ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চলে গেলেন হকির নিবেদিতপ্রাণ ‘ওস্তাদ ফজলু’

চলে গেলেন হকির নিবেদিতপ্রাণ ‘ওস্তাদ ফজলু’

খেলোয়াড় পরিচয় ছাপিয়ে দেশের হকি অঙ্গনে কোচ হিসেবেই সমাদৃত হয়েছেন। যে কারণে, পুরো নাম ফজলুল ইসলাম হলেও ‘ওস্তাদ ফজলু’ নামে সর্বাধিক পরিচিত তিনি। চোখে আঘাত পেয়ে খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে মনোযোগী হয়েছিলেন ফজলুল। পুরান ঢাকার আর্মানিটোলা স্কুলের মাঠে শিশু-কিশোরদের হকি শেখাতে শেখাতে সবার কাছে ‘ওস্তাদ’ উপাধি পান তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না তার। তাই আরমানিটোলা স্কুলেও যাওয়া হচ্ছিল না আর। তারপরও নিজের গড়া ‘ওস্তাদ ফজলু একাডেমি’র জন্য ট্র্যাকসুট দেয়ার অনুষ্ঠানে গত মঙ্গলবার অনেকটা জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু এটাই যে শিষ্যদের সঙ্গে তার শেষ দেখা হবে তা কে জানত! হকির নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি গতকাল বুধবার পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। ৫৭ বছরের সাবেক এই হকি খেলোয়াড় মৃত্যুকালে স্ত্রী ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে এদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নিজ বাসার বারান্দায় হঠাৎই পড়ে যান তিনি। তারপর নেয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

৮০’র দশকে সাবেক তারকা খেলোয়াড় ও কোচ আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার হাত ধরে হকি অঙ্গনে প্রবেশ ফজলুল ইসলামের। ঘরোয়া হকিতে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। ১৯৭৭ সালে যার শুরু। পিডব্লিউডি দিয়ে শুরু করে এরপর একে একে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, সাধারণ বীমা ক্রীড়া সংঘ, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ঊষা ক্রীড়া চক্র, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে খেলেছেন। এর মধ্যে প্রথম বিভাগে সাধারণ বীমার হয়ে শিরোপা জেতার রেকর্ড রয়েছে তার। ১৯৮৪ সালে মালয়েশিয়ায় জুনিয়র বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে অনুশীলনে ফজলুল আঘাত পান চোখে। এতে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়। জাতীয় দলে কখনো খেলার সুযোগ মেলেনি তার। ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া হকি খেলেন তিনি। খেলোয়াড় হিসেবে চূড়ায় পৌঁছাতে না পারা ফজলুল নেমে পড়েন খেলোয়াড় তৈরিতে।

কোচিংয়ে নেমে তৃণমূলে বেশি জোর দিয়েছেন। আরমানিটোলা স্কুলে স্থানীয়দের নিয়ে নিয়মিত কোচিং করিয়ে আসছেন। যার কারণে সবার কাছে ‘ওস্তাদ ফজলু’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার হাত ধরে হকিতে অসংখ্য খেলোয়াড় বেরিয়ে এসেছে। হাল আমলের রাসেল মাহমুদ জিমি, নাঈম উদ্দিন, মো. আরশাদ ও ইমরান হাসান তো আছেনই। এছাড়া জাতীয় দল ও যুব দলে নাম লিখিয়েছেন ২০ জনের মতো খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে সাবেক তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল, মাকসুদ আলম হাবুল ও আবদুস সাজ্জাদ অন্যতম। হকি নিয়ে তার মুগ্ধতা এমনই ছিল। পুরান ঢাকার বেগম বাজারে ৮ নম্বর নাবালক মিয়া লেনে তার বাড়ির ছাদটি একসময় অনুশীলনের জন্য ব্যবহার করতেও পিছপা হননি। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে হকি খেলা না থাকলেও ওস্তাদ ফজলুর একাডেমির চর্চা নিয়মিত ছিল। হকিতে অবদান রাখার জন্য তৃণমূল কোচ হিসেবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসপিএ) পুরস্কারও পেয়েছেন। হকিতে এমন নিবেদিত প্রাণ সদা হাস্যময়ী কোচকে হারিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পুরান ঢাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে হকির জন্য খেলোয়াড় তৈরি করে আনার কাজটি যে আর করার কেউ রইলো না! হকির আম্পায়ার সেলিম লাকি জানান, অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ দুঃশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন ওস্তাদ ফজলু। কিন্তু তার এভাবে চলে যাওয়াটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না কোনোভাবেই। ‘সকালে ওস্তাদের বাড়ি থেকে ফোন পেলাম। বলল, তিনি পড়ে গেছেন, বুকে ব্যথা পেয়েছেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এরপর দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখান থেকে তাকে ফেরানো যায়নি।’ সেলিম লাকি আরো বলেন, ‘গতকালও আমরা একসাথে বসেছিলাম। নানা বিষয়ে গল্প হলো। আসলে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিকসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি দুঃশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। পরিবার নিয়েও দুঃশ্চিন্তা করতেন। কয়েকদিন ধরে তিনি একটু চুপ ছিলেন, ডাক্তার দেখিয়েছিলেন, তারা ঠিকঠাক ঘুমাতে বলেছিলেন। আজ সকালে তিনি চিরঘুমে চলে গেলেন। মেনেই নিতে পারছি না।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত