ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্বকাপের সাফল্য নিয়ে কৌশলী হাথুরুসিংহে!

বিশ্বকাপের সাফল্য নিয়ে কৌশলী হাথুরুসিংহে!

বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলছে সেই ১৯৮৬ সাল থেকে। কিন্তু আইসিসির টেস্ট স্ট্যাটাস না পাওয়ায় এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার সুযোগ করে নিতে না পারার কারণে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেত কালে-ভাদ্রে। বলা যায়, এখানে একমাত্র প্ল্যাটফর্মই ছিল এশিয়া কাপ। কিন্তু ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। কিন্তু পেলেও সাফল্য সেভাবে আসেনি। তারপরও বলার মতো সাফল্য আসে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কোচিংকালে।

হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময় টেস্টে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল। ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। এর মাঝে পাকিস্তানকে করেছিল তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। এছাড়া ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছিল ২০১৭ সালে। যদিও তার চলে যাওয়াটা সুখকর ছিল না। ছিল বিব্রতকর। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ছিল। সফর শেষ হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার এরকম বিদায় তখন বিসিবি থেকে শুরু করে অনেকেই ভালোভাবে নেননি। তারপরও তাকে ফিরিয়ে আনার কারণ তার ওই সাফল্য আর কড়া হেড মাস্টারের ভূমিকা। আবার তাকে পাওয়াও যাবে বছরজুড়ে।

হাথুরুকে ফিরে পেয়ে বাংলাদেশের অতীত সাফল্যগুলো আবার সামনে চলে এসেছে। বারবার করা হচ্ছে স্মৃতিচারণ। গতকাল বুধবারের সংবাদ সম্মেলনেও উঠেছে সেই সব সাফল্যের কথা। দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে পেয়ে সেই সব সাফল্য ডিঙিয়ে আরও শিখরে দেখতে আশার জাল বুনন শুরু করছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। সম্ভব কি হবে হাথুরুসিংহের পক্ষে তা পূরণ করার! সরাসরি জবাব দেননি হাথুরুসিংহে। তার কথায় ছিল কূটনৈতিকের মতো। হালকা হেসে জবাব দেন, ‘খুব বড় একটা প্রশ্ন। এটা আমরা সব সময়ই চাই। কিন্তু চাইলেইতো আর হবে না। এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। সময়ই বলে দেবে। আমরা এখন সেরা চারে নেই। তাই আমি যদি বলি এটা করে দেখাব, সেটা কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’ আগের মতো ভালো করতে হলে তিনি বলেন, ‘এখনো আামাদের কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে। বাছাই করতে হবে সেরা কম্বিনেশন। বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলোয়াড়রা যেন নিজেদের সেরা ফর্মে থাকতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দেখি সামনে কী অপেক্ষা করছে।’ তাহলে আগের সাফল্য কি তার জন্য চাপ হয়ে গেল? এখানেও হাথুরুসিংহে ছিল কৌশলী। তিনি বলেন, ‘কোচদের চাকরি সব সময় চাপের। ভালো করলে প্রশংসা পাওয়া যায়। চাকরি টিকে যায়। ভালো করতে না পারলে কোচের দিকেই আঙুল উঠে সবার। ওয়ানডে ক্রিকেটেই আমরা শুধু ভালো খেলে থাকি। তাই আগামী বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের সবারই প্রত্যাশা বেশি। এটা নির্ভর করছে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। দলের মূল খেলোয়াড়সহ অন্যরা বিশ্বকাপের আগে কতটা ফিট এবং সুস্থ থাকেন।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার পর এবারের আগেও দফায় দফায় ফেরার প্রস্তাব পেয়েছেন, জানালেন এই শ্রীলঙ্কান। ‘২০১৭ সালে বাংলাদেশের দায়িত্ব ছাড়ার পর বিসিবির তরফ থেকে এবারই কি প্রথম প্রস্তাব পেয়েছিলেন? এক শব্দে চান্দিকা হাথুরুসিংহের উত্তর, ‘না!’ পাল্টা প্রশ্ন, ‘তাহলে দ্বিতীয়বার?’ এবারও তার উত্তর একই, ‘না!’

কতবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তাকে, তা আর জানা যায়নি। তবে হাথুরুসিংহের কথায়ই পরিষ্কার, বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে তাকে ফেরাতে দফায় দফায় প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সবশেষ প্রস্তাবে রাজি হয়ে প্রধান কোচ হিসেবে আবার বাংলাদেশে ফিরেছেন হাথুরুসিংহে। নতুন অধ্যায়ে তিনি প্রথমবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন গতকাল বুধবার দুপুরে। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এ দিন ক্রিকেটীয় ব্যস্ততা ছিল না খুব বেশি। ঐচ্ছিক অনুশীলন করেন তামিম ইকবাল, তাসকিন আহমেদ, ইয়াসির আলি চৌধুরি, লিটন দাস, তাইজুল ইসলামরা। দুপুরের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে চলে যান তারা। পরে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে হাথুরুসিংহে তুলে ধরেন বাংলাদেশের দায়িত্বে তার ফেরার প্রেক্ষাপট। ‘(২০১৭ সালে) চলে যাওয়ার পর থেকে আমি নিয়মিতই বাংলাদেশ ক্রিকেট অনুসরণ করেছি। বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়, কর্মকর্তারাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সবসময়ই আমার একটি ভালো লাগার জায়গা ছিল। কারণ এটিই ছিল আমার প্রথম আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। কোনো একদিন ফেরার ভাবনা তাই আমার মনের কোণে ছিলই। তবে ভাবতে পারিনি যে, এত আগে ফিরে আসব।’ জানুয়ারির শেষ দিন হাথুরুসিংহের ফেরার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় বিসিবি। সেদিন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানান, গত বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ই হাথুরুসিংহেকে ফেরানোর ব্যাপারে কথাবার্তা বলে এসেছিলেন তারা। এবার হাথুরুসিংহেও বললেন একই কথা।

‘(অস্ট্রেলিয়ায়) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় (বিসিবি) প্রেসিডেন্ট ও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা হয় আমার। আমরা কিছু জিনিস আলোচনা করি এবং আমার তখন মনে হয় ফেরার জন্য এটিই উপযুক্ত সময়। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ এগিয়ে আসছে। যদি নিউ সাউথ ওয়েলসের মৌসুম শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতাম, তাহলে হয়তো একটু দেরি হয়ে যেত। তাই বিগ ব্যাশ শেষ হতেই চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই।’ ২০১৭ সালে হাথুরুসিংহের বিদায়ের সময়টা খুব একটা মসৃণ ছিল না। ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির খবর পাওয়া গেছে অনেক। পাশাপাশি বোর্ডের কারো সঙ্গে আলোচনা না করে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসেই পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। পরে দায়িত্ব ছাড়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে তিনি ঢাকায় ফেরেন। বিসিবি প্রধান ও কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে তার লম্বা আলোচনা হয় সেদিনও। পরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আর কিছুই দেয়ার নেই বলে তাকে জানিয়েছেন হাথুরুসিংহে। সাড়ে ৫ বছর পর প্রশ্নটি উঠছেই, এখন তাহলে তার ফিরে আসার পেছনে প্রেরণা কী! বোর্ড সভাপতির কথায় না গিয়ে হাথুরুসিংহে তুলে ধরলেন তার অবস্থান। ‘আমি শুধু আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পারি। আমার মনে হয়, সামনের ২-৩ বছর বাংলাদেশের জন্য পালা-বদলের সময়। কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার বাংলাদেশের জন্য দারুণ খেলেছে। তারা দেশের ক্রিকেটের কিংবদন্তি। তাদেরকে অবশ্যই খুব ভালো প্রজন্ম হিসেবে মনে রাখা হবে। অন্য দিকে অনেক ভালো তরুণ ক্রিকেটারও এখন উঠে আসছে। এই ধরনের চ্যালেঞ্জের অংশ হওয়া আমাকে ফেরার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে।’

কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গেই সম্পর্কে টানাপড়েন নেই, দাবি পুরোনো দায়িত্বে নতুন করে ফেরা বাংলাদেশের প্রধান কোচের। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ব্যাপারটি মোটামুটিই প্রতিষ্ঠিতই। সংবাদমাধ্যমে নানা সময়ে এসেছে। ২০১৭ সালে চান্দিকা হাথুরুসিংহে যখন প্রধান কোচের দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেলেন, তখন এবং পরেও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের কথায় সরাসরি বা ইঙ্গিত মিলেছে, দায়িত্বের শেষ ভাগে সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্কটা উষ্ণ ছিল না হাথুরুসিংহের। আবার বাংলাদেশের দায়িত্বে ফেরার পর পুরনো প্রসঙ্গটি উঠতেই এই শ্রীলঙ্কান বললেন, ‘আপনার প্রশ্নটি ‘রাবিশ’ কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে আমার টানাপড়েন নেই।’ হাথুরুসিংহের প্রথম দফার দায়িত্বেও সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ছিল এটিই। কোচ হিসেবে তার দক্ষতা, পরিকল্পনা সাজানো থেকে শুরু করে কোচিংয়ের ক্রিকেটীয় স্কিলের জায়গাগুলোতে তাকে প্রশ্ন ছিল সামান্যই। কিন্তু কোচিংয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, ‘ম্যান-ম্যানেজমেন্ট’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নানা সময়ে। আগের দফায় বাংলাদেশ ছাড়ার আগে ২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিসিবি সভাপতি ও আরও কয়েকজন বোর্ড কর্তার সঙ্গে আলোচনায় বসে ক্রিকেটারদের মানসিকতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন হাথুরুসিংহে, প্রশ্ন তুলেছিলেন সাকিব আল হাসানের নিবেদন নিয়ে। সেদিন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বোর্ড প্রধানই সেসব বলেছিলেন। ৫ বছরেরও বেশি সময় পর পুরনো দায়িত্বে যখন তিনি ফিরলেন, পুরনো ক্ষতগুলোও ফিরে আসার শঙ্কা থাকে। নতুন দফায় তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বুধবার সেই প্রশ্নটিই উঠল, সিনিয়র ক্রিকেটের সামলানো কি চ্যালেঞ্জ হবে? হাথুরুসিংহে উড়িয়ে দিলেন শঙ্কা। ‘নাহ মোটেও না (চ্যালেঞ্জ হবে না)। সিনিয়রদের সবার সঙ্গেই আমার এর মধ্যেই কথা হয়েছে। সবারই মনোযোগের কেন্দ্রে আছে একটি ব্যাপারই, সেটা হলো দল সবার ওপরে। দলের ভালোর জন্য সবাই চেষ্টা করে যাবে।‘ ‘এমনকি আমার আগেরবারের দায়িত্বেও ক্রিকেটারদের কাউকে নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়নি আমাকে। আমার চ্যালেঞ্জ হলো, সবার মনোযোগ দলের ভালোর দিকে নেয়ায়। আমার তাই মনে হয় না, এটা (সিনিয়রদের সামলানো) চ্যালেঞ্জ হবে।’ সিনিয়র ক্রিকেটারদের যারা দলে আছেন, তাদের ভূমিকাও আগের মতোই থাকবে বলে জানিয়ে দিলেন প্রধান কোচ। ‘যে ভূমিকা তারা পালন করছে, গত ১৫-১২-১০ বছর ধরেই করে আসছে। যতদিন তারা খেলছে, যতদিন দলে নির্বাচিত হচ্ছে, এই ভূমিকাই পালন করে যাবে। আমার মনে হয় না, তাদের ভূমিকা খুব একটা বদলাবে। কারণ, তারা বিশ্বমানের ক্রিকেটার এবং নিজেদের ভূমিকায় তারা দারুণ সফলও।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত