জাতীয় লিগের চতুর্থ রাউন্ড খেলে লাল বলের ক্রিকেটকে বিদায় বলার ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন ইমরুল কায়েস। খুলনা বিভাগের এই ব্যাটারকে মাঠে নামার সময় গার্ড অফ অনার দেয়া হয় কয়েক দফা। গতকাল সোমবার ম্যাচ শেষে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করেছেন ইমরুল। বাউন্ডারি লাইনে দলের ফটোসেশনে শামিল হন বোর্ডের কর্তা ও জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটাররা। এভাবেই বিদায় জানানো হলো বাংলাদেশের অন্যতম সফল এই ক্রিকেটারকে। এমন স্মরণীয় বিদায় এর আগে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার পাননি।
ম্যাচের প্রতিদিনই বাড়তি আকর্ষণ ছিল ইমরুলকে ঘিরে। গত শনিবার ম্যাচের প্রথম দিনে দীর্ঘ ১৭ বছরের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের জন্য তাকে বিশেষ স্মারক দেয় ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)। বিদায়ী সেই আয়োজনে ছিলেন তামিম ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুলও। মাঠে নামার সময় তিনি ‘গার্ড অব অনার’ পান সতীর্থদের কাছ থেকে। পরদিন সাদা পোশাকে শেষবারের মতো ব্যাটিংয়ে নামার সময় সতীর্থরা ব্যাট উঁচিয়ে ‘গার্ড অব অনার’ দেন তাকে। গতকাল সোমবার ম্যাচ শেষে দুই সতীর্থের কাঁধে চড়ে মাঠ ছাড়ার পর বিসিবির পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয় ইমরুলকে। ম্যাচ পরবর্তী আয়োজন শেষে মাঠের মধ্যে শুরু হয় সতীর্থ ক্রিকেটার, শুভাকাঙ্ক্ষীদের ছবি তোলার পালা। তার বিদায়ের মুহূর্তটিতে মাঠে এসে একসঙ্গে ফ্রেমবন্দি হন জাতীয় দলের দীর্ঘ দিনের সতীর্থ মাহমুদউল্লাহ।
নানা আয়োজনে বিদায়ী ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে থাকলেও ব্যাট হাতে শেষ ম্যাচে মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেননি ইমরুল। প্রথম ইনিংসে ৩ চারে ২৭ বলে ১৬ রান করেন তিনি। দ্বিতীয়বারে উইকেট থাকতে পারেন মাত্র তিন বল। রানের খাতা খুলেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ৩৭ বছর বয়সি ব্যাটসম্যান। শেষ ম্যাচের মতো এবারের লিগও খুব ভালো কাটেনি ইমরুলের। চার ম্যাচের সাত ইনিংসে ফিফটি একটি, ৩৮.৩৩ গড়ে তার সংগ্রহ ২৩০ রান।
সব মিলিয়ে ১৩৮ ম্যাচের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারও তেমন সমৃদ্ধ নয় তার। ৩৩.৫৩ গড়ে ৭ হাজার ৯৪৭ রান নিয়ে লাল বলের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ২৭টি ফিফটির পাশাপাশি তিন অঙ্কের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়েছেন তিনি ২০ বার। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের ফাইনালে দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে ১০ চার ও ৯ ছক্কায় ২০৪ রানের ইনিংস প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে ইমরুলের সেরা। এছাড়া ২০১৯ সালের জাতীয় লিগে খুলনার হয়ে ১৯ চার ও ৯ ছক্কায় ২০২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি। ২০০৮ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট অভিষেক হয় ইমরুলের। ২০১৯ সালের ভারত সফরে কলকাতা টেস্ট হয়ে থাকল তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। ৩৯ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৪ ফিফটি ও ৩ সেঞ্চুরিতে ২৪.৭৬ গড়ে ইমরুলের সংগ্রহ ১ হাজার ৭৯৭ রান।
এই পরিসংখ্যান যেমন বলছে, তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষটা আরও সাদামাটা। ক্যারিয়ারের প্রথম ১১ টেস্টে কোনো ফিফটি ছিল না তার। তখন ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১৩.১৮। প্রথম ফিফটির দেখা পেতে লেগে যায় ২৪ ইনিংস। খরা কাটে ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরে লর্ডসে ৭৫ রানের সেই ইনিংস খেলে। প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান ৩৩তম ইনিংসে, ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। টেস্ট ক্রিকেটে ইমরুলের সেরা ম্যাচ নিঃসন্দেহে ২০১৫ সালের খুলনা টেস্ট, পাকিস্তানের বিপক্ষে। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ফিফটির পর মুশফিকুর রহিমের চোটে ১২০ ওভার কিপিং করেন ইমরুল। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে তর্কযোগ্যভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা জুটি তিনি গড়েন তামিম ইকবালের সঙ্গে। ২৯৬ রানে পিছিয়ে থেকে ইনিংস হারের চোখরাঙানি এড়িয়ে তামিমের সঙ্গে ৩১২ রানের জুটি গড়ে তোলেন ইমরুল। পরাজয়ের শঙ্কা এড়িয়ে ম্যাচ ড্র করে বাংলাদেশ। তামিম-ইমরুলের ওই জুটি এখনও প্রথম উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। দলের দ্বিতীয় ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে এখনও তা টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরির জুটি। ওই ম্যাচ বাদ দিলে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেমন অর্জন নেই বাঁহাতি টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানের। তবে বিদায়বেলায় ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব একপাশে রেখে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্টিই প্রকাশ করলেন ইমরুল। ‘২০০৬ সালে (২০০৭ সালে) যখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়, আমি চিন্তা করিনি যে বাংলাদেশ দলের হয়ে এতগুলো টেস্ট খেলতে পারব। আর সব শেষে এখন যেভাবে বিদায় নিলাম, আমি খুব খুশি যে বাংলাদেশের হয়ে ৩৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলতে পেরেছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। কারণ এক টেস্ট হোক পঞ্চাশ টেস্ট বা একশ টেস্ট খেলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাই বড়।’ তিনি বলেন, ‘প্রায় ১০-১২ বছর দলের সঙ্গে থেকেছি, খেলেছি বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন দেশে। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের ছিল। আমি চেষ্টা করেছি ব্যাটিং করে হোক বা কিপিং করে হোক, দলের প্রয়োজনে অবদান রাখতে। আমার হয়তো আরও ভালো টেস্ট ক্যারিয়ার হতে পারত। তবে যেটা হয়নি সেটা নিয়ে এখন আর আফসোস মনে করি না। যা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।’
লাল বলের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও সীমিত ওভারে খেলা চালিয়ে যাবেন ইমরুল। জাতীয় লিগের টি-টোয়েন্টি সংস্করণ, এরপর বিপিএল ও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও দেখা যাবে তাকে। সাদা পোশাক ছাড়লেও সাদা বলে চালিয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন বাংলাদেশের জয়ে ৭৮ ওয়ানডে ও ১৪ টি-টোয়েন্টি খেলা ব্যাটসম্যান। ‘টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে খেলার মতো যে ফিটনেস লাগে, আমি যদি কাজ করতে থাকি, তাহলে হয়তো খেলতে পারব কয়েকটা বছর। কিন্তু চার দিনের ম্যাচ খেলতে যে স্ট্রেংথ, যে মানসিকতা লাগে... আমার মনে হয়েছে, এখন তরুণদের সঙ্গে না পারি, তাহলে নিজের কাছেই খারাপ লাগে। একটা ছেলে যেভাবে বলের পেছনে দৌড়ায়, আমি তো তার সঙ্গে পারছি না। তাই মনে হয়েছে, আমি সঠিক পথে নাই। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে এক দিনে শেষ হয়ে যাবে। আপনি ফুল এনার্জি দিতে পারবেন। যেটা চার দিনের ম্যাচে কঠিন।’ এই দুই সংস্করণে আর কত দিন খেলতে চান, সে বিষয়ে পরিষ্কার ভাবনা জানাননি তিনি। তবে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনে কোচিংয়ে মন দেওয়ার লক্ষ্য তার। কখনও সুযোগ পেলে বাংলাদেশ দলের হয়েও কাজ করার বাসনা ইমরুলের। ‘এখন আমি বেশিরভাগ সময়ই অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। একটা দলের হয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশনও খেলছি। সেখানে একটা কোচিং একাডেমি দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এরই মধ্যে কথাবার্তা চলছে, কাজ করছি। আশা করছি, আগামী বছরের দিকে এটা আমরা শুরু করব।’
সংবাদ সম্মেলন শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে আবারও ছবি তোলার আবদার মেটাতে হয় ইমরুলকে। সবশেষে হাসিমুখে তিনি হাঁটা ধরেন শের-ই বাংলার সবুজ ঘাসের ওপর। ড্রেসিং রুমে ঢোকার আগে কিছুক্ষণ বসে থাকেন ডাগআউটে। যেখানে সাদা পোশাকে তাকে দেখা যাবে না আর কখনও।