বাফুফের অনিয়মে অভিযুক্ত কাউন্সিলররাও

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  স্পোর্টস রিপোর্টার

ফিফা কোড অব এথিক্সের ২০২০ সংস্করণের ধারা ১৩ (আনুগত্যের কর্তব্য), ধারা ১৫ (সাধারণ দায়িত্ব), ধারা ২৪ (জালিয়াতি ও মিথ্যাচার), ধারা ২৮ (অর্থ লোপাট ও অপব্যবহার) লঙ্ঘনের অভিযোগে ২ বছরের জন্য সব ধরনের ফুটবলীয় কর্মকাণ্ড থেকে ফিফা কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। অভিযোগগুলো আনা হয়েছে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সময়ে। বাফুফেকে দেয়া ফিফার তহবিলের খরচের হিসাব দিতে গিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করেছেন বলে গত শুক্রবার বিবৃতিতে জানিয়েছে ফিফা। সেই সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ (বাংলাদেশি মানে ১২ লাখ টাকা)। নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে কোনো ধরনের ফুটবল কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না তিনি। ফিফার ৫১ পাতার রিপোর্টে উঠে এসেছে বাফুফে দীর্ঘদিনের অনিয়মের খতিয়ান, যাতে ফেঁসে গেছেন সদ্য সাবেক হওয়া সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। বাফুফের নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তারা সোহাগকে চাকরিচ্যুত ও আজীব নিষিদ্ধ করে নিজেদের গা থেকে অপরাধের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন।

ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মুর্শেদীসহ অন্যদের ভাবখানা এমন যে, তারা ধোয়া তুলসি পাতা। সব দোষ সোহাগের। বাফুফে সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন ফিফার সিদ্ধান্ত জানার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সোহাগকে আগলে রাখার আভাসই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- সোহাগের বিষয় নিয়ে তিনি ফিফার সঙ্গে কথা বলবেন। দুই দিনের মধ্যেই তিনি ইউটার্ন নিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এই যে দীর্ঘদিন বাফুফেতে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে তার জন্য কি আবু নাইম সোহাগ একাই দায়ী? এখানে আর কারো সম্পৃক্ততা নেই?

ফিফা সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ খুঁজে পেয়েছে, সেটা আর্থিক অনিয়মের। বাফুফেতে আর্থিক যে কাজটি করে থাকে ফিন্যান্স কমিটি। যে কমিটির চেয়ারম্যান সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। যিনি দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী। চালান বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অথচ তিনি ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বাফুফেতে এই জালিয়াতি। এটা তার অজান্তে হয়েছে, তা মানছেন না কেউ। এমন কি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনও কিছু জানতেন না, সেটা মানতে নারাজ সবাই। তাহলে শেষ পর্যন্ত সোহাগ কেন বলির পাঠা হলেন? বাকিরা কি বেঁচে যাবেন?

বাফুফের দুঃসময়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাধারণ সভার কাউন্সিলরদের। প্রতি সাধারণ সভায় তারা উপস্থিত থেকে বাফুফের সব আয়-ব্যয়ের হিসেব দুই হাত উঁচু করে অনুমোদন করেছেন। বিশাল অনিয়মে তাদের কি কোনো দায় নেই? অনিয়মের যে ফিরিস্তি ফিফার দরবারে পৌঁছেছে সেই অনিয়মের শুরু তো বাফুফের সাধারণ সভা থেকেই।

বাফুফের সাধারণ সভা মানেই যেন রাজকীয় ভাবসাব। পাঁচতারকা হোটেল বা রিসোর্টে বেশ কয়েক দিন থাকাণ্ডখাওয়া, দামি গিফট, নগদ নারায়ণ পেয়েই তারা দুর্নীতি জায়েজ করেছেন সাধারণ সভার পর সাধারণ সভায়।

বিশেষ করে নির্বাচনি সাধারণ সভায় তো চকচকে হয়ে উঠতো কাউন্সিলরদের মুখ। বাইরে নানা সমালোচনায় তারা সরব থাকলেও সাধারণ সভায় তাদের মুখ থেকেছে কুলুপ আঁটা। বিনাবাক্যে তারা পাস করে দিয়েছে কোটি কোটি টাকা অনিয়মের রিপোর্ট। আর ঘরে ফিরে গেছেন বিশাল সুবিধা নিয়ে। বাফুফের আজকের পরিণতির জন্য সবচেয়ে বড় দায়ী সেই কাউন্সিলরা এখন সবাই নীরব!

অনিয়মণ্ডদুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ১০ সদস্যের যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে তা নিয়েই উঠেছে বড় প্রশ্ন। কারণ, ওই ১০ সদস্যের মধ্যে ৯ জনই বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াল নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিজেরাই তদন্ত করবেন!

বাফুফের গঠন করা এই তদন্ত কমিটিকে হাস্যকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন দুই সাবেক তারকা ফুটবলার ও একসময়ে বাফুফের নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু ও হাসানুজ্জামান খান বাবলু। তারা দুজনই মনে করছেন, দেশের মানুষকে বোকা ভাবেন বাফুফে কর্মকর্তারা। তাই নিরপেক্ষ কাউকে না দিয়ে নিজেদের অপরাধ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়েছেন। বাফুফের বর্তমান টালমাটাল অবস্থা নিয়ে আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুর জবাব, ‘এ কেমন তদন্ত কমিটি? যে প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে তদন্ত, সেই প্রতিষ্ঠানের লোকজনই তদন্ত করবেন। হাস্যকর। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি নয় কেন? আসলে বাফুফেতে যারা আছেন তারা মনে করেন, আমরা বোকা আর ওনারা চালাক। আমি একটা জিনিস বুঝি, বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক নির্বাহী কমিটির নির্দেশে চলেছেন। সভাপতি ও সিনিয়র সহসভাপতির নির্দেশে চলেছেন। এর বাইরে তার এক পা অগ্রসর হওয়ারও সুযোগ ছিল না। তাই তদন্ত কেবল সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে নয়, সবার বিরুদ্ধে করতে হবে। ঘরের লোক দিয়ে সেই তদন্ত করে লাভ নেই। এই কমিটি কেবল নিজেদেরই রক্ষার চেষ্টা করবে।’ হাসানুজ্জামান খান বাবলু বলেছেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে দেশের মানুষকে বোকা বানাতে চাইছেন বাফুফে কর্মকর্তারা। যারা অপরাধী তাদেরকেই বলা হচ্ছে বিচার করো। এটা হাস্যকর, অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাই এত কিছুর পরও বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তারা দম্ভ নিয়ে চলছেন। নির্লজ্জভাবে কথা বলছেন।’