প্রশ্নবিদ্ধ আম্পায়ারিং

জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে হারল বাংলাদেশ

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া প্রতিবেদক

খানিকটা নড়বড়ে অবস্থানে থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নবম আসরে পা রেখেছিলেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। দুশ্চিন্তার কারণ ছিল ধারাবাহিক ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি ‘টপ অর্ডার’। তবে শঙ্কা উড়িয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় দিয়েই বিশ্বকাপে যাত্রা শুরু করেন টাইগাররা। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদে । যাদের সঙ্গে টি-টোয়েন্টিতে কখনো জয় পায়নি সাকিব-লিটনরা। আগের আটবারের দেখায় হেরেছে সবকটিতে। অবশেষে ইতিহাস গড়ার সুযোগ এসেছিল বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে। প্রোটিয়াদের স্বল্প রানে আটকে লক্ষ্য পুরণের কাজটা সহজ করে দিয়েছিল টাইগার বোলাররা। ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে নেমেও ব্যর্থ হয় লিটন, শান্ত আর সাকিব আল হাসানের মত টপ ব্যাটাররা। তবে তাওহিদ হৃদয় ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের জুটিতে বাংলাদেশের জয় সহজই মনে হচ্ছিল। অনেকটা পথ আগলে রেখে হৃদয় আউট হলে ফের চাপে পড়ে দল। ম্যাচ জিততে শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১১ রানের। মাহমুদউল্লাহ যেন জয়ের স্বপ্নই দেখাচ্ছিলেন। প্রথম দুই বলে ৪ রান আসায় শেষ চার বলে প্রয়োজন হয় ৭ রানের। তবে তৃতীয় বলে জাকের আলী আউট হলে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। চতুর্থ বলে লেগ বাই থেকে এক রান এলে শেষ দুই বলে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৬ রানের। কেশভ মহারাজের ফুল টস লং অন দিয়ে মারলেন মাহমুদউল্লাহ। মনে হচ্ছিল, সীমানা পার হয়ে যাবে বল। কিন্তু না! দড়ির ঠিক আগে লাফিয়ে দারুণ ক্যাচ নিলেন এইডেন মারক্রাম। একইসঙ্গে যেন নিশ্চিত করে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জয়। শেষ বলে আরেকটি ফুল টস পেলেন তাসকিন আহমেদ। তিনিও পারলেন না বাউন্ডারি হাঁকাতে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ের খুব কাছে গিয়েও তীব্র আক্ষেপে পুড়তে হলো বাংলাদেশকে। টি-টোয়েন্টি সংস্করণে নয়বারের দেখায় প্রোটিয়াদের বিপক্ষে জয় অধরাই রয়ে গেল টাইগারদের। গতকাল সোমবার নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ‘ডি’ গ্রুপের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ৬ উইকেটে ১১৩ রানের জবাবে বাংলাদেশ করতে পারে ৭ উইকেটে ১০৯ রান।

এই হার যেন কোনোভাবে মেনে নিতে পারেননি তাওহীদ। বিমর্ষ হয়ে বিজ্ঞাপন বোর্ডে মাথা এলিয়ে মুখ লুকাচ্ছিলেন। তাওহীদের মতো গোটা গ্যালারিও এমন পরাজয়ে স্তব্ধ। খুব কাছে গিয়ে এমন হারে সমর্থকদের হৃদয় ছারখার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পূর্ণাঙ্গ ম্যাচে এর চেয়ে কম রান করে জেতার নজির নেই আর। এর আগে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা ১১৯ রান করে নিউ জিল্যান্ডকে এবং চলতি আসরেই ভারত ১১৯ রান করে পাকিস্তানকে হারায়। বৈশ্বিক এই টুর্নামেন্টে এ নিয়ে চারবার ৫ বা তার কম রানে জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বের আর কোনো দল দুইবারের বেশি গড়তে পারেনি এই কীর্তি। অথচ রান তাড়ায় ১৫ ওভার শেষেও ভালো অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ৬ উইকেট হাতে রেখে ৩০ বলে করতে হতো ৩১ রান। সেখান থেকে পেসারদের দারুণ বোলিংয়ে ঘুরে দাঁড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা।

শেষ ওভারে মহারাজের জন্য ১১ রান রাখেন তিন পেসার আনরিক নরকিয়া, কাগিসো রাবাদা ও ওটনিয়েল বার্টম্যান। প্রথম বলে ওয়াইড দিলেও কোনো বাউন্ডারি হজম না করে মাত্র ৬ রান দেন মহারাজ। তিনটি ফুল টস পেয়েও ছক্কা মারতে পারেননি জাকের আলি, মাহমুদউল্লাহ ও তাসকিন। মুখোমুখি লড়াইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সবচেয়ে কম রানে থামিয়ে রান তাড়ায় শুরুটা তেমন মন্দ ছিল না বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ওভারে তানজিদ হাসান ফিরলেও পাওয়ার প্লেতে আর কোনো উইকেট হারায়নি তারা। নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন কুমার দাসের সাবধানী ব্যাটিংয়ে প্রথম ৬ ওভারে আসে ২৯ রান।

সপ্তম ওভারে আক্রমণে এসেই লিটনকে ফেরান মহারাজ। ইনসাইড আউট করে বড় শটের খোঁজে কাভারে মিলারের হাতে ক্যাচ দেন ১৩ বলে ৯ রান করা লিটন। এরপর টিকতে পারেননি সাকিব আল হাসানও। নরকিয়ার বাউন্সার পুল করতে গিয়ে শর্ট মিড উইকেটে ধরা পড়েন তিনি। বোলিংয়ে মাত্র ১ ওভার করা সাকিব ব্যাট হাতে ৪ বলে করেন ৩ রান। দলীয় পঞ্চাশ ছুঁয়ে শান্তর উইকেটও হারায় বাংলাদেশ। নরকিয়ার আরেকটি বাউন্সার সাকিবের মতোই পুল করতে গিয়ে প্রায় একই জায়গায় একই ফিল্ডার মারক্রামের হাতে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। সংগ্রামী ইনিংসে তিনি ২৩ বলে করেন ১৪ রান। পঞ্চম উইকেটে চাপ সামাল দেন তাওহিদ হৃদয় ও মাহমুদউল্লাহ। আগের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলা হৃদয় এদিনও শুরু থেকেই রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে থাকেন। অন্য প্রান্তে মাহমুদউল্লাহও ভালো সঙ্গ দেন তাকে।

ভাগ্যের সহায়তাও অবশ্য পায় বাংলাদেশ। দ্বাদশ ওভারে নরকিয়ার বাউন্সারে স্লিপে ক্যাচ নিতে পারেননি মার্কো ইয়ানসেন, ৭ রানে বেঁচে যান মাহমুদউল্লাহ। দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা মহারাজকে ছক্কায় উড়িয়ে রানের চাপ সরান হৃদয়। পরের ওভারে ইয়ানসেনকে বাউন্ডারি মারেন তিনি। সপ্তদশ ওভারে বার্টমানের বলে মাহমুদউল্লাহকে এলবিডব্লিউ দেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে উইকেট বাঁচান অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। ওই বল তার প্যাডে লেগে চলে গিয়েছিল সীমানায়। কিন্তু আম্পায়ার আগেই আউট দেয়ায় লেগ বাই থেকে বাউন্ডারি যোগ হয়নি বাংলাদেশের স্কোরে। পরের ওভারে হৃদয়কে ফেরান রাবাদা। রিভিউ নিয়েও লাভ হয়নি। রিপ্লেতে দেখা যায়, লেগ স্টাম্পের বেলস ছুঁয়ে যেত বল। অর্থাৎ মাঠের আম্পায়ার ‘নট আউট’ দিলে বিপদ ঘটত না ২টি করে চার-ছক্কায় ৩৪ বলে ৩৭ রান করা হৃদয়ের।

এরপর শুধুই পেছাতে থাকা। সৌম্য সরকারের জায়গায় একাদশে সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ জাকের আলি। শেষ ওভারে ফেরার আগে ৯ বলে তিনি করেন ৮ রান। মারতে পারেননি কোনো বাউন্ডারি। মাহমুদউল্লাহ ২ চারে ২৭ বলে করেন ২০ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন মহারাজ। তবে মিতব্যয়ী বোলিংয়ে তাদের জয়ের পথটা গড়ে দেন মূলত পেসাররাই। এর আগে রৌদ্রজ্জ্বল সকালে টস হেরে শান্ত বলেছিলেন, তিনিও আগে বোলিংই নিতেন। বাংলাদেশ অধিনায়কের মন্তব্যের যথার্থ প্রমাণ করতে একদমই সময় নেননি পেসাররা। প্রথম ওভারে কুইন্টন ডি ককের কাছে একটি করে ছক্কা-চার হজম করলেও শেষ বলে অন্য ওপেনার রেজা হেনড্রিকসকে ফেরান তানজিম হাসান। নিজের পরের ওভারে আরেক ওপেনার ডি কককে বোল্ড করেন তানজিম। চতুর্থ ওভারে তিন নম্বরে নামা এইডেন মারক্রামের স্টাম্প ছত্রখান করেন তাসকিন আহমেদ। দক্ষিণ আফ্রিকার চাপ আরও বাড়িয়ে টানা তৃতীয় ওভারে সাফল্যের দেখা পান তানজিম। এবার ট্রিস্টান স্টাবসকে ফেরান তরুণ পেসার। মাত্র ২৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন যেন অকূল পাথারে প্রোটিয়ারা।

বিপর্যয় সামাল দিতে রীতিমতো টেস্ট মেজাজে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে মোস্তাফিজের করা পাওয়ার প্লের শেষ ওভারটি খেলেন মিলার ও হাইনরিখ ক্লসেন। প্রথম ৬ ওভারে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ২৫ রান। এরপর ধীরে ধীরে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন দুই মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান। মিলার খোলসে ঢুকে গেলেও সুযোগ পেলেই বাউন্ডারি মারতে থাকেন ক্লসেন। দশম ওভারে রিশাদ হোসেনের বলে পরপর দুটি ছক্কা মারেন প্রোটিয়া কিপার-ব্যাটসম্যান। পঞ্চাশ পেরিয়ে যায় তাদের দলীয় স্কোর। পরের ওভারে মাহমুদউল্লাহর বলে মিলারের ক্যাচ ছেড়ে দেন লিটন। ১৩ রানে বেঁচে যান বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। এরপর আর ভুল করেননি তিনি। দেখেশুনে খেলে ক্লসেনের সঙ্গে এগিয়ে নেন দলের ইনিংস। সপ্তদশ ওভারে একশ পূর্ণ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর ৭৯ রানের জুটি ভাঙেন তাসকিন। বড় শটের খোঁজে বোল্ড হন ২ চার ও ৩ ছক্কায় ৪৪ বলে ৪৬ রান করা ক্লসেন। পরের ওভারে মিলারকে বোল্ড করেন রিশাদ। একটি করে চার-ছক্কায় মিলার খেলেন ৩৮ বলে ২৯ রানের ইনিংস। দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ের পর শেষ দিকে আর প্রত্যাশামতো রান নিতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৮ রানে ৩ উইকেট নেন তানজিম। ১৯ রানে ২ শিকার ধরেন তাসকিন। উইকেট না পেলেও স্রেফ ১৮ রান খরচ করেন মুস্তাফিজ। কিন্তু, আরও একবার দিনশেষে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় হতাশায় সঙ্গী বাংলাদেশের।

এই গ্রুপ থেকে ৩ ম্যাচে ৩ জয় নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে গেল সুপার এইটে। ২ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ ১টিতে জিতেছে, ১টিতে হেরেছে। বাংলাদেশের আশা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। শেষ ২ ম্যাচে নেদারল্যান্ডস ও নেপালের সঙ্গে জিতলে সহজেই বাংলাদেশ খুঁজে পাবে সুপার এইটের দরজা।