জলে স্থলে বর্ণিল আয়োজন

ইতিহাস গড়ল প্যারিস অলিম্পিকস

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া ডেস্ক

শতবর্ষ পর প্রেমের নগরে ফিরছে অলিম্পিক গেমস। বছরব্যাপী প্রস্তুতি শেষে মহাযজ্ঞের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত প্যারিস। কিন্তু হঠাৎ রেলওয়ে নেটওয়ার্কে চালানো হয়েছে হামলা, করা হয়েছে অগ্নিসংযোগ। এতে উদ্বোধনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বিপাকে পড়ে আয়োজকরা। তবে তড়িৎ পদক্ষেপে শেষ অবধি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রেমের শহর প্যারিসের আইকনিক সিন নদীর তীরে বণিল আয়োজনে পর্দা উঠেছে ‘দি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত বিশ্বের সবচেয়ে জৌলুশপূর্ণ ক্রীড়া উৎসবের। ইতিহাস গড়া উদ্বোধনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা উঠল ৩৩তম অলিম্পিক গেমসের। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। চার ঘন্টার অনুষ্ঠানে লাখো ক্রীড়াপ্রেমী ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। নজরকাড়া নৌ প্যারেডের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানের। এই প্রথম স্টেডিয়ামের বাইরে হলো অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। যা এক বিরল ইতিহাস বটে। সিন নদীর দুই পাড়ের সংযোগ সেতুতে ওড়ানো হলো তিন রংয়ে ধোয়া। ১০১ অ্যাথলেট নিয়ে গ্রিস দলের অ্যাথলেটদের নৌকায় করে আসা দিয়ে মার্চ পাস্টের শুরু। একে একে আসতে থাকে দলগুলো। বড় নৌযানগুলোয় একই সাথে একাধিক দলের অ্যাথলেটরা সওয়ার হন। ৮৫টি নৌকায় আসেন সব দেশের অ্যাথলেটরা। নৌযানগুলো যাওয়ার সময় পাশেই পানির ফোয়ারাগুলো একসঙ্গে সক্রিয় হলে অন্যরকম কুয়াশাচ্ছন্ন আবহ তৈরি হয়। হালকা বৃষ্টি প্যারিস অলিম্পিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এনে দেয় জাদুকরী মাদকতাও। এরই মধ্যে লেডি গাগা নদী তীরে সাজানো মঞ্চে গাইতে আসেন দল নিয়ে। একটু পরই দেখা যায় বাংলাদেশ দলকে বহনকারী নৌকা। লাল-সবুজের পতাকা এবার বহন করছেন সরাসরি প্যারিস অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা আর্চার মোহাম্মদ সাগর ইসলাম। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পাঁচজন অ্যাথলেট অংশ নিচ্ছে প্যারিস অলিম্পিকসে। ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ পাওয়া দুই সাঁতারু সামিউল ইসলাম রাফি, সোনিয়া খাতুনের সঙ্গে আছেন শুটার রবিউল ইসলাম ও স্প্রিন্টার ইমরানুর রহমান।

নদীর পাড়ে সমর্থকদের সরব উপস্থিতি, তীরবর্তী বাড়িগুলোর ব?্যালকনিতে, জানালায় দাঁড়িয়ে ক্রীড়াপ্রেমীরা উপভোগ করেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সংযোগ সেতুর উপর তৈরি করা হয় গ্যালারি, সেখানেও ছিলেন দর্শকরা। হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে রাখেন তারা অনুষ্ঠান। নদীর পাড়ে কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, নাচের দল নৃত্য পরিবেশন করছে, কেউ নানা শারীরিক কসরত দেখাচ্ছে, কুচতাওয়াজও চলছে। নদীর মধ্যেই বড় বড় বোর্ডে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা মানুষের মুখচ্ছবি।

সেতুর উপর সাজানো মঞ্চে চলতে থাকে ফ্যাশন শো, গান। মার্চ পাস্টের একেবারে শেষে আসে স্বাগতিক ফ্রান্সের অ্যাথলেটদের বহনকারী ইয়াট। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নদীর পাড়ে জ্বলে থাকা আলোতে অন্যরকম আবহ চারদিকে। সংযোগ সেতুতে সাজানো লাইটিং ছড়াতে থাকে মুগ্ধতা। ফরাসি সমর্থকদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা বইতে থাকে। বর্ণিল সন্ধ্যার মুগ্ধতা ভিন্ন মাত্রা পায় নদীর মধ্যে সাজানো ভাসমান মঞ্চে জন লেননের ‘ইমাজিন’ গানের মূর্ছনায়। বৈশ্বিক সাম্যের যে গান আর অলিম্পিকসের বার্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পিয়ানোর সুরে। অলিম্পিকের পতাকা পিঠে মুড়িয়ে ‘কৃত্রিম’ ঘোড়ায় চেপে ছুটতে থাকতে দেখা যায় এক অশ্বারোহীকে, তার হাতে অবশ্য ছিল না মশাল। পুরানো দিনের অলিম্পিকের সংবাদ, নানা মুহূর্তের তথ্যচিত্র ভেসে ওঠে পর্দায়। অশ্বারোহী ছুটতে থাকেন। সবগুলো দেশের পতাকা নিয়ে আইফেল টাওয়ারের নিচে সমবেত হতে থাকেন প্রতিনিধিরা। এরপর সত্যিকারের ঘোড়ায় চেপে টাওয়ারের নিচ দিয়ে আগমন সেই অশ্বারোহীর। অলিম্পিকের পতাকা তিনি বয়ে নিয়ে তুলে দেন কর্মকর্তাদের হাতে। পতাকা ওড়ানোর সময় বেজে ওঠে অলিম্পিকের সঙ্গীত।

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মূল মশাল প্রজ্জ্বলনের। কিন্তু কে জ্বালাবেন? এখানে রহস্য রেখেছিল আয়োজকরা, যেমনটা ছিল লেডি গাগার উপস্থিতি নিয়েও। আয়োজক কমিটির সভাপতি, তিনবারের ক্যানন সেøলুমের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন টনি এস্টাঙ্গুয়ে অ্যাথলেটদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এটা ভালোবাসার শহর। এবং আগামী ১৬টি দিন, এই শহর আপনাদের।’ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি টমাস বাখ তার বার্তায় তুলে ধরেন অলিম্পিকসের উদ্দেশ্য, ‘এই আয়োজন বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করে।’ এরপর মঞ্চে আসেন বিশ্বকাপ জয়ী কিংবদন্তি ফুটবলার জিনেদিন জিদান। মুখোশ পরা সেই রহস্যময় মানবের মঞ্চে আগমণ মশাল হাতে; তুলে দেন জিদানকে। ‘জিজুর’ হাত থেকে মশাল যায় ফ্রেঞ্চ ওপেনের রেকর্ড ১৪ বারের চ্যাম্পিয়ন ও রোঁলা গাঁরোর ‘সম্রাট’ স্প্যানিশ তারকা রাফায়েল নাদালের হাতে। আইফেল টাওয়ার দিয়ে ছুটতে থাকে আলোর রোশনাই।

আরেক টেনিস কিংবদন্তি সেরেনা উইলিয়ামসের হাতে মশাল তুলে দিয়ে তার সঙ্গে স্পিডবোটে চেপে বসেন নাদাল। সেখানে তাদের সঙ্গী হন দুই গ্রেট অ্যাথলেট কার্ল লুইস ও জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমিনেচি। চার কিংবদন্তি মিলে মশাল নিয়ে পরিভ্রমণের পর নোঙর ফেলেন এক পাড়ে।

সেখানে নিজের হাতে থাকা মশাল জ্বালিয়ে ছুটতে থাকেন ফরাসি সাবেক টেনিস তারকা এমিলি মরিসমো। টনি পারকারের পর আরও কয়েক হাত ঘুরে মশাল যায় জুডোকা টেডি রাইনার ও স্প্রিন্টার মারিয়ে-জোসে পিয়ার্সের হাতে। ল্যুভর, প্যালেস দে লা কনকর্ডের লাগোয়া বেলুনে আগুন দেন দুজনে। আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা ওঠে প্যারিস অলিম্পিকসের। সকালে রেলের নেটওয়ার্কে হামলায় যে শঙ্কা উঁকি দিয়েছিল, সন্ধ্যোয় তা উড়ে যায় ভিন্নধর্মী, মন জুড়ানো জমকালো উদ্বোধনীতে। প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছে ২০৬টি দেশ। ৩২টি খেলার ৩২৯টি ইভেন্টে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামবেন ১০ হাজার ৫০০ জন অ্যাথলেট। মাঠের লড়াই শুরুর আগে সিন নদীতে বর্ণিল নৌকায় চড়ে ব্যতিক্রমী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অংশ হলেন প্যারিস অলিম্পিকে আগত অ্যাথলিট ও কর্মকর্তারা।