ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের হয়ে স্বপ্ন বুনছেন অনিক

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের হয়ে স্বপ্ন বুনছেন অনিক

কদিন আগেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচিং স্টাফে ফেরানো হয়েছে রিচার্ড স্টইনিয়ারকে। অন্যান্য কোচদের মতো পরের বিশ্বকাপের দল সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনিও। গত সোমবার বিসিবির একাডেমি মাঠে কিপিং অনুশীলন করাচ্ছিলেন ফিজিক্যাল পারফরম্যান্স নিয়ে কাজ করা স্টইনিয়ার। হাসি-আনন্দে নিজের কাজটা করতে পারার বেশ চেনা-জানা ইংলিশ এই কোচ। দূর থেকে অনুশীলন দেখলে তার দিকে চোখ না দিয়ে উপায় নেই একদমই। সেদিনও একেবারে ভিন্ন কিছু ঘটেনি। তবে স্টইনিয়ারের পাশাপাশি চোখ আটকে গেছে আরো একজনের দিকে। লিকলিকে গড়নের তরুণ উচ্চতায় বেশ খানিকটা লম্বা। দূর থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিলে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে ডাক পাওয়া এই যুবার উচ্চতা ছয় ফুট ছাড়িয়ে যাবে। শান্ত ও চুপচাপ প্রকৃতির এই তরুণকে আলাদা করতে পারার আরো বড় একটা কারণ মুখের অবয়ব। সাধারণ অন্য ৮-১০ জন বাঙালি ছেলেরা যেমন হয়ে থাকেন ঠিক তার উল্টোটা দেখা গেল। মুখের অবয়ব দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল প্রায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার তরুণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের একজন প্রতিনিধি। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করা পেস বোলারের নাম অনিক দেব বর্মণ। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার কালিগুচিয়া গ্রামের ছেলে অনিক। ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠা তরুণ এই পেসার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় পাড়ি জমান শ্রীমঙ্গলে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করাই প্রধান কাজ ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ৩০ জনের প্রাথমিক ট্রায়ালে ডাক পাওয়া অনিক। সেখানেই ক্রিকেটে বলে অনুশীলনের শুরু তার। শ্রীমঙ্গলের এক একাডেমিতে অনুশীলন করতে থাকা তরুণ এই পেসার মৌলভীবাজার জেলার অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলার জন্য ট্রায়াল দিয়েছিলেন। ট্রায়ালে টিকে গেলেও স্কোয়াডে সুযোগ মেলেনি তার। অনিকের কপাল খুলে ২০২১ সালের স্কুল ক্রিকেটে। সেবার মোলভীবাজারে স্কুল ক্রিকেট খেলেছিলেন। ভালো বোলিং করার পাশাপাশি উইকেটও পেয়েছিলেন তিনি। স্কুল ক্রিকেটে ভালো পারফরম্যান্সের পর শিক্ষকদের চাওয়ায় বয়সভিত্তিক ক্রিকেট নাম দেন লিকলিকে গড়নের এই তরুণ। মৌলভীবাজার জেলার সুযোগ না পেলেও অনিক খেলেছেন হবিগঞ্জ জেলার হয়ে। সবশেষ ইয়ুথ ক্রিকেট লিগেও খেলেছেন অনিক। পেস বোলিংয়ে ৪ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে এসেছেন বলেই তিনি সাংবাদিকদের নজর কাড়ছেন, বিষয়টি একেবারেই এমন নয়। শ্রীমঙ্গল থেকে উঠে আসা তরুণকে নিয়ে বেশ আশাবাদী কোচরাও। যুব দলের সঙ্গে কাজ করা ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স জানিয়েছেন, বেশ জোরে বল করতে পারেন এই পেসার। বেশ কয়েক বছর ধরে পেস বোলিং কোচ হিসেবে কাজ করা নাজমুল হোসেনের চিন্তাও একই রকম। আপাতত ভবিষ্যতের জন্য অনিককে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কোচরা। মিরপুরে অনিক যখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে তখন নিজের উঠে আসার গল্প শুনিয়েছেন গণমাধ্যমকে। নিজের বেড়ে ওঠার গল্প শুনিয়ে অনিক বলেন, ‘আমার নাম অনিক দেব বর্মণ। হবিগঞ্জ জেলা, বাহুবল থানা, কালিগুচিয়া গ্রাম। এখানে আমরা থাকি। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ভালো লাগত। টিভিতে দেখতাম। বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। ছোট থেকেই বোলিং করতাম, হাত ভেঙে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি শহরে চলে এলাম, খেলার জন্য, শ্রীমঙ্গলে। এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করতাম। একটা ছোটখাট একাডেমি ছিল। সেখানেই ক্রিকেট বলে অনুশীলন করতাম।’ ‘তারপর মৌলভীবাজার জেলায় অনূর্ধ্ব-১৬ ট্রায়াল দিলাম। স্কোয়াডে সুযোগ পাইনি। ট্রায়ালে টিকছি কিন্তু স্কোয়াডে সুযোগ পাইনি। ২০২১ সালে আবার মৌলভীবাজারে স্কুল ক্রিকেট খেলি। ভালো বোলিং করি, উইকেট পাই। তখন আমার স্যারেরা বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নাম দিতে বলেন। আমি নাম দিলাম। তারপর হবিগঞ্জ জেলার হয়ে খেলি। সেখানে ভালো খেলে বিভাগীয় দলে সুযোগ পাই। তারপর ইয়ুথ ক্রিকেট লিগে খেলি। মোটামুটি ভালো বোলিং করি। সব সময়ই আমি বোলিং করেছি।’ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা বাকি ৮-১০ ক্রিকেটারের জীবনের গল্পের সঙ্গে খানিকটা মিল আছে অনিকের। অন্য অনেকের মতোই পরিবারের না চাওয়ার পরও পালিয়ে গিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। কখনো কখনো ট্রাকের ব্যবসা করা বাবার হাতের মারও খেতে হয়েছে তাকে। তবে অনিকের জীবনের গতিপথ বদলে গেছে জেলা পর্যায়ে খেলার সুযোগ পেলে। এরপর থেকেই পরিবারের পুরো সমর্থন পেয়েছেন তিনি। অনিক বলেন, ‘আমার পরিবার তো শুরুতে কেউ সমর্থন দিত না। তখন আমি পালিয়ে খেলতাম। আমাকে মানুষ বাসা থেকে এসে নিয়ে যাইত। বাবা মানা করতেন। খেলে কী করব বলতেন। তবু আমি পালিয়ে খেলতাম। মারও খেতাম। আমি যখন জেলা পর্যায়ে খেলা শুরু করি, তখন থেকে তারা বলছেন যে, পাশে আছি। পরিবারের মোটামুটি সবাই সমর্থন করছে।’

এলাকায় ক্রিকেটের মাঠ না থাকায় ফুটবল মাঠেই খেলা শুরু করেছেন অনিক। তবে তরুণ এই পেসারের মনে ক্রিকেট প্রেমের জন্ম হয়েছে সাদা-কালো টিভিতে খেলা দেখে। তবে সেই সময়টা বেশিরভাগ সময়ই ভারতের খেলা দেখতেন তিনি। অনিক বলেন, ‘আমাদের বাসায় সাদা-কালো টিভি ছিল। ছোটবেলায় আমি সেখানে অনেক খেলা দেখতাম। বেশিরভাগ ভারতের খেলা দেখতাম। তখন আমি প্রায় সব ক্রিকেটারের নাম জানতাম। তখনই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার শুরু।’ ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা অনিকের পেস বোলিংয়ে আদর্শ বাংলাদেশের তাসকিন আহমেদ। এ ছাড়া পাকিস্তানের কিংবদন্তি পেসার শোয়েব আখতার এবং অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লিকেও নিজের আদর্শ মানেন তিনি। শ্রীমঙ্গল থেকে মিরপুরে পৌঁছানো আসা অনিকের স্বপ্ন লাল সবুজের জার্সি গায়ে জড়ানো। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মঞ্চটাকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুনছেন তরুণ এই পেসার। অনিক বলেন, ‘পেস বোলিংয়ে আমার আইডল বাংলাদেশের তাসকিন ভাই, পাকিস্তানের শোয়েব আখতার আর অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি।’ তিনি আরো যোগ করেন, ‘আমার স্বপ্ন, আমি এক দিন বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলব। এটাই স্বপ্ন। এখন যে মঞ্চটা পেয়েছি, মনে হচ্ছে সামনে এগোতে পারি।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত