শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় চিরবিদায়

অন্তিম শয়নে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া

প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া প্রতিবেদক

দাবা ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান, নেশা-ভালোবাসা। তাই পঞ্চাশ বছরের জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে দাবার বোর্ডে। সেই সুবাদে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরোনো ভবনই হয়ে উঠেছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি। স্ত্রী আর একমাত্র ছেলের হাত ধরে বহুবার এসেছেন এই ভবনে। গতকাল শনিবার সকালেও এলেন। তবে নিথর দেহে। আগের দিন (শুক্রবার) সন্ধ্যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অনন্তকালের পথে পাড়ি জমান দেশের দ্বিতীয় এই গ্র্যান্ডমাস্টার। চিরচেনা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অনুষ্ঠিত হয় তার জানাজা। দেশের অন্যতম কিংবদন্তী এই দাবাড়ুর জানাজায় অংশ নেন শত শত ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক। সব খেলা মিলিয়ে দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদকে শেষ শ্রদ্ধাতে জানাতে এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেই। জিয়ার জানাজায় এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম অভিভাবক বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা। বিওএ এবং তিনি নিজ থেকেও জিয়ার পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। শাহেদ রেজার কথায়, ‘জিয়া শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব দাবা অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন আর্থিক ব্যাপারে তার পরিবাররে পাশে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও জিয়ার পরিবারের জন্য আর্থিক বা অন্য যে কোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসব।’ দাবা ফেডারেশনের অন্যতম সহ-সভাপতি তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী (নাজমুল হাসান পাপন) জিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন। এখন আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের আরেকজন অভিভাবক শাহেদ ভাই (বিওএ মহাসচিব) তার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। একটি বড় আর্থিক অংক স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) করে পরিবারের একটি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দাবা ফেডারেশন ও আমরা ব্যক্তিগতভাবে নেব।’ দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম জিয়ার চলে যাওয়া দাবার অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবেই দেখছেন, ‘অনেকেই টুর্নামেন্টের পুরস্কার ও নানা সুযোগ সুবিধা কম হলে খেলতে চাইতেন না। জিয়া কখনোই এ রকম ছিলেন না। সব টুর্নামেন্টেই তিনি অংশগ্রহণ করতেন। যেন অন্যরা তার মাধ্যমে শিখতে পারে।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমাদের আলাদা একটি ফ্লোর পাওয়ার কথা ছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মধ্যেই। সেখানে গ্র্যান্ডমাস্টার কর্নারের পরিকল্পনা ছিল। সেটা যতদিন না হয়, আমরা বর্তমান ক্রীড়া কক্ষই জিয়ার নামকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও উন্নয়ন সেক্টরে চাকরি নেননি। দাবা খেলে ও কোচিং করেই পরিবার চালিয়েছেন। তার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য বিসিএস ক্যাডারে যোগদান করেননি স্বামীর দাবাপ্রেমের জন্যই। একমাত্র ছেলে তাহসিন তাজওয়ারও ফিদে মাস্টার। জিয়ার জানাজায় এসেছিলেন দেশের দুই সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব। রাজীবের সঙ্গে খেলতে খেলতেই জিয়া মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন। রাজীবের মাথায় এখনো ঘুরেফিরে সেই স্মৃতি, ‘২৫ চাল পর্যন্ত হয়েছিল খেলার। জিয়া ভাইয়ের পজিশন ভালোই ছিল। একবারের জন্যও মনে হয়নি সে অসুস্থ বা একটু অন্য রকম। তার একটি চাল মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম খুবই ভালো চাল ছিল।’ দেশের চতুর্থ গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব মায়ের মৃত্যুর পর দাবা অঙ্গন থেকে দূরেই ছিলেন। প্রায় দুই বছর পর আবার এই আঙিনায় এসেছিলেন অগ্রজ জিয়াকে শেষবারের মতো দেখতে। তার কথায়, ‘বাংলাদেশের সেরা দাবাড়ু জিয়া ভাই। তার শূন্যস্থান পূরণ করার মতো নয়। একজন অতি সুশৃঙ্খল খেলোয়াড় ছিলেন। সব সময় খেলা নিয়ে ভাবতেন। অলিম্পিয়াডে অনেক খেলেছি একসঙ্গে। দেখেছি প্রতিপক্ষ নিয়ে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।’ পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে জিয়া এবং রাজীবই কোচিং করান। কোচ জিয়াও খেলোয়াড় জিয়ার চেয়ে কম নন অকপটেই বললেন রাজীব, ‘তার বাসায় ভারত থেকে দাবাড়ুরা এসে খেলা শিখত। তার অনেক ছাত্র ভারতে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে আরো অনেক টাইটেল জিতেছে। কোচ হিসেবেও তিনি অনেক সফল।’ জিয়ার কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, দাবা ফেডারেশন, তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না করলেও জিয়ার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিকস, ব্যাডমিন্টন, সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও বিভিন্ন ফেডারেশনের খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনের নিচে জিয়ার লাশ আধ ঘন্টার একটু বেশি সময় ছিল। এরপর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় জিয়ার লাশবাহি অ্যাম্বুলেন্স। সেখানেই দাবাড়ু বাবা পয়গম আহমেদের পাশে অন্তিম শয়নে শায়িত হন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান।