প্রতিপক্ষ দলের ডিফেন্ডারদের অসংখ্য চোট-আঘাত যাঁকে দমাতে পারেনি, তিনিই হেরে গেলেন ক্যান্সারের কাছে। মরণব্যাধি নিয়ে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল পেলেকে, যখন দুশ্চিন্তায় রাত কেটেছিল বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের। পেলেও বারবার রোগভোগকে ড্রিবল করে ফিরে আসেন। এবার পারলেন না জীবনের ডি-বক্সে ফাইনাল ট্যাকলটা সামলাতে। যে ট্যাকল ফেলে দিয়েছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। সেই ট্যাকলে এবার পেলে! ফুটবল, জোগো বনিতো- সবকিছুই পড়ে রইল; শুধু নেই রাজা। পার্থিব সব বন্ধন কাটিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ফুটবলের এই কিংবদন্তি। শুক্রবার রাত ১টায় সাও পাওলোর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জীবনাবসান হয় ৮২ বছর বয়সী পেলের।
ফুটবলের জন্য পেলে যা করেছেন তা সব সময়ই টিকে থাকবে, বলেছেন ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। আর পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ হয়েও সাধারণ থাকতে হয় কীভাবে, পেলে থেকে এই শিক্ষা নিয়েছেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। ইংলিশ গ্রেট গ্যারি লিনেকার ছোট্ট ভিডিও তার টুইটার অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেছেন। যেখানে সব সময়ের সেরার তালিকায় থাকতে পারেন, এমন সব জাদুকরী ফুটবলারের কিছু ক্লিপ দেখানো হয়েছে। সেগুলো মৌলিক কিছু নয়, বরং পেলের দুর্দান্ত সব নৈপুণ্যের পুনরাবৃত্তি মাত্র! ফুটবল জাদুকরের এই সামর্থ্যের জন্যই হয়তো পেপ গার্দিওলা মনে করেন, যে কোনো যুগে সফল হতে পারতেন পেলে। কে নেই সেই ভিডিও ক্লিপে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ইয়োহান ক্রুইফ, জিনেদিন জিদান থেকে শুরু করে লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমার থেকে হালের কিলিয়ান এমবাপে! তাদের যে কারিকুরিতে মন্ত্রমুগ্ধ ফুটবল বিশ্ব সেগুলো কত অনায়াসে দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচে দেখিয়ে গেছেন পেলে।
পেলের খেলা সরাসরি কিংবা টিভিতে যারা দেখেছেন তারা সব সময়ই তাকে সেরা মানেন। তাদের কাছে পেলেই ফুটবলের শেষ কথা। অন্যদের লড়াই তার কাছে যাওয়ার। ফুটবল জাদুকরের খেলা দেখা হয়নি গার্দিওলারও। তবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখেছিলেন, সেগুলো থেকেই বুঝে গেছেন কোন উচ্চতার খেলোয়াড় ছিলেন ব্রাজিলিয়ান মহানায়ক। এভারটনের বিপক্ষে গেল রাতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে খেলেছে ম্যানচেস্টার সিটি। মাঠে নামার আগে সংবাদ সম্মলেনে পেলের মৃত্যুতে গভীর শোক জানান কোচ গার্দিওলা, ‘ম্যানচেস্টার সিটির পক্ষ থেকে তার পরিবারের প্রতি গভীর শোক। ফুটবল আজকের ফুটবল হয়ে উঠেছে এই ধরনের ব্যক্তি, খেলোয়াড় ও মানুষের জন্য। আমার মনে হয়, নেইমার কথাটা বলেছে, এর আগে ১০ কেবলই একটি সংখ্যা ছিল, (পেলে ১০ নম্বর জার্সি পরার) পরে এটা হয়ে গেছে বিশেষ। সব সেরা খেলোয়াড় তাদের দলের হয়ে এটা পরতে চায়। তিনি ফুটবলের জন্য যা করেছেন, তা সব সময়ই টিকে থাকবে।’
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে অনেক দিন ধরে কোচ হিসেবে কাজ করছেন গার্দিওলা। লম্বা সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নিশ্চিত, যেকোনো যুগে পাঠানো হলেও সাফল্য পেতেন পেলে, ‘তিনি শুধু তিনটি বিশ্বকাপ জেতেননি- তিনি যখন এলেন সেটা ছিল ফুটবলে নতুন কিছু। তিনি যখন খেলতেন, তখন আমার জন্মই হয়নি। তবে এটা খুব ভালো সিনেমার মতো, তাই না? তার লেগাসি এত বছর পরেও অক্ষয়। আমার বয়স যখন নয় কিংবা দশ, তখন আমি তার কিছু ক্লিপ দেখতে শুরু করি। এখন বুঝতে পারি তিনি এত শক্তিশালী ছিলেন যে, সব কিছু করতে পারতেন। অনেকে বলে ছন্দ সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এই ধরনের খেলোয়াড়, তিনি যদি এখন খেলতেন তাহলে এই ছন্দ ও গতির সঙ্গে ঠিকই মানিয়ে নিতে পারতেন। তার যে দক্ষতা ও মানসিকতা ছিল তাতে তিনি প্রতিটি প্রজন্মেই খেলতে পারতেন।’
ফুটবলের দুনিয়ায় পেলে কতখানি, তা নতুন করে হয়তো বলার কিছু নেই। অনেক আগেই সিংহাসনে বসেছেন তিনি। লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ সেই চেষ্টাও করলেন না। ফুটবলের রাজার যে দিকটি তার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন হয়ে নিজেকে কী সাধারণভাবেই না তুলে ধরতেন তিনি! ক্লপের ভাষায়, খ্যাতি থাকার পরও সবার সঙ্গে খুব সাধারণভাবে মিশতে পারতেন তিনি, তার ছিল না কোনো অহংবোধ। ওপারে পাড়ি দেয়া কিংবদন্তির এই দিকটিই বেশি ভালো লাগত ক্লপের।
বল পায়ে পেলে কতটা নিখুঁত, কার্যকর আর ভয়ঙ্কর ছিলেন, বোঝাতেই হয়তো ক্লপ বলেন, পেলের সামর্থ্যের ০.০১ শতাংশও তার নেই। ফুটবলের জাদুকর পেলের পায়ের কারিকুরিতে মুগ্ধ ছিল সবাই। এই খেলায় তার স্কিল ছিল অবিশ্বাস্য। ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সিটি তার ছোঁয়া পেয়েই হয়ে ওঠে বিশেষ।
ক্লপ বেশ গর্বের সঙ্গে বলেন, পেলের স্বাক্ষর করা একটি জার্সি আছে তার কাছে। জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলেন। ২০০৬ বিশ্বকাপের সময় জার্মান গ্রেট ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার সেটা দিয়েছিলেন। লিভারপুল কোচের কাছে, পেলে সব সময়ের সেরা, এটা কখনও ভুলবেন না, ‘পেলে ও বেকেনবাওয়ার দেখিয়েছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হলেও পুরোপুরি সাধারণ একজন হিসেবে থাকা যায়। এটা বেশি ভালোবাসি, তাদের থেকে এটা শিক্ষা হিসেবে নিয়েছি, যা আমি কখনও ভুলব না।’
টটেনহ্যাম হটস্পার কোচ আন্তোনিও কন্তের কাছে পেলের জীবন মানে ফুটবলেরই গল্প, ‘আমরা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের একজনকে নিয়ে কথা বলছি। আমরা ফুটবলের গল্প নিয়ে কথা বলছি। তার ব্যবহার ছিল চমৎকার। ম্যারাডোনার সঙ্গে তিনি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পরও তিনি ছিলেন নিরহংকার এবং বিনয়ী।’