সময়টা ভালো যাচ্ছে না বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। ভারত সফরের পর ঘরের মাঠেও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। তাই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিল নাজমুল হাসান শান্তরা। তাসকিন-মোস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিংয়ে সিরিজের প্রথম ওয়ানডে মাচে জয়ে সম্ভাবনাও জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আফগানদের দেয়া ২৩৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে ১৪৩ রানে অলআউট হয়েছে ফিল সিমন্সের শিষ্যরা। এমন লজ্জাজনক ব্যাটিং দেখে সবাই যেমন অবাক, ঠিক তেমনি শারজায় ৬ বছর পর ম্যাচ দেখতে এসে বিস্মিত সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের বিশেষ আমন্ত্রণে শারজায় বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের ওয়ানডে দেখতে এসে সেই হতাশাই ঝড়ল তার কণ্ঠে। খেলা দেখে চরম হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখেছেন, ‘ছয় বছর পর আজকে শারজাহতে আফগানিস্তান বোর্ডের আমন্ত্রণে গিয়ে মাঠে বসে বাংলাদেশ দলের ম্যাচ দেখলাম। জয়-পরাজয় তো থাকতেই পারে; কিন্তু অধিনায়কত্ব আর ব্যাটিং পরিকল্পনা দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। সবকিছুই যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল- শরীরী ভাষা, বলের প্রতি মনোযোগ, প্রি-বল রুটিন, পুরোটা মিলিয়ে পরিকল্পনা খুবই দুর্বল মনে হয়েছে। আশা করি আমরা খুব শিগগিরই এই অবস্থার উন্নতি করতে পারব।’ অথচ এই ম্যাচের শুরুটা ছিল দারুণ। ৩৫ রানে ৪ ও ৭১ রানে আফগানদের ৫ উইকেট ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই জায়গা থেকে মোহাম্মদ নবির ৮৪ ও হাসমতুল্লাহ শহিদির ৫২ রানে ভর করে ২৩৪ করে ফেলে সিরিজের ‘হোস্ট’ দল। রান তাড়ায় তানজিদ হাসান তামিম দ্রুত ফিরে গেলেও সৌম্য সরকার ও নাজমুল হোসেন শান্ত ভালোই এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলকে। তবে এই দুজনেই বিদায় নেন থিতু হয়ে। অনেক সময় নিয়ে থিতু হয়ে কাজ অসমাপ্ত রেখে উইকেট ছুঁড়ে দেন মিরাজও। বাকি প্রত্যেকেই ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। শারজার মাঠে তাই ছয় ওয়ানডে খেলে এখনো জয় অধরা রয়ে গেছে লাল সবুজের প্রতিনিধিদের। এদিন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিসিবি ও টেস্ট ক্রিকেট নিয়েও কথা বলেন বুলবুল।
তিনি বললেন, ‘এই নভেম্বরে ২৪ বছর হবে টেস্ট খেলার। ২৪ বছরে কিন্তু আমরা বেশি টেস্ট ম্যাচ জিতিনি। তবে বাংলাদেশ বেশ কিছু পারফর্ম্যান্স করেছে। আশরাফুল একটা ইন্টারভিউতে বলছিল যে আমাদের ১০০ জনের বেশি টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে গেছে। সেখানে যদি ৭০টা খেলোয়াড় থাকত তাহলে আমাদের খেলোয়াড় সংখ্যা কম থাকত। এজন্য বলছি যে খেলোয়াড়রা আরো বেশি সুযোগ পেত। আপনি যদি র্যাঙ্কিং দেখেন, টেস্ট চ্যাাম্পিয়নশিপের র্যাঙ্কিং বা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলো দেখেন, টেস্ট ম্যাচে অত ভালো করতে পারিনি।’ উন্নতি করতে হলে কী করতে হবে, সেই পরামর্শও দিলেন আমিনুল ইসলাম, ‘উন্নতি করতে না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমাদের যে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট আছে এখনও সেটা পিকনিকের মতো ক্রিকেট হয়। আমাদের দেখেন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট চলছে এখন, আমরা কয়জন জানি যে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট হচ্ছে। আমি খুব খুশি হতাম যদি আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটা ডে-নাইট করতে পরতাম। কয়দিন আগে বলেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটা যেন ডে নাইট হয়, যাতে আমরা দর্শক আকৃষ্ট করতে পারি। স্টেডিয়ামগুলো আমাদের নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করা উচিত। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের পারিশ্রমিকটা তিনগুণ করে দেওয়া উচিত। বিপিএল যেভাবে আমরা প্রচারণা করি তার কাছাকাছি যদি প্রচারণা করতে পারতাম তাহলে আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটা ভালো হতো। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ভালো হওয়া মানে অটোমেটিকভাবে টেস্ট ক্রিকেট ভালো হয়ে যাওয়া।’
পাশাপাশি খেলাটা ঢাকার বদলে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার পরামর্শও দিলেন আমিনুল ইসলাম, ‘আমাদের বড় যেটা সমস্যা যে, ক্রিকেটটা হচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রিক।
আমরা যদি সারা দেশে ক্রিকেটটা ছড়িয়ে দিতে পারতামণ্ডউপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ-সেখানে যদি আমরা মাল্টি ডে ক্রিকেট চালু করতে পারতাম তাহলে এই ২৪ বছরে আমাদের যে অবস্থান সেখান থেকে আমরা হয়তো অনেক বেটার জায়গায় থাকতে পারতাম।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা যখন বলি ১১ জন খেলে আসলে ১১ জন খেলে না- ১১ জন স্পেশালিস্ট প্লেয়ার খেলে। যেমন মাত্র দুজন ওপেনার খেলে, একজন নাম্বার থ্রি খেলে। এই জায়গাগুলোতে আসলে আমাদের স্পেশালিস্ট খেলোয়াড়দের অভাব। এক পর্যায়ে বলতাম যে পঞ্চপা-ব খেলছে আমাদের। ওমুক ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলছে। আমাদের যে তারকা প্রীতি বা একজনকে ফোকাস করা-(তখন) অন্যদের মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যে সেকেন্ড ক্লাশ সিটিজেন। ফোকাসটা হওয়া উচিত ছিল পারফর্ম্যান্সের ওপর। মানসম্পন্ন খেলোয়াড় আরও বেশি হতে পারত যদি আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটটা আরও প্রতিযোগিতামূলক হতো।’ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর বিসিবিতে পরিবর্তন এসেছে। নতুন বোর্ড প্রধান হয়েছেন ফারুক আহমেদ। এটাকে খুব বড় করে দেখছেন না আমিনুল ইসলাম, ‘এখন যে কারেন্ট বোর্ড আছে সেটা ধরেন কোন রকমে চলছে। ইনফ্যাক্ট কোন পরিবর্তন হয়নি। দুজন নতুন পরিচালক এসেছেন এনএসসির মাধ্যমে। তার মধ্যে একজন প্রেসিডেন্ট আরেকজন ফাহিম ভাই। আমি বলব এটা ইনকমপ্লিট ক্রিকেট বোর্ড। নতুন কিছুই ঘটেনি বা দেখতে পাচ্ছি না। সো ইটস নাথিং নিউ।’
বাংলাদেশে কোচ বদল হয় ঘনঘন। এটারও বিপক্ষে আমিনুল ইসলাম, ‘জাতীয় দলে যারা কোচ হয় তারা কিন্তু স্কিল শেখায় না, ট্যাকটিস শেখায় না। তারা কাজ করে মানসিক অবস্থা নিয়ে। এখানে ভাষা একটা বড় ব্যাপার, সংস্কৃতি একটা বড় ব্যাপার। আর যদি নতুন কোচ বারবার পরিবর্তন হতে থাকে এতে কোনো উপকার হয় না, অপকারই হয়।’ সিনিয়র সহকারী কোচ হিসেবে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নিয়োগে অবশ্য খুশি তিনি, ‘সালাউদ্দিন এর আগেও সহকারী কোচ ছিল। সালাউদ্দিনের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সে খুবই সফল কোচ। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, সে বাংলায় কথা বলে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি জানে। উপমহাদেশে কোচিংয়ের তিনটা ভাষা ব্যবহার করা যায়। একটা হচ্ছে তুই, একটা তুমি এবং একটা আপনি। সালাউদ্দিনের সাথে বেশিরভাগ ক্রিকেটারের সম্পর্ক হচ্ছে ‘তুই’। এটা একটা বড় সুবিধা, এটায় কাছের করে নেয়া যায়। সালাউদ্দিনের অভিজ্ঞতা, ওর মান প্লেয়ারদের সাইকোলজি বোঝা-সবমিলিয়ে সে দারুণ চয়েজ।’ যেভাবে ক্রিকেট চলছে, পরিবর্তন করতে না পারলে খেলাটা যে জনপ্রিয়তা হারাবে সেটাও স্মরণ করিয়ে দিলেন আমিনুল ইসলাম, ‘বাংলাদেশের ১৮০ মিলিয়ন মানুষই ক্রিকেট ভালোবাসে। এটা সারাজীবন থাকবে না যদি আমরা আমাদের ফেন বেজ ধরে রাখতে না পারি। আমাদের আরও বেশি সবাইকে সম্পৃক্ত করা উচিত। স্কুল ক্রিকেট বলেন, কলেজ ক্রিকেট বলেন, মেয়েদের ক্রিকেট বলেন। এই জায়গাগুলোতে আমার মনে হয়, তেমন কোনো কাজ আমরা করিনা। এভাবে যদি ১০ বছর চলতে থাকে, তাহলে হয়তো আরেকটা স্পোর্টস আমাদের জায়গা দখল করে নিবে।’