ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রানী হামিদ থেকে দাবার ‘রানি’

রানী হামিদ থেকে দাবার ‘রানি’

দাবার জন্যই যেন তার জন্ম। দাবাই তার ধ্যান, দাবাই জীবন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার। রানী হামিদের পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন ডাক নাম রানী। বিয়ের পর তিনি স্বামীর নাম যুক্ত করে রানী হামিদ হন। ক্রীড়াজগতে তিনি রানী হামিদ নামেই পরিচিত। বাংলাদেশ দাবার রানি বলতে তাকেই বোঝানো হয়। ক্যারিয়ারে রানী হামিদের অনেক অর্জন। টানা ছয়বার জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল রেকর্ড গড়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টারের খেতাব অর্জন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম নারী দাবাড়ু হিসেবে রানী হামিদ পেয়েছিলেন এই খেতাব। তিনি তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। রানী হামিদ পেশাদারি দাবা খেলা শুরু করেন বিয়ের পরে। তার স্বামী প্রয়াত কর্নেল আবদুল হামিদ ছিলেন দেশের স্বনামধন্য ক্রীড়া সংগঠক। ছেলে কায়সার হামিদ জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার। অন্য দুই ছেলের মধ্যে সোহেল হামিদ খেলতেন স্কোয়াশ এবং শাহজাহান হামিদ ববি খেলতে হ্যান্ডবল। এককথায় ক্রীড়া পরিবারের সদস্য তিনি। দাবার রানীর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিচরণ দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে। দাবার বোর্ডের সঙ্গে রানী হামিদের সখ্যতা ১৯৭৭ সাল থেকে। বিগত ৪৭ বছরেও সে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। তিনিই এখন দেশের সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়। রানী হামিদরা যখন খেলাধুলা শুরু করেছিলেন, তখন আর এখনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখেছেন দেশের বর্ষীয়ান এই ক্রীড়াবিদ। বিশেষ করে অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন, প্রতিবন্ধকতা, খেলোয়াড়দের আর্থিক স্বচ্ছলতা, মেয়েদের নিরাপদ পরিবেশ সর্বোপরি সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। সব দিক দিয়ে বিবেচনায় ওই সময়ের সঙ্গে এখনকার কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। রানী হামিদ বলেন, ‘আমি খেলাধুলা করি স্কুল জীবন থেকে। ১৯৫৫ সালে আমি তখন কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আমার দৌড় দেখে স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক বলেছিলেন পাকিস্তান অলিম্পিকে পাঠাবেন। তবে করাচিতে যাওয়া লাগবে বলে বাবা রাজি হননি। ছেলে হলে হয়তো ওই সময় বাবা আমাকে যেতে দিতেন। মেয়ে হওয়ার কারণে ওই প্রতিবন্ধকতায় পড়েছিলাম। এখন সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যদিও অভিভাবকরা পুরোপুরি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন না। দাবায় অনেক মেয়েরা খেলে। দেখি মায়েরা বসে থাকেন। অভিভাবকরা মেয়েদের পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবেন সে অবস্থা এখনো আসেনি।’ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এখনও মেয়েদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে মেয়েদের হয়রানি হওয়ার খবর আসে। এ বিষয়ে রানী হামিদ বলেন, ‘আসলে ছোটোখাটো দুর্ঘটনা সবদেশেই হয়। আবার কেবল ক্রীড়াঙ্গনেই নয়, সব সেক্টরেই হয়ে থাকে। আমি মনে করি, নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটাই নিজের ওপর নির্ভর করে। নিজে সচেতন থাকলে বিপদ কম হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে। উদাহরণ হিসেব বলব- একজন নারী ক্রীড়াবিদ যদি অহেতুক বিলম্ব করে ঘরে ফেরে এবং পথে সন্ধ্যা নেমে আসে তাহলে তার বিপদে পড়ার শঙ্কা থাকতে পারে। এ সব বিষয়ে নিজেকে সচেতন রাখতে হবে।’ সচেতনতার পাশাপশি নালীর শালীনতা ও আচার আচরণের প্রতি জোর দিয়েছে এই জীবন্ত কিংবদন্তি দাবাড়ু। ‘আরেকটি বিষয় হলো শালীনতা। একজন মেয়ের শালীনতার ওপরও নির্ভর করে তার সমস্যায় পড়ার শঙ্কা কতটুকু। আমি ৫০ বছর ধরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আছি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন নারীর চলাফেরা, আচার-আচরণের ওপর নির্ভর করে সে নিজে কতটা নিরাপদ থাকতে চায়। আরেকটি বিষয় হলো শৃঙ্খলা ও পারিবারিক শিক্ষা। আমার নিজের কথা বলি, খেলাধুলা শেষ করে সময়মতো বাসায় ফিরতে সব সময় নির্দেশ থাকত বাবা-মায়ের। বাসায় ঢোকার পরই আমাদের লেখাপড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হতো। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষাও মেয়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ এখন খেলাধুলায় মেয়েরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পায় উল্লেখ করে বর্ষীয়ান এই ক্রীড়াবিদ বলেন, ‘দাবার কথাই বলি, আমরা তখন একটা বই পড়ার সুযোগও পেতাম না। এখন কত ধরনের প্রযুক্তি। আমাদের সময় তো এত সুযোগ ছিল না। এখন মেয়েরা সফলতাও আনছে। এই যেমন ফুটবলে আমাদের মেয়েরা ভালো করছে। অনেক ট্রফি এনেছে। ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলাতেও এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা।’ ‘খেলাধুলার মাধ্যমে মেয়েরা উপার্জন করে। এখানে আমি পুরো কৃতিত্ব দেবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনে যে যখন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সফলতা এনেছে তাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার দুই ছেলের অসুস্থতায় তিনি আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। আমি আমার ছেলেরা খেলোয়াড় বলেই কিন্তু এই সম্মান পেয়েছি। খেলোয়াড় না হলে এই সম্মান পেতাম না।’ বাংলাদেশের যে কয়জন নারী তাদের কৃতিত্ব ও কর্ম দিয়ে দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন- রানী হামিদ তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে তার নাম চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত