মোনেম মুন্নাকে মনে রেখেছে ইস্ট বেঙ্গল

প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া প্রতিবেদক

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে মোনেম মুন্না এক নক্ষত্রের নাম। এই নক্ষত্রের আজ চলে যাওয়ার ১৯ বছর পূর্ণ হলো। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ও ঢাকা আবাহনীর সাবেক তারকা ফুটবলার মোনেম মুন্না পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ইস্ট বেঙ্গলে মুন্নাকে স্মরণ করেছে তার সাবেক ক্লাব ভারতের ঐতিহ্যবাহী ইস্ট বেঙ্গল। দুপুরের পর ইস্ট বেঙ্গল তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে মুন্নাকে স্মরণ করেছে। ইস্ট বেঙ্গলের জার্সিতে মুন্নার প্রতিকৃতি ছবির মধ্যে লেখা ‘মনে মুন্না’। এর মাধ্যমে ইস্ট বেঙ্গল বোঝাতে চেয়েছে মুন্নাকে তারা এখনো স্মরণ রেখেছে। ছবির ক্যাপশনে মুন্নার ইস্ট বেঙ্গলের কীর্তি তুলে ধরেছে তারা। ইস্ট বেঙ্গলে তিন মৌসুমের (১৯৯১-৯৪) ট্রফি জয়ের অন্যতম নায়ক বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক যে ভক্তদের অত্যন্ত প্রিয় এবং কিং ব্যাক হিসেবে খ্যাত সেটাও উল্লেখ করেছে। ইস্ট বেঙ্গলকে এই স্মরণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে মুন্নার প্রধান ক্লাব ঢাকা আবাহনীও। ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় মুন্নার। তার অধীনায়কত্বে প্রথমবার কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছে জাতীয় ফুটবল দল। মিয়ানমারে আয়োজিত সেই চার জাতি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কোচ ছিলেন জার্মানির বিশ্বখ্যাত অটো ফিস্টার। মুন্না সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘সে হয়তো ভুলবশত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে।’

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি লিগ দাপিয়ে বেড়ানো সেই কৃতি ফুটবলারের নাম মোনেম মুন্না। আজ তিনি শুধুই স্মৃতি, দূর আকাশে জ্বল জ্বল করা তারা। মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশ নন, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা ফুটবলার। ক্যারিয়ারের মাঝামাঝিতে খেলেছেন কলকাতার ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলের হয়েও। কাঁটা তারের ওপারের মানুষগুলোর কাছেও মুন্নার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। সাধারণত ফুটবল ম্যাচে ফরোয়ার্ড কিংবা উইঙ্গারের দিকে পাখির চোখ করে রাখেন সমর্থকরা। সেই তুলনায় নিচের পজিশনে যারা খেলেন তাদের দিকে খুব একটা আলো আসে না। মাঝমাঠের তুলনায় একটু আঁধারেই থাকেন তারা। তবে মুন্নার বেলায় মুদ্রার উল্টাপিঠ। রক্ষণভাগে খেলেও সমস্ত আলো নিজের দিকে কেড়েছেন এক মুন্না। দলের নেতৃত্ব আর দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব দেখিয়ে তিনি বাংলাদেশ ফুটবলে রীতিমতো ‘কিংবদন্তি’ বনে গিয়েছিলেন। সালটা ১৯৮১। এ বছর ঢাকার মাঠে অভিষেক হয় মুন্নার। সেবার পাইওনিয়ার লিগে গুলশান ক্লাবের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। এরপর শান্তিনগরের জার্সিতে খেলেছেন দ্বিতীয় বিভাগ। পরের বছরই চুক্তিবদ্ধ হন মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাথে। ওই বছরই চ্যাম্পিয়ন শিরোপা ঘরে তোলে মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮৬ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নে যোগ দেন মোনেম মুন্না। পেশাদার ফুটবল লিগে মাঠ মাতিয়ে জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়েন তিনি। এই বছরই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলেন ডিফেন্স পজিশনে খেলা এ ফুটবলার। মাত্র ১৮ বছর বয়সে সিউল এশিয়ান গেমসে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান মুন্না। এরপর দু-একটি ম্যাচ বাদ দিলে টানা ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত লাল-সবুজের জার্সিতে খেলেছেন এই ডিফেন্ডার। ব্রাদার্সের বছর খানেক খেলার পর ১৯৮৭ সালে আবাহনীতে পাড়ি দেন মুন্না। সেই থেকে ক্লাব ফুটবলের বাকি সময়টা কাটান আকাশী-নীল শিবিরে। ১৯৯১ মৌসুমের দলবদলে মুন্না আবাহনীতে খেলেছিলেন সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পারিশ্রমিকে। ক্লাবটির হয়ে ক্যারিয়ারে পাঁচবার ঢাকা লিগ এবং তিনবার ফেডারেশন কাপের শিরোপা জেতেন তিনি। এর মাঝে ১৯৯১-৯২ সালে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গলের হয়েও মাতিয়ে আসেন পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে মুন্না প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বেই ১৯৯৫ সালে মিয়ানমার থেকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জিতে ঘরে ফেরে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যা প্রথম সাফল্য। তার অধিনায়কত্বেই ১৯৯৫ সাফ গেমসে বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়েছিল। ১৯৯৭ এর ৩১ মার্চ মুন্না ৩০ বছর বয়সে দেশের পক্ষে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন মুন্না। সৌদি আরবের জেদ্দায় প্রিন্স আবদুল্লাহ আল ফয়সাল স্টেডিয়ামে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল মালয়েশিয়া। মাঠের ফুটবল থেকে অবসর নিলেও সর্বদা ছিলেন ফুটবলের সাথেই। এরপর কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত হন তিনি। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩১ বছর, অতিমাত্রায় অসুস্থতা তাকে অবসর নিতে বাধ্য করেছিল। বাংলাদেশে সেই সময় মোনেম মুন্নাকে ছাড়া জাতীয় দল হোক বা আবাহনী ক্লাবের একাদশ কল্পনাই করা যেত না। এমনকি প্রচণ্ড জর এবং ব্যথা নিয়েও খেলতে হয়েছে তাকে। একই ম্যাচে দুইবার ইনজেকশন নিয়ে খেলেছেন এমন ঘটনাও আছে। কিন্তু ওই জর শুধুই জর ছিল না সেটা বুঝতে সময় লেগেছে। আসতে আসতে কিডনিটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সেটাই বুঝতে পারেননি মুন্না। ফলে অকালেই দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে হারিয়ে ফেলতে হয়েছিল। তার মৃত্যুর তিন বছর পর ধানমন্ডির ৮ নম্বর সেতুটির নাম ‘মোনেম মুন্না সেতু’ নামকরণ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’- এজন্যই হয়তো এখনো ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে ‘কিংব্যাক’ মুন্নার কথা। স্মৃতিতে আছেন, থাকবেন রয়ে যাবেন লাল-সুবজের অতন্দ্র প্রহরী মুন্না।