কোপা আমেরিকা আর্জেন্টিনারই

মেসি-মারিয়াদের ‘ট্রেবল’ জয়ের উৎসব

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া ডেস্ক

রেকর্ড গড়ে ট্রেবল জয় না আক্ষেপ মোচন। ফাইনালের ক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই স্নায়ুচাপ আর উত্তেজনায় ফুসছিল ফুটবলপ্রেমীরা। সেই চাপ আরো বাড়ছিল যখন নির্ধারিত সময়েও খেলা শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছিল। কারণ, টিকিট না পাওয়া দর্শকরা ব্যারিকেড ভেঙে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েছিলেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা স্টেডিয়ামের গেট বন্ধ করে দেন। অবশেষে নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর শুরু হয় কোপা আমেরিকার ৪৮তম শিরোপা লড়াই। ট্রফি ধরে রাখতে শুরুতেই আক্রমণ শানায় আর্জেন্টিনা। পাল্টা আক্রমণে সমান তালে লড়াই করছিল কলম্বিয়া। গোল শূন্যতায় শেষ হয় প্রথমার্ধ। বিরতি শেষে শুরু হয় দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। এবার বাজে ট্র্যাকেলে চোটে পড়েন আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা লিওনেল মেসি। শেষমেষ মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। মেসি যখন মাঠ ছাড়ছিলেন তখন গ্যালারিতে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। টানা দ্বিতয়বার এবং উরুগুয়ের রেকর্ড ভাঙতে এই মহাতারকার উপর ভরসা করেছিলেন সমর্থকরা। সেই মেসি তো তখন মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না মেসিও। মাঠ ছেড়ে ডাগআউটে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তবে মনোবল হারায়নি আর্জেন্টিনা। দেশের হয়ে বিদায়ী ম্যাচে নিজেকে উজাড় করে দিলেন আনহেল দি মারিয়া। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে শেষ হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা। ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। দলের মধ্যে চাঙ্গা ভাব ফেরাতে ১০৫ মিনিটের মাথায় একসঙ্গে তিনটি পরিবর্তন আনেন কোচ স্কালোনি। আলভারেজের জায়গায় বদলি হিসেবে নামান লাউতারো মার্টিনেজকে। সাত মিনিট পরই আরেকবার নিজেকে প্রমাণ করে দলকে উল্লাসে ভাসান লাউতারো। আরেক বদলি খেলোয়াড় জিওভান্নি লো সেলসোর পাস পেয়ে নিখুঁত ফিনিশিংয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন তিনি। তার কল্যাণেই কোপা আমেরিকার শিরোপা অক্ষুনè রাখল আর্জেন্টিনা। গতকাল সোমবার মায়ামির হার্ডরক স্টেডিয়ামে এবারের আসরের স্নায়ুক্ষয়ী ফাইনালে ১-০ গোলে কলম্বিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা। ম্যাচের ১১২তম মিনিটে জয়সূচক গোলটি আসে লাউতারোর পা থেকে।

দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ ফুটবল আসরে আর্জেন্টিনার এটি টানা দ্বিতীয় ও রেকর্ড ১৬তম শিরোপা। ১৫ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া উরুগুয়েকে টপকে তারা উঠে গেল এককভাবে শীর্ষে। স্পেনের পর দ্বিতীয় এবং প্রথম লাতিন দল হিসেবে টানা তিনটি মেজর টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো আলবিসেলেস্তেরা। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার আগের বছর কোপা জিতেছিল দলটি। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি এদিন পুরোটা সময় থাকতে পারেননি মাঠে। পায়ের চোট নিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় মাঠ ছেড়ে যেতে হয় তাকে। তার অনুপস্থিতিতেও ঘাবড়ে যাননি সতীর্থরা। তাই আর্জেন্টিনার জার্সিতে শেষ ম্যাচ খেলতে নামা আনহেল দি মারিয়ার বিদায়টা হয়ে থাকল স্মরণীয়। ১১৭তম মিনিটে বদলি হওয়ার আগে দারুণ উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। এই হার দিয়ে থামল নিজেদের ইতিহাসে কলম্বিয়ার টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। ম্যাচের প্রথম মিনিটেই আক্রমণে ওঠে আর্জেন্টিনা। ডানপ্রান্ত থেকে গঞ্জালো মন্তিয়েল ক্রস করেন ডি-বক্সে। তবে বলে-পায়ে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ ঘটাতে পারেননি হুলিয়ান আলভারেজ। তার শট হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট। আর্জেন্টিনার উজ্জ্বল শুরু মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। কলম্বিয়া দ্রুতই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে একের পর আক্রমণ শানিয়ে সুযোগ তৈরি করতে থাকে। পঞ্চম মিনিটে প্রথমবারের মতো কোনো শট থাকে লক্ষ্যে। তবে ডি-বক্সের বাইরে থেকে লুইস দিয়াজের দুর্বল শট সহজেই লুফে নেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। দুই মিনিট পর ভাগ্যের ফেরে গোল পায়নি কলম্বিয়ানরা। সান্তিয়াগো আরিয়াসের পাসে ডি-বক্সের ভেতর থেকে জন কর্দোবার শট জালে প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিল। কিন্তু পোস্টে লেগে বল বাইরে চলে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আর্জেন্টিনা। বিরতির আগে বাকি সময়েও আর্জেন্টিনার ধীরগতির ফুটবলের বিপরীতে কলম্বিয়া দেখায় দাপট। তবে নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হওয়ার আগে তারা গোলমুখে আরও ছয়টি শট নিলেও বল রাখতে পারেনি লক্ষ্যে। বিপরীতে, আর্জেন্টিনার নেওয়া চারটি শটের দুটি ছিল লক্ষ্য। দ্বিতীয়ার্ধের তৃতীয় মিনিটেই দারুণ একটি সুযোগ তৈরি করে কলম্বিয়া। ডি-বক্সের ডানদিকে ফাঁকায় বল পেয়ে যান সান্তিয়াগো। তবে দূরের পোস্টে তার মারা শট ম্যাচের স্কোরলাইনে বদল ঘটাতে পারেনি। পরের মিনিটে দি মারিয়ার প্রচেষ্টা বিফল হয় ভারগাসের নৈপুণ্যে। ৬৪তম মিনিটে বড় ধাক্কা খায় আর্জেন্টিনা। দৌড়ানোর সময় পিছলে পড়ে যান মেসি। ব্যথা পান ডান পায়ের ঊরুতে। কোপার শুরুর দিকেও চিলির বিপক্ষে একই জায়গায় চোট পেয়েছিলেন তিনি। তীব্র ব্যথায় কাতর মেসির পক্ষে আর খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে বদলি হিসেবে মাঠ ছাড়ার পর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তিনি। অঝোর ধারার কাঁদতে থাকেন বেঞ্চে বসে। তার জায়গায় নামেন নিকোলাস গঞ্জালেজ। ৭৯তম মিনিটে কুয়েস্তার হেড লক্ষ্য খুঁজে পায়নি। এর কিছুক্ষণ আগে নিকোলাস জাল খুঁজে নিলে উল্লাসে মাতে আর্জেন্টিনা। কিন্তু তাদের উল্লাস স্থায়ী হয়নি একটুও। সহকারী রেফারি উঁচিয়ে ধরেন অফসাইডের পতাকা। যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে নিকোলাসে শট চলে যায় ক্রসবারের ওপর দিয়ে। অতিরিক্ত সময়ে জমাট রক্ষণে কলম্বিয়ার আক্রমণ রুখে আর্জেন্টিনাই বারবার হানা দিতে থাকে। অপেক্ষার পালা ঘুচিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসে মাত্র আট মিনিট বাকি থাকতে। এবারের কোপার সর্বোচ্চ গোলদাতা লাউতারো করেন নিজের পঞ্চম গোল। প্রবল আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায় স্টেডিয়ামে উপস্থিত সব আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় থেকে ভক্ত। শেষ বাঁশি বাজার পর সেই উল্লাস হলো আরো জোরালো।