আরো বড় কিছুর স্বপ্ন ইমরানুরের

প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শফিক কলিম

ইমরানুর রহমান কাজাখস্তানের আস্তানায় এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। এশিয়ার মঞ্চে অতীতে যেখানে বাংলাদেশ পদকের ধারেকাছেই যেতে পারেনি, সেখানে তিনি জিতে ফেলেছেন সোনার পদক! ইমরানুর স্বীকার করেছেন, সোনা জয়ের কথা তিনিও ভাবেননি, ‘ভালো কিছু করার আশা নিয়ে এসেছিলাম কাজাখস্তানে। তবে সোনা এসে যাবে, মাথায় আনিনি। এ সাফল্য আমাকে উজ্জীবিত করছে। এখন মনে করছি, সামনে আরও ভালো করা সম্ভব। এরপর আমার লক্ষ্য, দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশকে সোনা জেতানো। এশিয়ান গেমসেও ভালো করতে চাই। অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতায় ভালো করার লক্ষ্য তো আছেই।’ শুনতে শুনতে মনে হয়, বাংলাদেশের একজন অ্যাথলেটের গলায় এশিয়ান গেমসে ভালো করার প্রত্যয় বাড়াবাড়ি কি না! আসলে তা নয়। ইমরানুর নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তার পক্ষে যে অনেক দূর যাওয়া সম্ভব, সেটা এরই মধ্যে নিজের কীর্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

কাজাখস্তানের আস্তানায় ৬০ মিটার স্প্রিন্টে ৬ দশমিক ৫৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে সেরা হয়েছেন ইমরানুর। দ্বিতীয় হয়েছেন হংকংয়ের শাক কাম চিং, ৬ দশমিক ৬৫ সেকেন্ডে। তৃতীয় হওয়া জাপানের সুজুকি রাইওতার টাইমিং ৬ দশমিক ৬৬ সেকেন্ড। সেমি-ফাইনালে অনেকটা পথ এগিয়ে থেকেও শেষ দিকে কাতারের প্রতিযোগী ফেমি সেউন ওগুনোডের কাছে ফটো ফিনিশিংয়ে হেরে দ্বিতীয় হয়েছিলেন ইমরানুর। ৬ দশমিক ৬১ সেকেন্ড সময় নেন তিনি, গত বছর সার্বিয়ার বেলগ্রেদে ৬ দশমিক ৬৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে দৌড় শেষ করেছিলেন ইমরানুর। ব্যক্তিগত সেই টাইমিং তিনি কাতারে এক দফা সেমিফাইনালে ভাঙেন। এরপর ফাইনালেও গড়লেন নতুন করে, হিটে সময় নেন ৬ দশমিক ৭০ সেকেন্ড।

তুরস্কে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের হিটে ইমরানুর রহমানের টাইমিং ১০.০১ সেকেন্ড। যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম। সেই কীর্তির কারণেই তার ওপর আলো। এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিক্সে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে তাৎক্ষণিকভাবে স্টেডিয়ামে অনেক অভিনন্দন পেয়েছেন, বলেন, ‘এখানে কাতার, জাপান, থাইল্যান্ড হংকংসহ বিভিন্ন দেশের অ্যাথলেটরা আমাকে বাহবা দিয়েছে। ওরাও ভাবতে পারেনি, আমি প্রথম হয়ে যাব। আর প্রথম হয়ে দেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা পেয়েছি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর হয় না। আমি খুবই খুশি যে পুরস্কারের জন্য এত পরিশ্রম, সেটা পেয়েছি। শেকড়ের টানে আমি বাংলাদেশের এসেছিলাম দেশের জন্য কিছু করতে। দেশের পতাকা হাতে বিদেশে নিজেকে মেলে ধরতে। সেটা পেরেছি। সবার দোয়া চাই, যাতে এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারি।’

দেশের নিস্তরঙ্গ অ্যাথলেটিকসে ইমরানুর যেন আশার প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছেন। এই প্রদীপের আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ। ইমরানুর তো অভিনন্দনে সিক্ত হবেনই, তার অবিস্মরণীয় সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ও অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ, মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা, বিশ্ব অ্যাথলেটিকসের সভাপতি সিবাস্তিয়ান কু, এশিয়ান অ্যাাথলেটিকসের সভাপতি জেনারেল দাহলান আল হামাদ, সাফ অ্যাথলেটিকসের সভাপতি ললিত কে ভানট, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সভাপতি আদিল জে সামরওয়ালা সহ বিভিন্ন ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ দেশ ও দেশের বাহির থেকে বিভিন্ন পেশার ক্রীড়া অনুরাগী।

ইমরানুর শুধুই অ্যাথলেটিকস নিয়ে থাকতে চান। উপায় কী? গত বছর তুরস্কে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ফাইনালে উঠেও বাংলাদেশের কোনো স্পনসর প্রতিষ্ঠানের মন গলাতে পারেননি। তার পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। সে সময় ইমরানুর গণমাধ্যমে বলছিলেন, ‘ইংল্যান্ডে দুটি চাকরি সামলে তার পক্ষে ঠিকঠাক অ্যাথলেটিক চর্চা অব্যাহত রাখা কঠিন। স্ত্রী আর শিশুকন্যা নিয়ে তার সংবার। সংসারের নানা কাজ সামলাতে হয়। সকালে চাকরিতে যাওয়ার আগে ২-৩ ঘণ্টা অনুশীলন করেন। কাজ শেষে সময় পেলে সন্ধ্যায় আবার অনুশীলনে নামেন। তার ওপর অনুশীলন করতে টাকা দরকার। একজন কোচ রাখলে তাকে সপ্তাহে কড়কড়ে পাউন্ড দিতে হয়। সে সময় ইমরানুরের সাক্ষাৎকার পড়ে দেশের শীর্ষ একটি ক্রীড়া ফেডারেশন খোঁজ নিয়েছিল, মাসে কত টাকা হলে চাকরি না করে শুধু খেলা নিয়ে থাকতে পারবেন ইমরানুর। তিনি হিসাব করে জানান, মাসে তার ৫ লাখ টাকা হলেই চলবে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি আর এগোয়নি। অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনও পারেনি ইমরানুরের স্পনসরশিপের ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে। সেই ব্যর্থতা মুছে এবার অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন জোরেশোরে চেষ্টা করবে? তার চেয়ে অবশ্য বড় প্রশ্ন, কোনো স্পনসর প্রতিষ্ঠান কি এগিয়ে আসবে?

ইমরানুরের গল্পটা অনেকেই জানেন। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন হঠাৎ ইমরানুরকে ঢাকায় এনে পরিচয় করিয়ে দেয় সবার সামনে। তাঁকে আনার পেছনে বড় কারণ ছিল দেশের অ্যাথলেটিসে সাফল্য-খরা দূর করা। ২০০৬ সালে কলম্বো এসএ গেমসে ১১০ মিটার হার্ডলসে মাহফুজুর রহমান সোনা জেতার পর আর সোনা আসেনি এই গেমসে। সোনা দূরে থাক, অ্যাথলেটিকসে ‘দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিকে’ পদক জেতাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য। ইমরানুর আসার পর বিকেএসপিতে প্রথম তাঁর ট্রায়াল নিয়েছিল ফেডারেশন। হ্যান্ড টাইমিংয়ে তখন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১০.৪০ সেকেন্ড সময় নেন, ৬০ মিটারে ৬.৫০ সেকেন্ড। হ্যান্ড টাইমিংয়ে আসল চিত্রটা না এলেও আশাবাদী হলেন ফেডারেশন কর্তারা। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় জাতীয় অ্যাথলেটিকসে প্রথম অংশ নিয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জেতেন ইমরানুর, সময় নেন ১০.৫০ সেকেন্ড। ভাঙেন ২২ বছরের পুরোনো জাতীয় রেকর্ড।

সেই থেকে ইমরানুরকে আর পেছন তাকাতে হয়নি, ছুটছেন সামনে। বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে মোটামুটি ভালো করেন, তারপর ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে। যেখানে ১০০ মিটারে তার টাইমিং হয়েছিল ১০.০১ সেকেন্ড। পরে অবশ্য সলিডারিটি গেমসে স্প্রিন্টের সব টাইমিং বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। কারণ, টাইমিংয়ে নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল। সব ছাপিয়ে শনিবার ইমরানুর নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। বাংলাদেশের মৃতপ্রায় অ্যাথলেটিকসে নতুন আশার আলো দেখিয়েছেন। এখন দায়িত্ব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের। সেই দায়িত্ব পালনে কতটা প্রস্তুত ফেডারেশন? ইমরানুরের সঙ্গে কাজাখস্তান সফরে থাকা বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানান, ‘আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে এখন। অবশ্যই সেই দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করব। আমরা সরকারের শীর্ষ মহলসহ স্পনসরদের কাছে যাব, যাতে ইমরানুর আর্থিক সমর্থনটা পায়। আমরা ওকে এখন দেশে নিয়ে আসছি, সংবর্ধনা দেব। তারপর দেখছি, কী করা যায়।’ এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিক্?সে সোনাজয়ী বাংলাদেশের দ্রুততম মানব ইমরানুরকে ঢাকায় এনে সংবর্ধনা দিতে চায় বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন। কখন ঢাকায় ফিরবেন, সেটা ঠিক হয়নি। কাজাখস্তান থেকেই তার লন্ডন ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, এখন তাকে ঢাকায় আনার পরিকল্পনা হচ্ছে। আসবেন সম্ভবত আজ।