‘বর্তমান অবস্থান ধরে রাখলে একদিন সাফ জিতব আমরা’

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  কফিল উদ্দিন, রামু (কক্সবাজার) প্রতিনিধি

বঙ্গবন্ধু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন আনিসুর রহমান জিকো। বলা চলে দেশসেরা এই গোলরক্ষকের নৈপুণ্যে ১৪ বছর পর সাফের সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো সেমিফাইনালে লেবাননের কাছে ১-০ গোলের হারে ভেঙে যায় ফাইনালের স্বপ্ন। তবে পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি পেয়েছেন জিকো। সাফের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতেছেন তিনি। জিকো বলেছেন জাতীয় ফুটবল দলের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে পারলে একদিন সাফ জিতব আমরা। আলোকিত বাংলাদেশের সাথে একান্ত স্বাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। আনিছুর রহমান জিকো পর্যটন শহর কক্সবাজারের সর্ব উত্তরে অবস্থিত চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের সন্তান। তিনি ১৯৯৭ সালের ১০ আগস্ট কক্সবাজারে চকরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই তার শৈশব অতিবাহিত করেছেন। সম্প্রীতি জিকোর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলা প্রতিনিধি কফিল উদ্দিন।

আলোকিত বাংলাদেশ : আপনার ফুটবল খেলা কীভাবে শুরু হয়েছে, কীভাবে সম্ভব হলো ডুলাহাজারার মতো একটি ইউনিয়ন থেকে আজকের এই অবস্থান এবং কার মাধ্যমে আপনার খেলার সুচনা?

জিকো : আসলে আমি ছোটবেলায় বল খেলতাম এলাকায়। আমার বাবা আমাকে বল নিয়ে দিত ঠিকই কিন্তু বাহিরে খেলতে যাওয়ার অনুমতি দিত না। সেক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হতো, কিন্তু আমি আশাহত হয়নি, তখন এলাকায় খেলতাম, তবে তখন একটু শারীরিকভাবে অতিরিক্ত ওজন ছিল (মোটা) যার কারণে এলাকাতে বড় টুর্নামেন্ট হলে ওরা খেলাতে নিত না আমাকে তারা এক সাইডে বসায়ে রাখত। একদিন হঠাৎ গোলকিপার না থাকাতে আমাকে দলে সুযোগ দেয় তারা এবং আমি ভালো খেলি যেটা বড় ভাইদের চোখে পড়ে। এরপর থেকে আমাকে খেলাতে নিয়মিত গোলকিপার হিসেবে দলে রাখত। পরে ডুলাহাজারায় ২০০৭ সালে ফাইজা গোল্ডকাপ নামে একটি টুর্নামেন্ট চলে সেটাতেও আমরা ভালো খেলি বালুর চরা টিমের হয়ে। সেখানে কিছু সিনিয়র ভাই ঢাকাতে খেলতেন, তাদের নজরে পড়ে আমার খেলা এবং তারা আমাকে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে বলে। আসলে আমি মোটা ছিলাম তাই প্রফেশনাল খেলার ইচ্ছা ছিল না শুধু শরীর কমানোর উদ্দেশে খেলতাম। পরে অনূর্ধ্ব ১৬ কক্সবাজারে ট্রায়ালে গেছি সেখানে ভালো করি। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা টিমের একজন কোর্স ছিল তার রেফারেন্সে আমি ট্রেনিং করি ওখানে। সেখানেও ফ্যামিলি থেকে যাইতে বাধা দিত সব সময়, পরে রেফরি আলী হোসেন ভাই আমার আব্বুকে অনুরোধ করে অনেক বুজিয়ে আমাকে ট্রেনিংয়ে পাঠায়। ১ মাস ট্রেনিং নিয়ে আসি। একদিন আমাদের জমির ভাই আমাকে হঠাৎ কল দিয়ে ঢাকায় নিয়ে যায়। আমি সেখানে ট্রায়াল দিই এবং অফিসিয়ালদের নজরে আছি, তখন ২০১৪ সালে আমি ফরাজগঞ্জে সুযোগ পাই। এর আগেও চট্টগ্রাম মিজান ভাইয়ের মাধ্যমে খেলি কল্লোল সংঘ টিমে, সেখানেও দ্বিতীয় স্থান থেকে প্রথম স্থানে এ নিয়ে আসি টিমকে। এভাবে বসুন্ধরা কিংসে খেলি, তারপর জাতীয় দলে সুযোগ পাই। সেখানে কিছুদিন দলের বাইরে থাকি, হঠাৎ করে কিপারের অনুপস্থিতিতে দলে নিয়মিত হই, সেই থেকে আজ পর্যন্ত এবং আজকের এই অবস্থান।

আলোকিত বাংলাদেশ : আপনি বসুন্ধরা ক্লাবের তিনবারের চ্যাম্পিয়ন দলে কিপার, বলতে গেলে তাদের অটো চয়েস আপনি, অসাধারণ কিপারিংয়ের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা?

জিকো : আসলেই জীবনে কিছু করতে হলে অবশ্যই কঠিন কাজ করতে হবে, আমি অনেক কষ্ট করে এসেছি এ পর্যন্ত। আমি বিভিন্ন দেশের টপ গোল কিপারদের অনুসরণ করে তাদের খেলার ভিডিও দেখি এবং বেসিক কিছু মাথায় নিয়ে চেষ্ঠা করি ভালো কিছু করার। এবং আমার অনেক কোচিং স্টাফ আছে তারা আমাকে অনেক নির্দেশনা দেয় আমি সেগুলো ফলো করি। আমরা সব সময় বড় টিমের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি, সেক্ষেত্রে আমার টিমের বাকি সদস্যরা আমাকে সাহায্য করে এবং আমিও নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি এবং সবাইকে খেলার সময় চাঙা রাখার চেষ্টা করি।

আলোকিত বাংলাদেশ : বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল টিমে নিজের শ্রেষ্টত্ব দেখিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ১৪ বছর পর সেমিফাইনালে নিয়েছেন, যদিও ফাইনাল খেলতে পারেন নি, যদি ফাইনাল খেলতে পারতেন তখন কী পরিস্থিতি কেমন হতো বলে আপনি মনে করেন?

জিকো : আসলে আমি দীর্ঘদিন ধরে টিমের সাথে আছি, তবে ২/৩ বছর টিমের সাথে থাকলেও খেলিনি। ২০২০ সালে নেপালের বিপক্ষে আমার অভিষেক হয়, এরপর কাতার বিশ্বকাপের আগে কাতারের সাথে বড় ম্যাচ খেলি, এরপর থেকে আমার পরিচয়। আমরা অনেক আগে থেকে চেষ্টা করছি দলকে গুছিঁয়ে ভালো কিছু করার। আসতে আসতে আমরা সফলতার দিকে যাচ্ছি, বর্তমানে আমাদের এই অবস্থান ধরে রাখলে পারলে সাফ জয়ী হব এবং র‌্যাংকিংয়ের দিক দিয়ে আগাব। আমরা যদি এ বছর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতাম তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারতকে পেতাম। তখন আমাদের জন্য ভালো হতো। তারা র‌্যাংকিংয়ের দিক দিয়ে যতই এগিয়ে থাকুক না কেন, আমাদের সাথে খেললে দুর্বল হয়ে যায়। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের সাথে যেরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আমাদের সাথে (ভারত, বাংলাদেশ) একই রকম হয়।

আলোকিত বাংলাদেশ : আপনি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা গোলকিপার হলেন এবং আপনাকে বাংলার বাজ পাখি বলে দেশের মানুষ, এতে আপনার অনুভূতি কেমন?

জিকো : আসলে বাজপাখিটা ভালোবাসার নাম, ব্রাজিল যারা সার্পোট করে তারা এলিসন বেকারকে ডাকে এবং আর্জেন্টিনা সার্পোট করে তারা মার্টিনেজকে বাজপাখি ডাকে?

জিকো : বাংলাদেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে বাজপাখি বলে ডাকে। আসলে যখন ভালোবেসে যখন একটি নতুন নাম দেয় এবং ডাকে তখন অনেক ভালো লাগে। বর্তমানে মানুষ যেভাবে আমাকে সার্পোট দিচ্ছে সেটি সামনে পেলে আমি আরো ভালো করব ইনশাআল্লাহ।

আলোকিত বাংলাদেশ : আপনার নিজ জেলা কক্সবাজার থেকে বাংলাদেশ ফুটবল অঙ্গনে দারুণ নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন আপনারা দুইজন, উত্তর প্রান্তের উপজেলার সন্তান আনিসুর রহমান জিকু এবং দক্ষিণ প্রান্তের সন্তান বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে শাহেদা আকতার রিপা, সম্প্রীতি সে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে তার অনুপ্রেরণায় আপনি কী বলবেন?

জিকো : আসলেই আমি দেখেছি তার (শাহেদা আকতার রিপা) ভেতরে অনেক প্রতিভা আছে, একসাথে তিন চারজনকে কাটিয়ে বল নেওয়া তার পক্ষে কোনো ব্যাপারই না, সে যদি ফিনিশিং নিয়ে কাজ করে তাহলে বাংলাদেশের সেরা স্কোরার বা ভালো একজন খেলোয়াড় হতে পারবে, তার জন্য আমার পরামর্শ থাকবে ফিনিশিং নিয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে।

আলোকিত বাংলাদেশ : আপনার নিজ জেলার ফুটবলকে এগিয়ে নিতে আপনার এই অর্জন অতটুকু কাজ দিবে বলে আপনি মনে করেন বা দেশের ফুটবলকে আরো এগিয়ে নিতে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না?

জিকো : দেখেন যারা আমার এই অর্জনটুকু পজেটিভ দিকে নিবে আসলেই এটি তাদের জন্য ভাল কিছু, আমাদের গ্রামের সমস্যা হচ্ছে ছোট বেলায় ছেলে মেয়েদের বাবা মা বা পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন সার্পোট দেয় না, তারা শুধু লেখাপড়া লেখাপড়া নিয়ে পড়ে থাকে, বর্তমান সমাজে অনেক মাস্টার্স পাশ ছেলেমেয়ে বেকার রয়েছে, লেখাপড়ার পাশাপাশি যদি খেলাধুলাকে গুরত্ব দেয়া হয় তাহলে জীবনের জন্য অনেক ভালো দিক, কারন একটি পেশা নিয়ে কখনো চলতে পারবে না, মানুষের জীবনে বিনোদন দরকার, না হয় খারাপ পথের দিকে পা দিতে পারে, সেক্ষেত্রে বলব পরিবার যদি ছোট বেলায় ছেলেবেলায় ছেলেমেয়েদের সার্পোট দেয়, তাহলে সেটি ক্রীড়ার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

আলোকিত বাংলাদেশ : বাফুফে থেকে আপনাদের জন্য ঘোষিত আর্থিক পুরস্কার কি আপনারা পেয়েছেন কি না?

জিকো : জি পেয়েছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা এই পুরস্কার গ্রহণ করেছি।

আলোকিত বাংলাদেশ : নতুন উদীয়মান ফুটবলারদের বা এলাকার মানুষদের জন্য আপনার কোনো ম্যাসেজ বা পরামর্শ থাকলে জানাবেন?

জিকো : আসলে দেখেন কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম বলেন আমাদের এদিকের মানুষ স্বাবলম্বী, তাদের উচিত ক্রীড়ার পেছনে কিছু সার্পোট দেয়া, সেক্ষেত্রে হবে কি তাদের প্রতিষ্ঠানেরও প্রচার হবে এবং ছেলেমেয়েরা সাপোর্ট পাবে এবং খেলাধুলার উন্নতি হবে, ইতিমধ্যে আমি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহ উদ্দিন ভাইকে ফিফা উইন্ডো ম্যাচ চট্টগ্রামে পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেছি, মাঠ রেডি হলে তিনি খেলার চালাবেন- এমন প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে উঠতি বয়সে আমরা ফুটবল খেলতে চাই, ছোট থেকে খেলি না, যেটি আমাদের সমস্যা, আমরা যদি ছোট থেকে খেলি সেক্ষেত্রে ফুটবলের জ্ঞান মাথায় নিতে সহজ হবে। সবার প্রতি সেই অনুরোধটা থাকবে এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ফুটবল অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।

আলোকিত বাংলাদেশ : বিশ্বের কোনো খেলোয়াড় আপনার পেনাল্টি নিলে বেশি খুশি হবেন?

জিকো : আর্জেন্টাইন ক্যাপ্টেইন লিওনেল মেসি এবং রোনালদোর পেলান্টি। তাদের দুজনইর পেনাল্টি পেলে ভালো লাগবে।

আলোকিত বাংলাদেশ : আপনি বিয়ের পিঁড়িতে কবে বসছেন বা আপনার কোনো মেয়ে বন্ধু আছে কি না?

জিকো : ইনশাআল্লাহ হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে যাবে, মেয়ে বন্ধু বলতে যেটি ছিল, আসলে ওর বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগে।

আলোকিত বাংলাদেশ : ধন্যবাদ আনিছুর রহমান জিকো আমাদের আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।

জিকো : আলোকিত বাংলাদেশের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।