ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পঞ্চাশেও একই রকম বিস্ময়

পঞ্চাশেও একই রকম বিস্ময়

বিশ্ব ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন ১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর, বয়স তখন ১৬ বছর ২০৫ দিন। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বয়সে ছেলেমেয়ে স্কুল ফাইনাল দেয়। সে বয়সে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার মুখোমুখি হয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, ইমরান খান, আব্দুল কাদিরদের, যাদের নামে তখন বিশ্ব ক্রিকেটের বাঘা বাঘা ব্যাটাররাও দুই ঢোঁক বেশি পানি খেতেন! বিস্ময়ের শুরু তখন থেকেই, ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বিস্ময় বালক’ খেলা ছেড়েছেন ১০ বছর আগে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। দেখতে দেখতে হয়ে গেল এক দশক! কেমন খেলতেন শচীন? স্যার ডন ব্র্যাডম্যান একবার বলেছিলেন, ‘ছেলেটা অনেকটা আমার মতো খেলে।’ তাঁর পরবর্তী সময়ের অসংখ্য ক্রিকেটারকে দেখার পর এক মাত্র শচীন সম্পর্কেই এই উক্তি করেছিলেন ব্র্যাডম্যান। তার এই বক্তব্যে লুকিয়ে রয়েছে প্রশ্নের উত্তর। আরও পরিষ্কার করে বোঝাতে হলে ভিভিয়ান রিচার্ডসের সেই উক্তির কথা বলতে হয়, ‘শচীন অসাধারণ। আমার মতে, এত দিন যে ক্রিকেট খেলা হয়েছে, এবং পরে খেলা হবে, তার যেকেনো পর্যায়ে প্রথম থেকে শেষ বল পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারে শচীন। ৯৯.৫ শতাংশ নিখুঁত একজন ব্যাটসম্যান।’ ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভারতের স্পোর্টস্টারের সঙ্গে এই কিংবদন্তি কথা বলেন তার ক্রিকেট, জীবন, পরিবার, দর্শন ও আরো অনেক কিছু নিয়ে। সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো এখানে।

প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের উত্থানের সঙ্গে দেশ হিসেবে গোটা বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তির বদল একই সমান্তরালে-

শচীন টেন্ডুলকার : কাকতালীয়ভাবে, সময়টাই ছিল অমন। তখন আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন আসছিল। মাঠের ভেতরে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি, তা ছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপে। সেই থেকে ভারতীয় ক্রিকেট নাটকীয়ভাবে বদলাতে শুরু করল। জাতি হিসেবেও বদলে যাচ্ছিলাম। চারপাশে এত কিছু চলছিল! এমনকি আমার জন্যও সবকিছু বদলে যাচ্ছিল। স্পন্সরশিপ ও আরও অনেক কিছু ছিল- আমি সম্ভবত প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার, চুক্তি স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে যে ক্রীড়াবিদের ব্যবস্থাপনা দেখভাল করছিলেন এজেন্ট। এর আগ পর্যন্ত এজেন্টের ধারণাই ছিল না ভারতে। কয়েকটি জায়গা থেকে এমন বলাবলি হচ্ছিল যে, আমার মনোযোগ এখন অর্থের দিকে বা এমন অনেক কিছু। আদতে ব্যাপারটি ছিল উল্টো। টেবিলে বসে চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করতে চাচ্ছিলাম না আমি, কারণ এটা আমার কাজ নয়। এই কাজে শক্তি ও সময় খরচ করতে চাচ্ছিলাম না। স্কোরবোর্ডের ডান দিকে সংখ্যাটি ও দলের জয় থেকেই কেবল রাতে শান্তির ঘুম দিতে পারতাম। রানের সংখ্যার চেয়ে ব্যাংক ব্যালান্স কখনোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমার পরিবারের সদস্যরা সবসময় জানতে চাইতেন, আমি কত রান করেছি। কতগুলো চুক্তি স্বাক্ষর করেছি, তা নয়। আমি তাই শুধু খেলাতেই মনোযোগ দিতে চেয়েছি।

প্রশ্ন : আশি-নব্বয়ের দশকের সমার্থক হয়ে থাকা মধ্যবিত্ত মানসিকতা বা হীনম্মন্যতার প্রভাব নিজের ক্যারিয়ারে পড়তে না দেয়া-

শচীন টেন্ডুলকার : আমার মনে হয়, বাবার স্থিরতা ও মায়ের দৃঢ়তা থেকেই এটা পেয়েছি আমি। সবসময়ই বিশ্বাস করেছি, বিনয়কে কখনও দুর্বলতা হিসেবে দেখা উচিত নয়। যদি ভালো, বিনয়ী ও ভদ্র হই, এটার মানে এই নয় যে আমি আত্মবিশ্বাসী নই। নিজের বেড়ে ওঠার শিক্ষাকেই স্রেফ ফুটিয়ে তুলছি আমি। আমি নিজেকে বলতাম, মাঠে আমি প্রতিনিধিত্ব করছি দেশকে, মাঠের বাইরে আমার পরিবারকে। এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগ্রাসন দেখানোর প্রয়োজন হলে ঠিকই দেখিয়েছি। মাঠে আমার আগ্রাসী মনোভাব ও মাঠের বাইরে ধীরস্থির মনোভাব নিয়ে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল। বলেছিলাম, ‘মাঠে যা দেখি, সেভাবেই সাড়া দেই। মাঠের বাইরে সাড়া দেই যা ঘটছে, সেটির।’ প্রতিক্রিয়া দেখানো ও জবাব দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিক্রিয়া আসত সহজাতভাবেই, মাঠে আমি জানতাম যে প্রতিপক্ষ বোলার ও তাদের গোটা দলের বিপক্ষেই লড়াইয়ে জিততে হবে। এর বাইরে সাড়া দেয়ার ব্যাপারটি ছিল পুরো ভিন্ন। এটা পরিবার থেকেই এসেছে। বেশির ভাগ সময়ই আমি ভাবতাম, এই সময়ে আমার বাবা কীভাবে সাড়া দেবেন। সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করতাম।

প্রশ্ন : মাঠের ক্রিকেটে যে দিকটি মিস করেন?

শচীন টেন্ডুলকার : দেশের হয়ে খেলার সময়ের গর্ব, মাঠের ভেতরে চ্যালেঞ্জগুলো, টিম মিটিং, ড্রেসিং রুমের বন্ধুত্ব এবং অন্য সবকিছু সহজাতভাবেই হয়। তবে কিছুই স্থায়ী নয়। দলে থাকার সময় এসব হয়ই। সম্প্রতি আমরা গোটা দুই রোড সেফটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট (সাবেকদের আসর) খেলেছি। আবার মাঠে ফেরা ও খেলতে পারা ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। এর বাইরে, আমার বিদায়টা (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে) ছিল দারুণ। আমার সবসময়ই মনে হতো, শেষ ম্যাচের অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে। শেষ পর্যন্ত সেই দিনটিতে (বিদায়ের দিন) যা হয়েছে, আমার কাছে তা স্পেশালেরও বেশি কিছু। এই কারণেই মূলত কোনোকিছু আমি মিস করি না। কারণ, সক্রিয় ক্রিকেটার হিসেবে মাঠ ছাড়ার শেষ দিনটির স্মৃতি আমাকে রোমাঞ্চিত করে। যখন ওদের (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ৮ উইকেট পড়ে গেল, ৯ উইকেট পড়ে গেল, আমি আক্ষরিক অর্থে নিজেকে বলছিলাম, ‘মাঠে আমার শেষ কয়েকটি মূহূর্ত এসব আক্ষরিক অর্থে গুণতে শুরু করছিলাম, এরপর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না। সক্রিয় ক্রিকেটার থাকব না, সবসময়ই অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচনা করা হবে আমাকে।’ এই মুহূর্তটা এতটা স্পেশাল ছিল যে, আমার কোনো আক্ষেপ নেই।

প্রশ্ন : টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আবির্ভাব আরও আগে হলে টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের পরের ভাগ অন্যরকম হতো কি না?

শচীন টেন্ডুলকার : সত্যি বলতে, জানি না। উত্তর দেয়া কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় না তেমন কিছু হতো। কারণ একটা সময় ছিল, অনেকে বুঝতেই পারত না টি-টোয়েন্টি কী জিনিস এবং না বুঝেই এটাকে বলত তরুণদের খেলা। এমন অনেক বিশেষজ্ঞ ছিল, যারা নিজেরা একটি বলও জীবনে খেলেনি, তাদের গলা ছিল ক্রিকেট খেলা অনেকের চেয়েও উঁচু। উপলব্ধি করেছিলাম, এটা এতটা আরোপিত নয়। বরং বলব, টি-টোয়েন্টিই সবচেয়ে সহজ সংস্করণ। ওয়ানডেতে পুরো একটি দিন কাটাতে হয়, শারীরিকভাবে এটিই তাই সবচেয়ে কঠিন সংস্করণ। টি-টোয়েন্টি এতটা কঠিন নয়। টেস্ট ক্রিকেটে যখন প্রচণ্ড গরমে একজন ফাস্ট বোলারকে লম্বা স্পেল করতে হয়, কিংবা একজন ব্যাটসম্যানকে তেতে থাকা সূর্যের নিচে সারাদিন ব্যাট করতে হয়, তখন কঠিন হয়ে ওঠে। এইরকম পরিস্থিতিতে শারীরিকভাবে অনেক সময় নুইয়ে পড়তে হয়। নিজের হাইড্রেশনের খেয়াল না রাখলে বা পুরো ফিট না হলে, প্রথমেই যা হয়, তা হলো মনোযোগ ও ফোকাস নড়ে যায়। এখানেই পরিপূর্ণ ফিটনেসের ব্যাপারটি আসে।

প্রশ্ন : ক্যারিয়ারের কোনো সময় বা ঘটনা অন্যরকম হতে পারত বলে ভাবেন?

শচীন টেন্ডুলকার : ২০০৭ বিশ্বকাপ। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই সময়টা ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য খুব ভালো ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগটুকুও, ভারতীয় ক্রিকেটে যা ছিল অন্ধকার একসময়। এই দুটি (বদল চাইতাম) অবশ্যই।

প্রশ্ন : আপনার নেতৃত্বের নাজুক রেকর্ডে অন্য বিতর্কগুলোকে উপেক্ষা করা হয় কি না?

শচীন টেন্ডুলকার : কোনো সংশয় নেই! আমার তা মনে হয়। তবে আমি আঙুল তুলতে চাই না। আমার মনে হয়, অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলতে চায় না, অনেকে না জানার ভান করে।

প্রশ্ন : পঞ্চাশে পৌঁছে এমন কিছু আছে কি না, যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু করা হয়নি?

শচীন টেন্ডুলকার : সত্যি বলতে, না। আমার প্রথম ইনিংস ২৪ বছর টিকেছে (খেলোয়াড়ী জীবন), দ্বিতীয় ইনিংসে স্রেফ ১০ বছর পার করলাম। আগে যেমনটি বলেছি, দ্বিতীয় ইনিংসে আরও অনেক কিছু অর্জন করতে চাই।

শচীনের যত রেকর্ড

১৮৯৪ : এক মৌসুমে (১৯৯৮) সবচেয়ে বেশি রান

১৫৯২১ : টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান

১৮৪২৪ : ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি রান

১০০০০ : টেস্টে দ্রুততম ১০ হাজার রান

২০০ : সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলা ক্রিকেটার

৪৬৩ : সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে খেলা ক্রিকেটার

২০০* : ওয়ানডেতে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান

১০০ : আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করা একমাত্র ক্রিকেটার

৫১ : সবচেয়ে বেশি টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান

৪৯ : সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে সেঞ্চুরি

৬৮ : সবচেয়ে বেশি টেস্ট হাফ সেঞ্চুরি

৯৬ : সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে হাফ সেঞ্চুরি

২২৭৮ : বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান

৬ : সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ খেলা ক্রিকেটার

৬ : বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি

৬৭৩ : এক বিশ্বকাপে (২০০৩) সবচেয়ে বেশি রান

৯ : এক মৌসুমে (১৯৯৮) সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত