প্রতিবন্ধী ইয়ামিনের বিশ্বজয়ের গল্প

‘এনায়েত স্যার না থাকলে চায়ের দোকানেই পড়ে থাকতে হতো’

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া প্রতিবেদক

ইয়ামিন হোসেনের উচ্চতা খুব বেশি নয়। মাত্র সাড়ে ৩ থেকে ৪ ফুট। তবে শারীরিক এ অক্ষমতা, স্বল্প-উচ্চতা তার মনের জোরে এতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেনি। সমস্ত প্রতিকূলতা আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে তরতর করে শুধু সামনে এগিয়ে চলেছেন প্যারা ব্যাডমিন্টন এ খেলোয়াড়। সামান্য চা দোকানি ইয়ামিন আজ বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সদ্যসমাপ্ত ফক্সেস ইন্দোনেশিয়া ইন্টারন্যাশনাল প্যারা ব্যাডমিন্টন আসরে দলগত ইভেন্ট থেকে ব্রোঞ্জপদক জিতেছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জ এলাকার ১৯ বছর বয়সি ইয়ামিন। কুয়েতের প্রতিযোগী আব্দুল্লাহকে সঙ্গী করে এ পদক জেতেন তিনি। তবে ইয়ামিন হোসেনের এমন সাফল্যের নেপথ্যের নায়ক এক সময়ের কোর্ট কাঁপানো শাটলার, জাতীয় কোচ এনায়েত উল্ল্যা খান। এনায়েতের হাত ধরেই বিশ্বমঞ্চে পা রাখার সুযোগ পেয়েছেন বিশেষ ক্রীড়াবিদ বাংলাদেশের প্যারা শাটলার ইয়ামিন। সবাই সাফল্য চায়, সফলদের খোঁজ করে, সফলতার গল্পকে মানুষের সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু এ সাফল্য আর সফলতার পেছনের গল্প, নেপথ্যের কারিগরদের খোঁজ কেউ রাখেন না। আজ থেকে বছর সাতেক আগে ইয়ামিনের একমাত্র পরিচয় ছিল চা দোকানি। চিটাগং রোডে এখনো চা বিক্রি করেই জীবন ধারণ করছেন। বাবা, মা, ভাই-বোনদের নিয়ে কোনোমতে দামের বাজারে টিকে আছেন। তবে চা দোকানির পাশে একজন শাটলারের তকমাও এরই মধ্যে গায়ে জড়িয়েছেন। প্যারা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে নাম লিখিয়ে জাপান, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন। এই কাজে তাকে বছরের পর বছর ধরে সহযোগিতা করে চলেছেন এনায়েত উল্ল্যা খান। কোচ হিসেবে নিয়মিত ট্রেনিং তো দিচ্ছেনই, সেই সঙ্গে একজন গাইড, বন্ধু-ফিলোসোফার হয়ে ইয়ামিনকে সঠিক পথে রেখেছেন এনায়েত। কিভাবে খেলার জগতে এলেন চা দোকানি ইয়ামিন সেই গল্প শুনুন তার মুখেই, ‘২০১৮ সালের কথা।

আমাদের এলাকার এক সাংবাদিক বড় ভাই আমার দোকানে চা খেতে এসে বলেন তুমি তো চা বিক্রির পাশাপাশি অন্য কিছু করতে পারো। সাংবাদিক ভাইকে বললাম আমার খেলাধুলা করতে খুব মন চায়। তখন ওই সাংবাদিক ভাই আমাকে এনায়েত স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। স্যার আমাকে দেখেই বলেন তুমি ব্যাডমিন্টন খেলবা। আমি রাজি হই। এরপর প্যারা ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে আমার পথচলা শুরু হয়।

এনায়েত স্যার ট্রেনিং শুরু করেন। কিন্তু কাজ ফেলে আমি সব সময় ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে পারতাম না। তখন স্যার আমাকে নানানভাবে সহযোগিতা করতে থাকেন। গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে খাবার খরচ; মাঝেমধ্যে সংসার খরচের টাকাও দিয়েছেন। এখনো দেন। এভাবেই চলতে থাকে আমার ট্রেনিং।’ ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন ইয়ামিন। সেখানে ভালো ফল করেন। এরপর করোনার থাবায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েন। জীবন বাঁচাতে খেলা ছেড়ে পুনরায় চা বিক্রির পেশায় মনোনিবেশ করেন। তবে চায়ের দোকান থেকে আবারো ব্যাডমিন্টনের কোর্টে ইয়ামিনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন সেই এনায়েত উল্ল্যা খান। করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়া মাত্রই নারায়ণগঞ্জ থেকে ইয়ামিনকে প্রথমে পল্টনের কোর্টে পরে সেখান থেকে নিয়ে যান জাপানে আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপ খেলাতে। ২০২২ সালের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণ করেন ইয়ামিন। কেমন ছিল তার সেই অভিজ্ঞতা। এ ব্যাপারে ইয়ামিন বলেন, ‘জাপানে সবাই আমাকে দারুণভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। এই সফর আমার অসম্পূর্ণ জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। এনায়েত স্যার আমাকে এত বড় সম্মানের আসনে বসিয়েছেন যা আমার কল্পনাতেও ছিল না।’ জাপান সফরের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জাতীয় টুর্নামেন্টের পাশাপাশি বাইরের টুর্নামেন্টগুলোতেও নিয়মিত এনায়েত উল্ল্যার সহযোগিতায় অংশ নিয়েছেন ইয়ামিন। বিদেশ ভ্রমণে নিশ্চয়ই নানা রকম বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছিল ইংরেজি না জানা ইয়ামিনকে। এ ব্যাপারে ইয়ামিনের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘আমি জাপানের পর দুবার বাহরাইন আর সবশেষ ইন্দোনেশিয়াতে গিয়েছি। সব জায়গাতেই কম-বেশি বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছে। আমি তো হ্যালো, হায়, বাই- এই তিন ইংরেজি শব্দ ছাড়া আর কিছুই জানি না। যখনই ঝামেলায় পড়েছি এনায়েত স্যার সব সামলে নিয়েছেন। একবার বাহরাইন বিমানবন্দরে কাগজ সংক্রান্ত জটিলতার মুখেও পড়তে হয়েছে। সেখানেও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন আমার এনায়েত স্যার। এনায়েত স্যারের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা শেষ নেই। স্যার না থাকলে আজ এতদূর আসতে পারতাম না।’ এত বাধাবিঘেœর পরও খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়ামিন। দেশের জন্য আন্তর্জাতিক পদক এনেছেন।

এখন সরকারের কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কি না- এমন প্রশ্নে ইয়ামিন বলেন, ‘আমি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। বর্তমান সরকার এবং আমাদের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী স্যার দুস্থ, অসহায়, অসচ্ছ্বল কোচ, খেলোয়াড়, সংগঠকদের জন্য অনেক কাজ করছেন। সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। আমিও চাই সরকার, মাননীয় ক্রীড়ামন্ত্রী মহোদয় আমাকে সহযোগিতা করুন। আমি একটা ভালোমানের দোকান চাই। সেটা চায়ের দোকান হোক সমস্যা নেই। আমি কাজ করে খেতে চাই। পাশাপাশি খেলাটাও চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’ প্যারা শাটলার ইয়ামিনের আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং এখন ৪১তম। সামনে এশিয়ান প্যারা গেমস রয়েছে। আগামী ২২ থেকে ২৮ অক্টোবর চীনের হ্যাংঝু শহরে অনুষ্ঠিত হবে এই আসর। সেখানে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে ইয়ামিনের। দেশের জন্য আরো একবার পদক জিততে চান। কোচ এনায়েত উল্ল্যা খানও গেমস সামনে রেখে ট্রেনিং শুরু করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় দেশসেরা কোচ এনায়েতের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘এশিয়ান প্যারা গেমসে ইয়ামিন ছাড়াও শাহরিয়ার নামে আরো একজন শাটলার অংশ নিবেন। এশিয়ান গেমস অনেক বড় মঞ্চ। এখানে সুস্থ খেলোয়দের পদক জেতাই কঠিন। সেখানে আমাদের স্বল্প সুবিধার ভেতর বিশেষ ক্রীড়াবিদদের পদক জয় করা আনা আরো কঠিন।

তবে কাজ যত কঠিনই হোক সেটা করার আনন্দ আমার কাছে সব সময়ই অন্যরকম। আমি চেষ্টা করব এশিয়ান প্যারা গেমস থেকে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনার।’ কথায় কথায় এনায়েত উল্ল্যা খানের কাছে প্রশ্ন ছিল ইয়ামিনের সঙ্গে কি শুধু গুরু-শিষ্য সম্পর্ক না সম্পর্কটা তার চেয়ে গভীর। এমন প্রশ্নে কোচ বলেন, ‘আমার ঔরসজাত দুই সন্তান মেয়ে আরশি খান আর ছেলে আরশ খান।

কিন্তু এর বাইরেও আমার সন্তানের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। আমি একজন ব্যাডমিন্টন কোচ, প্যারা ব্যাডমিন্টনের সাধারণ সম্পাদক। যেসব ছেলে-মেয়েরা আমার কাছে বছরের পর বছর ট্রেনিং নিচ্ছে তারা কিন্তু আমার সন্তানতুল্য। ইয়ামিনকে আমি সন্তানস্নেহেই এতদূর নিয়ে এসেছি। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে অনেকগুলো টুর্নামেন্টে তাকে খেলিয়েছি। তবে এটা বড় কথা নয়। আমি কাজ করতে ভালোবাসি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মহোদয় জাহিদ আহসান রাসেল স্যার সব সময়ই দেশের খেলাধুলাকে এগিয়ে নিতে, বিশেষ ক্রীড়াবিদদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের দেখানো পথে আমিও টুকটাক কাজ করছি। সত্যি বলতে বিশেষ ক্রীড়াবিদদের নিয়ে কাজ করার আনন্দ ভাষায় প্রকাশের নয়। জাতীয় প্যারা অলিম্পিক কমিটি, বাংলাদেশ (এনপিসি, বাংলাদেশ)- এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদ স্যার, সালাম স্যার, আমিনুল স্যার, বিগ্রেডিয়ার স্যার, ভেলরি, পাপ্পু মোদক, বশির ভাই, মারুফ ভাইসহ সকলের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সবার কাছে দোয়া চাচ্ছি যেন ভবিষ্যতেও আমরা প্যারা ব্যাডমিন্টন থেকে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনতে পারি।’