রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল : চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান

মোহামেডান ৪ (৪) : (২) ৪ আবাহনী

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  স্পোর্টস রিপোর্টার

১-০, ২-০, ২-১, ২-২, ৩-২, ৩-৩, ৩-৪ এবং ৪-৪! এভাবেই গ্যালারিজুড়ে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা ছড়িয়ে দিল প্রায় একযুগ পর ঘরোয়া লিগের ফাইনালে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডান। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শ্যুটআউটের লড়াইয়ে আবাহনীকে টেক্কা দিয়ে ফেডারেশন কাপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল ১৪ বছর পর আসরের ফাইনালে ওঠা মোহামেডান। টাইব্রেকারে তারা জিতেছে ৪-২ গোলের ব্যবধানে। দুই দল সর্বশেষ ২০১১ সালে শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিল। সেবার ‘কোটি টাকার’ সুপার কাপে মোহমেডানকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল আবাহনী। এবার মধুর প্রতিশোধ নিল সাদা-কালোরা।

১২ বছর পর কোনো শিরোপা জিতল মোহামেডান। গতকাল কুমিল্লার ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে দুই দলের লড়াই ঘিরে সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। গ্যালারি ভরে উঠেছিল দর্শকে। ম্যাচের আগে মোহামেডানের টিম মিটিংয়ের কোচ আলফাজ বলেছিলেন, ‘আমাদের হারানোর কিছু নেই। ফেডারেশন কাপের ৪৩ বছরের ইতিহাসে ফাইনালে এই প্রথম হ্যাটট্রিক করে ইতিহাস গড়েছেন মোহামেডান স্ট্রাইকার ও অধিনায়ক সোলেমান দিয়াবাতে। বারবার পিছিয়ে যাওয়া দলকে তিনিই লড়াইয়ে ফিরিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তার ৪ গোলে ম্যাচটা হয়ে দাঁড়ায় ‘দিয়াবাতের ম্যাচ’, গড়েন নতুন ইতিহাস, ফেডারেশন কাপের ফাইনালে আর কোনো ফুটবলারের চার গোল করার কৃতিত্ব নেই। আসরের ৪৩ বছরের ইতিহাসে এমন বিরল রেকর্ড গড়লেন মালির ফুটবলার দিয়াবাত।

শুরুতে দুই গোলে পিছিয়েপড়া মোহামেডান ম্যাচে সমতা ফেরায়। পরে আবারো পিছিয়ে পড়ে দারুণ গোলে স্কোরলাইন হয় ৩-৩। অতিরিক্ত সময়ে সেই স্কোরলাইন গিয়ে ঠেকে ৪-৪-এ। তবে অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে আবাহনী চেপে ধরে মোহামেডানকে। গোলরক্ষক সুজন দুর্দান্ত দুটি সেভ না করলে মোহামেডান ম্যাচ থেকে ছিটকে যেতে পারত। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে গোলরক্ষক সুজন আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন। বদলি গোলরক্ষক বিপু মাঠে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমতের গোলে সমতা আনে আবাহনী। ফলে ৪-৪ গোলে সমতায় পৌঁছা ম্যাচটি টাইব্রেকারে গড়ায়। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো ফেডারেশন কাপের ফাইনালেও এমবাপের ন্যায় সুলেমান প্রথমে শট নিতে আসেন। সুলেমান গোলও করেন। আবাহনীর প্রথম শটটি মিস করেন রাফায়েল, মোহামেডান টাইব্রেকারের শুরুতেই লিড নেয়। পরে মোহামেডানের চতুর্থ শট মিস হলে টাইব্রেকারে সমতা আনার সুযোগ ছিল আবাহনীর। বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার কোস্টারিকান ড্যানিয়েল কলিন্দ্রেস ওই শট মিস করেন। পঞ্চম শটে কামরুল গোল করলে ১৪ বছরের শিরোপা বন্ধ্যাত্ব ঘোচায় মোহামেডান।

নির্ধারিত ৯০ মিনিটের শুরু থেকে আবাহনীর আক্রমণাত্মক ফুটবলের বিপরীতে মোহামেডান প্রতি আক্রমণ নির্ভর খেলতে থাকে। ১৭ মিনিটে আবাহনী এগিয়ে যায়। দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে এমেকা ওগবাহর দারুণ পাস থেকে ফয়সাল আহমেদ ফাহিম ক্ষিপ্র গতিতে ডান প্রান্ত দিয়ে বক্সে ঢুকে গোলকিপার সুজন হোসেনকে পরাস্ত করেন। ৪৩ মিনিটে ব্যবধান বাড়িয়ে নেয়। মোহাম্মদ হৃদয়ের লং পাস থেকে বক্সের ভেতরে পেয়ে কলিনদ্রেস ডিফেন্ডার হাসান মুরাদকে ছিটকে দিয়ে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে দারুণভাবে জাল কাঁপান। এই অর্ধে মোহামেডান মাঝেমধ্যে প্রতিপক্ষের অর্ধে গিয়ে বল নিয়ে গেলেও গোলকিপার সোহেলকে বড় পরীক্ষায় ফেলতে পারেনি। সেটপিস থেকে সুযোগ এসেছিল। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি দিয়াবাতে-ইমানুয়েলরা। বিরতির পর ম্যাচ আরও জমে ওঠে। মোহামেডানের হয়ে মাঠে নামেন শাহরিয়ার ইমন ও জাফর ইকবাল। সাদা-কালোরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এই অর্ধে হয়েছে চার গোল। ৫৭ মিনিটে মোহামেডান এক গোল শোধ দেয়। কামরুল ইসলামে লং বল থেকে আলমগীর মোল্লা হেডে ঠিকমতো ক্লিয়ার করতে পারেননি, বক্সের ভেতরে বল পেয়ে দিয়াবাতে সাইড ভলিতে লক্ষ্যভেদ করেন। ৬০ মিনিটে স্কোরলাইন ২-২। জাফর ইকবালের বাঁ প্রান্তের ক্রসে দিয়বাতের জোরালো হেড জড়িয়ে যায় জালে। ৬৫ মিনিটে সোহেল রানার ক্রসে এমেকার হেড ক্রস বারে লেগে প্রতিহত হয়। ৬৬ মিনিটে ফাহিমের জোরালো শট গোলকিপার সুজন ঠিকঠাক প্রতিহত করতে পারেননি, ৬ গজের দূরত্বে থেকে এমেকা দারুণ শটে জাল কাঁপান। ৮৩ মিনিটে দিয়াবাতে হ্যাটট্রিক করে দলকে সমতায় ফেরান। সতীর্থের কর্নারে তিনি লাফিয়ে উঠে লক্ষ্যভেদ করে সাদা-কালোদের প্রাণ নতুন করে ফিরিয়ে আনেন।

খেলোয়াড়ি জীবনে অসংখ্য শিরোপা জেতা স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদ এবার কোচ হিসেবে মোহামেডানকে ১০ বছর পর পাইয়ে দিলেন শিরোপার স্বাদ। আর এই শিরোপাই তার কাছে সেরা! অথচ প্রথমার্ধেই দুই গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছিল মোহামেডান। সেখানে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমতায় ফেরার ছয় মিনিট পর ফের পিছিয়ে পড়ে তারা। এরপর ঘুরে দাঁড়ায় আবারও। এমনকি অতিরিক্ত সময়ে লিডও পায়। সেই লিড ধরে রাখতে পারেনি। তাতে ম্যাচ গড়ায় টাই-ব্রেকারে। যেখানে মোহামেডানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন দলের দ্বিতীয় গোলরক্ষক আহসান হাবিব দিপু। ম্যাচ জুড়ে দুর্দান্ত সব সেভ দিয়ে দলকে ম্যাচে রাখা গোলরক্ষক হোসেন সুজন চোটে পড়ে মাঠ ছাড়েন কাঁদতে কাঁদতে। মূলত এসব কারণেই হয়তো এই ম্যাচ এগিয়ে রেখেছেন আলফাজ। এছাড়া এর আগে ফাইনালে আট গোল কখনোই দেখেনি দেশের ফুটবল। সেখানে আবার একাই একজন করেছেন চারটি গোল। তাও এমন একটা সময়ে যখন মোহামেডান পরিণত হয়েছে সাদামাটা একটি দলে। গত ১০ বছরে দেখেনি কোনো শিরোপার মুখ। ম্যাচ শেষে গতকালের ফাইনালকে সেরার স্বীকৃতি দিয়ে মোহামেডান কোচ আলফাজ বলেন, ‘খেলাটা মনে হয়েছে অনেক বড় কিছু অর্জন। ব্যাকফুটে থেকে ফিরে আসা, ম্যাচ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না ম্যাচ কে জিতবে। খেলোয়াড়দের কমিটম্যান্ট ছিল অসাধারণ। খেলোয়াড় হিসেবে আমি শিরোপা জিতেছি, এবার কোচ হিসেবে শিরোপা জিতলাম। আমি এ শিরোপাকেই এগিয়ে রাখব।’ আর এই জয়ে মোহামেডান হারানো সেই সকল দিন ফিরে পাবে বলেই বিশ্বাস করেন মোহামেডান কোচ, ‘প্রথমার্ধের খেলা শেষে শিষ্যদের বলেছি, তোমরা মাথা ঠান্ডা রেখে খেল। শেষ মুহূর্তে গোলরক্ষক বদল করার সিদ্ধান্তটা ছিল কঠিন। ইনজুরির কারণে এটা করতে হয়েছে। আমি মনে করি এ ট্রফির মাধ্যমে মোহামেডান এগিয়ে যাবে।’

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই জয়ের ঘ্রাণ উবে যাওয়ায় খেলোয়াড়দের কাঠগড়ায় তুললেন আবাহনী কোচ মারিও লেমোস। হেরে যাওয়ায় এএফসি কাপে খেলার সুযোগ নষ্ট হওয়ার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন পর্তুগিজ কোচ, ‘দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের শুরুটা ছিল খুবই ধীরগতির। নিবেদনের কমতি ছিল, তীব্রতা কম ছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধের ১৫ মিনিট। আমরা তাদের খেলায় ফেরার সুযোগ করে দিয়েছি। তারা সে-ই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। এমন ম্যাচে কোনো দল একবার এগিয়ে গেলে তখন সেখান থেকে জয় পাওয়া অনেক কঠিন। উত্থান-পতন ছিল, দুই দলেরই সমান সুযোগ ছিল। টাইব্রেকার ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে, ‘এই হারের দায়ভার আমিই নিচ্ছি। আমাদের এই ম্যাচে জয় পাওয়ার কথা ছিল। ট্রফি জেতার কথা ছিল। আমরা শিরোপা জয়ের জন্য যোগ্য দল ছিলাম। তবে আমরা পারিনি। এ দায় আমার। আমরাও ফাইনাল জয়ের কাছাকাছি ছিলাম। এটাই বাস্তবতা (আমরা হেরেছি)। অভিনন্দন মোহামেডান।’

মৌসুম জুড়েই চোটে ভুগেছেন রাফায়েল আগুস্তো দি সিলভা। তবে ব্রাজিলিয়ান এই মিডফিল্ডার ফাইনালে আলোও ছড়ালেন, আবার আঁধারেও ডুবলেন টাইব্রেকারে শট মিস করে। লেমোস মনে করেন, দিনটি তাদের ছিল না, ‘রাফায়েল পুরোপরি ফিট ছিল না। ছোটখাটো ইনজুরি তার ছিল। তবে সে আমাদের অধিনায়ক। তাই তাকে খেলানো হয়েছে। রাফায়েল তার সর্বোচ্চটা চেষ্টা করেছে। দিনটি আমাদের ছিল না। টাইব্রেকারে দুটি শট মিস হবে এটা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে ছিল। তবে এখানে গোলরক্ষককে কৃতিত্ব দিতে হয়। সে দারুণ সেভ করেছে।’

ফাইনালে মোহামেডান উড়েছে মূলত সুলেমানে দিয়াবাতের কাঁধে সওয়ার হয়ে। মালির এই ফরোয়ার্ড চার গোল করেন। টাইব্রেকারেও পান জালের দেখা। দিয়াবাতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন আবাহনী কোচ, ‘দিয়াবাতে খুবই ভালো খেলোয়াড়। পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে রয়েছে। সে সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। সে তার মান দেখিয়েছে। বড় ম্যাচে নিজের সক্ষমতা দেখিয়েছে।’