে ২০০৬-০৭ মৌসুম থেকে গত মৌসুমটাই মেসির সবচেয়ে বাজে কেটেছে। কিন্তু আগস্টে নতুন মৌসুম শুরুর পর থেকে পুরোনো মেসি!

বছরের শেষ দিকে বিশ্বকাপে মেসিকে নিয়ে পৃথিবীর সেই অপেক্ষার অবসান যে হতে যাচ্ছে, সেই ইঙ্গিত মিলেছে তার পারফরম্যান্সেই। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৯ ম্যাচে ১২ গোল করে প্রস্তুতিটা নিয়েই রেখেছিলেন। তারপর? ক্লাব ফুটবলে কোনো কিছু জিততে বাকি না রাখা খেলোয়াড়টির মনের শোকেসে কেন্দ্রবিন্দুটাই শুধু ফাঁকা পড়ে ছিল। বিশ্বকাপে সেই শূন্যস্থান পূরণের পর কে বলবে বছরটা মেসির নয়!

বিশ্বকাপে মেসি কী করেছেন, তা কারও অজানা নয়। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছেন দুটি ‘গোল্ডেন বল’- ২০১৪ বিশ্বকাপের পর এবার। নিজে করেছেন ৭ গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ৩ গোল। ১৯৮৬ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর এই ৩৬ বছরে বিশ্বকাপে মেসির আগে আর কোনো খেলোয়াড়ই গোল করা ও করানো মিলিয়ে অন্তত ১০ গোলে প্রত্যক্ষ অবদান রাখতে পারেননি। কাতার বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সেই স্মৃতিই ফিরিয়েছেন মেসি। তার চেয়েও বড় কথা, ম্যারাডোনার মতোই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। এরপর আর কী লাগে!

কোপা আমেরিকার গত আসরের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও গত ইউরো জিতেছে ইতালি। দুই মহাদেশের দুই চ্যাম্পিয়নকে নিয়ে মাঠে গড়িয়েছিল ফাইনালিসিমা, যার অন্য নাম ‘আর্তেমিও ফ্রাঞ্চি’ কাপও। আন্তঃমহাদেশীয় এই লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।

দীর্ঘদিন চাতক পাখির মতো আফকন শিরোপার অপেক্ষায় ছিল সেনেগাল। কাছে গিয়েও ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। তবে ২০২২ সালে সে অপূর্ণতা ঘুচেছে সাদিও মানেদের। মিশরকে হারিয়ে প্রথমবার আফকনের ট্রফিটা ঘরে নিয়ে ফিরেছেন আলিও সিসের শিষ্যরা।

ইউরোপ সেরা ক্লাব টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়াল মাদ্রিদের দাপট ছিল এই বছরও। লিভারপুলকে ১-০ গোলে হারিয়ে ১৪তম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতে ধরাছোঁয়ার আরও বাইরে চলে গেছেন করিম বেনজেমারা। সেই মৌসুমে কেবল চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই ১৫ গোল করেছিলেন বেনজেমা। রিয়াল মাদ্রিদের এই ফরাসি স্ট্রাইকারের হাতে উঠেছে প্রথম ব্যালন ডি’অর।

ইংল্যান্ডের মেয়েরা জিতেছে তাদের প্রথম ইউরো। এক পয়েন্টের ব্যবধানে লিভারপুলকে হারিয়ে নাটকীয়ভাবে প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে ম্যানচেস্টার সিটি।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলের জন্য অনন্য এক মাইলফলক ২০২২ সাল। হিমালয়ের কোলে, নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে নেপালকেই হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে বাংলাদেশ। দেশের নারী ফুটবলের প্রথম বড় কোনো শিরোপা জয়ের সাক্ষী হয়ে রইল ২০২২। দেশে ফেরার পর সাবিনা-শামসুন্নাহার-কৃষ্ণাদের ছাদখোলা বাসে বরণ করে নিয়েছিল রাজধানীবাসী।

ক্রিকেটে আনন্দ-বেদনার গল্প

বছরের শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশের মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট জয় দিয়ে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ জিতেছিল প্রথম টেস্ট। অচেনা কন্ডিশনে দারুণ ব্যাটসম্যানশিপের পরিচয় দিয়েছিলেন মাহমুদুল হাসান জয়, লিটন দাস, মুমিনুল হকরা। সেই টেস্ট পুনর্জীবন দিয়েছে এবাদত হোসেনের ক্যারিয়ারকে। দারুণ সেই টেস্ট জয়ে বল হাতে দারুণ পারফর্ম করেছিলেন ডানহাতি এই পেসার। একাই নিয়েছিলেন ৬ উইকেট।

বছরের শুরুতে মাঠে গড়িয়েছিল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের অষ্টম আসর। টুর্নামেন্টজুড়ে উড়তে থাকা ফরচুন বরিশালকে হারিয়ে তৃতীয় বিপিএল শিরোপা ঘরে তুলেছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।

বিপিএল শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। রীতিমতো অসাধ্য সাধন করেছিলেন তামিম ইকবাল-সাকিব আল হাসানরা। প্রোটিয়াদের মাটিতে তাদেরই ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। বল হাতে দারুণ ছন্দে ছিলেন তাসকিন আহমেদ। আগুনে বোলিংয়ে ৩ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ডানহাতি এই পেসার।

আইপিএলের ১৫তম আসরেরও পর্দা উঠেছিল এই বছরে। নতুন দুই ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে শুরু হয়েছিল জনপ্রিয় এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের গত আসরের। নবাগত দল গুজরাট টাইটান্স দেখিয়েছে নিজেদের প্রথম আসরেই। হার্দিক পান্ডিয়ার নেতৃত্বে রাজস্থান রয়্যালসকে হারিয়ে আইপিএলের শিরোপা জিতেছে দলটি।

এপ্রিলে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সপ্তমবারের মতো মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে ১৭০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেছিলেন অ্যালিসা হিলি।

রীতিমতো গৃহযুদ্ধ চলছিল শ্রীলঙ্কায়। জনগণ কর্তৃক লঙ্কান সরকারের পতনের ডামাডোলে এশিয়া কাপ খেলতে আরব আমিরাতে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। এবং সেখানে লঙ্কানদের বাজিমাত। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে শোচনীয় পরাজয়ের পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় দাসুন শানাকার দল। ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে ষষ্ঠবার তুলে ধরেছিল এশিয়া কাপের শিরোপা।

এশিয়া কাপে ঘুচেছে বিরাট কোহলির সেঞ্চুরিখরা, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০২০ দিনের অপেক্ষা ফুরিয়েছে তার দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে।

বছরের শেষ ক্রিকেটীয় ধামাকা ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়ায় সেই পাকিস্তানকে হারিয়েই ক্রিকেটের ক্ষুদ্র এই ফরম্যাটের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ট্রফিটা ঘরে তুলেছে ইংল্যান্ড।

এর মধ্যে ডিসেম্বরে এক অঘটন ঘটিয়ে বসেছে সিডনি থান্ডার্স। বিগ ব্যাশে মাত্র ১৫ রানে গুটিয়ে গেছে দলটি। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহের রেকর্ডও এটি। মার্চ মাসে ক্রিকেট হারিয়েছে কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নকে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তারই দীর্ঘদিনের সতীর্থ অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। মারা গেছেন সাবেক অজি ক্রিকেটার রডনি মার্শও। অবসর নিয়েছেন ইওন মরগান, কাইরন পোলার্ড, রস টেলর।

টেনিস কোর্ট ভেসেছে চোখের জলে

অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে দানিল মেদভেদেভকে হারিয়ে ২১তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতে বাকিদের ছাপিয়ে গেছেন রাফায়েল নাদাল। ২২তম গ্র্যান্ডস্ল্যামটি হাতে তুলেছেন ফ্রেঞ্চ ওপেনে ক্যাসপার রুডকে হারিয়ে। উইম্বলডন জিতেছেন নোভাক জোকোভিচ। ইউএস ওপেনের মুকুট উঠেছে ১৯ বছর বয়সি কার্লোস আলকারাজের মাথায়।

এই বছরই টেনিস র‍্যাকেট তুলে রেখেছেন কিংবদন্তি রজার ফেদেরার। লেভার কাপে শেষবারের মতো টেনিস কোর্টে নেমেছিলেন এই সুইস তারকা। সঙ্গী ছিলেন তারই বন্ধু, চির প্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদাল। ম্যাচের আগে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল কোর্টের চারপাশে। চোখের জলে দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারকে বিদায় বলেছেন ফেদেরার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত