এনএসসির উদাসীনতায় বেশিরভাগ ফেডারেশনে এডহক কমিটি

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  স্পোর্টস রিপোর্টার

বাংলাদেশের ফেডারেশন/ অ্যাসোসিয়েশনগুলোর অভিভাবক হচ্ছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। এনএসসি’র কাজই হচ্ছে ফেডারেশনগুলোর কাজ তদারকি করা। তারা কিভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তার রিপোর্ট এনএসসির সংগ্রহ করার কথা। সেভাবেই চলবে ফেডারেশনগুলো। এর জন্য এনএসসি নির্বাচনের মাধ্যমে ফেডারেশনের কর্মকর্তা নির্বাচনের পথ তৈরি করে দেন। ফেডারেশনের অনুমোদন বা জন্ম দিয়ে থাকে এনএসসি। এনএসসি এম ফেডারেশন বা অ্যাসোসিয়েশনকে অনুমোদন দিয়েছে যার নাম শুনলে অবাক হতে হয়। বা যাদের খেলা সম্পর্কে কারো কোনো ধারণাই নেই। এর একটি হলো ‘জুজুৎসু’। এই খেলার নাম শুনলেই অবাক হতে হবেই। এটা মূলত একটি খেলা। দেশের ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ‘বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশন’।

২০১৮ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এই অ্যাসোসিয়েশনকে অনুমোদন দিয়েছে। ‘জুজুৎসু’ নিয়ে দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ৫৩টি। কিন্তু এনএসসির’র কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে হতাশা। কারণ তারা কোনো তদারিকই করতে পারে না বা সময় নেই। পারবেই বা কিভাবে ? এনএসসির কর্তা ব্যক্তিরা ব্যস্ত অন্য বিষয় নিয়ে। দেশের বহু ফেডারেশন চলছে অনির্বাচিত বা এডহক কমিটি দিয়ে। ৫ বছর আগে ‘জুজুৎসু’ অ্যাসোসিয়েশনটি অনুমোদন পেলেও এখনো এনএসসিকে তারা কমিটি গঠন করে দিতে কোনো প্রস্তাব দেয়নি। জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘জুজুৎসু’ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা নিজেদের মতো করে ২৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। দেশের ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো কিভাবে চলছে, তার একটা উদাহরণ এটি। দেশ পরিচালনা করছে গণতান্ত্রিক সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জোর দিয়েছেন; কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে তার প্রতিফলন সেভাবে ঘটছে না।

৫৩টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ২৮টিই চলছে অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে। যে ২৫টি চলছে নির্বাচিত কমিটি দিয়ে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির মেয়াদ শেষ হয়েছে আগেই। ৫৩ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে সিংহভাগই অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে চলছে। অথচ ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল দায়িত্ব নিয়ে প্রথম যেদিন এনএসসিতে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘এত অ্যাডহক কমিটি দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলছে, যা দেখে আমার খারাপ লেগেছে। অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে ভালো ফলাফল করা দুরূহ কাজ। যে সব ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি আছে সেগুলোকে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হবে।’ ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। ফুটবল, ক্রিকেট ও হকিসহ কয়েকটি ফেডারেশনের নির্বাচন সম্পন্নও করেছিলেন তিনি; কিন্তু করোনার কারণে সেই উদ্যোগকে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পক্ষে।

বর্তমানে নির্বাচিত কমিটি দিয়ে চলছে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, সুইমিং, অ্যাথলেটিকস, জিমন্যাস্টিকস (মেয়াদোত্তীর্ণ), শ্যুটিং, ভলিবল, টেবিল টেনিস, শরীরগঠন, বক্সিং, সাইক্লিং, জুডো, টেনিস, রোইং, কুস্তি, কাবাডি, কারাতে, হ্যান্ডবল, রোলার স্কেটিং, খো খো, আরচারি, বাশাআপ, ফেন্সিং ও ন্যাশনাল প্যারালম্পিক। অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে- ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, দাবা, ভারোত্তোলন, বধির ক্রীড়া, স্কোয়াশ অ্যান্ড র‌্যাাকেটস, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার, মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, ব্রিজ, তায়কোয়ানদো, গলফ, ক্যারম, মার্শাল আর্ট, ঘুড়ি, রাগবি, উশু, বেসবল সফটবল, কিক বক্সিং, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ানদো, ব্যুত্থান, ইয়োগা, সার্ফিং, মাউন্টেনিয়ারিং, কান্ট্রি গেমস, সেপাক টাকরো, চুকবল, থ্রোবল ও জুজুৎসু।

মজার বিষয় হলো, বেশ কয়েকটি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন চলছে প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি দিয়ে। বছরের পর বছর পার হলেও এ অ্যাসোসিয়েশনগুলো এনএসসিকে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়নি। অনুমোদন নিয়েই তারা ব্যবসায় মেতেছেন। এখন শুধু সরকারের অনুদানই নিয়ে যাচ্ছে। অথচ কিন্তু সরকারের নিয়ম মানছে না। ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন গঠনের উদ্যোক্তারা প্রথমে একটি কমিটিসহ নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। দেশের খেলাধুলার অভিভাবক সংস্থাটি অনুমোদন দেয়ার সময়ই বলে দেয় দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিতে। কিন্তু সেই দ্রুততম সময় আর আসে না। বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন অনুমোদন নেয় প্রভাব খাটিয়ে। যে কারণে, অনুমোদন নেওয়া হয়ে গেলে তারা আর কোনো নিয়ম মানে না। গত ৭ জানুয়ারি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে চার বছর অতিক্রম করে পঞ্চম বছরে পা দিয়েছেন মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি। তার দায়িত্বের শেষ বছরে কি ক্রীড়াঙ্গনে আবার নির্বাচনী হাওয়া বইবে?

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব পরিমল সিংহ বলেছেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে কোন ছাড় নেই। সব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে নির্বাচন করতে হবেই। আমরা এরই মধ্যে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে বলে দিয়েছি- যারা অ্যাডহক কমিটি দিয়ে চলছে এবং যে সব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে তাদের নির্বাচন আয়োজন করতে। অ্যাডহক কমিটি দিয়ে যারা চলছে তাদের তো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা দেয়া আছে। প্রয়োজনে আমরা আবার ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে চিঠি দিবো। নির্বাচন আয়োজনের জন্য আমরা আবার ড্রাইভ দিচ্ছি।’ বাংলাদেশ তায়কোয়ানদো ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার এনএসসি অ্যাডহক কমিটি গঠন করে দিয়েছিল ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট। এই তিন বছরেও ফেডারেশনের আর নির্বাচন হয়নি। কেন হয়নি? এমন প্রশ্নের ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম রানা বলেন, ‘অ্যাডহক কমিটি গঠনের পর আমরা দুইবার নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম এবং সেই মোতাবেক এনএসসিতে কাগজপত্রও জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে নির্বাচন হয়নি। এখন আমরা আবার এনএসসিতে কাগজপত্র জমা দেব।’

নির্বাচন আয়োজনের জন্য এনএসসি কোনো চিঠি দিয়েছিল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুল ইসলাম রানা বলেন, ‘দুই বছর আগে একবার চিঠি দিয়েছিল। তারপর আর দেয়নি।’ বাংলাদেশ উশু অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডহক কমিটি দিয়ে চলছে ৪ বছর ধরে। কেন নির্বাচন হচ্ছে না? জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন বলেন, ‘আসলে আমাদের কোনো গঠনতন্ত্র ছিল না। আমরা এরই মধ্যে সেটা তৈরি করে নির্বাহী কমিটির অনুমোদন নিয়েছি। এখন আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই এনএসসিতে গঠনতন্ত্র জমা দিয়ে তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করতে অনুরোধ করবো। আসলে গঠনতন্ত্র না থাকার কারণেই নির্বাচনে বিলম্ব হয়ে গেছে আমাদের।’ বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ১০ মে। দেড় বছরের অধিক সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে ফেডারেশন। এ বিষয়ে ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক আহমেদেুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমাদের ফেডারেশনের সাধারণ সভায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মনোনীত ৫ জন কাউন্সিলর থাকেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে ওই পাঁচজনের নাম চেয়েছি। এখনো পাইনি। যে কারণে আমরা পুরো কাউন্সিলর তালিকা তৈরি করতে পারছি না। অন্য ২৭ কাউন্সিলর আমাদের চূড়ান্ত হয়ে আছে। আমরা আবার নামগুলো চাইব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে।’