হার দিয়ে ক্যারিবিয় সফর শুরু করলেও দ্বিতীয় টেস্ট জিতে সমতায় সিরিজ শেষ করেছিল বাংলাদেশ দল। তাই খানিকটা আত্মবিশ্বাস নিয়েই ওয়ানডে সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছিল লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। সে আত্ববিশ্বাসে ভর করেই প্রথম ওয়ানডেতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে তিনশোর কাছাকাছি পুঁজি পেয়েছিল সফরকারিরা। কিন্তু শেরফেন রাদারফোর্ডের ক্যারিয়ার সেরা ব্যাটিংয়ে টাইগারদের হারের মালা পড়িয়েছে উইন্ডিজরা। গত রোববার রাতে সেন্ট কিটসে আগে ব্যাট করে ৬ উইকেটে ২৯৪ রান সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। জবাবে ১৪ বল ও ৫ উইকেট হাতে রেখে টপকে গেছে স্বাগতিকরা। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে রাদারফোর্ড খেলেন ১১৩ ঝলমলে ইনিংস। ৮০ বল মোকাবিলায় তিনি সাতটি চারের সঙ্গে মারেন আটটি ছক্কা।
এর মধ্যে দিয়ে গত ছয় বছরে বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা ১১ ওয়ানডে হারার পর অবশেষে জয়ের স্বাদ পেল এক সময়ের পরাক্রমশালী ক্রিকেট শক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জয় থেকে সাত রান দূরে যখন আউট হন রাদারফোর্ড, তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে সাত চার ও আট ছক্কায় ৮০ বলে ১১৩! ওয়ানডে ক্রিকেটে আবির্ভাবেই যে অবিশ্বাস্য পথচলায় ছুটছেন তিনি, সেটি আরো গতিময় হলো এই সেঞ্চুরিতে। ক্যারিয়ারের অষ্টম ইনিংসে দেখা পেলেন প্রথম শতরানের। আগের সাত ইনিংসের মধ্যে ফিফটি পাঁচটি! এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবশেষ ওয়ানডে জয় ছিল যেটি, ২০১৮ সালে মিরপুরে সেদিন ২৫৬ রান তাড়ায় একাই অপরাজিত ১৪৬ করেছিলেন শেই হোপ। এবার খরা কাটানো জয়ে তিনি অধিনায়ক আর ব্যাট হাতে সহযোগী। রাদারফোর্ডের তাণ্ডব শুরুর আগে দলকে পথে রেখেছিল হোপের ৮৮ বলে ৮৬ রানের ইনিংসটিই। বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটি অনেক দিক থেকেই হতাশাময়। টস জিতে ব্যাটিং নিয়ে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ বলেন, ২৮০ রানের মতো করার লক্ষ্য তাদের। তিন ফিফটি ও আরেকটি ‘প্রায়’ ফিফটিতে ৫০ ওভারে রান তোলে তারা ২৯৪। ওপেনিংয়ে ৬০ বলে ৬০ করেন তানজিদ হাসান, চারে নেমে মিরাজ ১০১ বলে ৭৪। পরে ৪৪ বলে ৫০ রানে অপরাজিত থাকেন মাহমুদউল্লাহ, ৪০ বলে ৪৮ জাকের আলি। কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়কের প্রত্যাশার চেয়ে বড় স্কোরও আদতে অনেক কমই প্রমাণিত হয়। রান তাড়ায় ইনিংসের অর্ধেকটা জুড়ে চাপে থাকলেও ক্যারিবিয়ানরা শেষ পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে জিতে যায় ১৪ বল বাকি রেখে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ২৬৫ রান তাড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় ছিল এই মাঠের রেকর্ড।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ রান তাড়া ছিল ২৫৬। দুটিই নতুন করে লেখা হলো এবারের জয়ে। সেন্ট কিটসের উইকট ছিল ব্যাটিং স্বর্গ। তবে এভিন লুইস ও ব্র্যান্ডন কিংয়ের শুরুটা খুব ভালো ছিল না। প্রথম সাত ওভারে দুই ব্যাটসম্যান পাঁচ বাউন্ডারি মারলেও দলের রান ছিল মোটে ২৫। এরপর কিংকে (১৭ বলে ৯) এলবিডব্লিউ করে দেন তানজিম হাসান। পরের ওভারে নাহিদ রানার ১৪৯.৮ কিলোমিটার গতির ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ এভিন লুইস (৩১ বলে ১৬)। জোড়া ধাক্কা সামাল দিয়ে তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়েন হোপ ও কেসি কার্টি। তবে রানের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখে বাংলাদেশ। ৬৭ রানের জুটিতে বল লাগে ৮২টি।
রিশাদ হোসেনের নিরীহ বলে কার্টি যখন আউট হয়ে যান ২১ রান করে, ওভারপ্রতি তখন সাতের বেশি রান লাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। হোপ ও রাদারফোর্ডের জুটিতে তা নাগালে চলে আসে। সহজাত আগ্রাসী রাদারফোর্ড ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে একটু সময় নেন। এক পর্যায়ে তার রান ছিল ২৯ বলে ১৯। পরে মিরাজের ওভারে ছক্কা ও চার মেরে যে গতি বদলালেন, আর থামাথামি নেই। ফিফটি করে ফেললেন ৪৭ বলেই। আরেক প্রান্তে হোপের ব্যাটও তখন উত্তাল। ৯৩ বলে ৯৯ রানের জুটি গড়ে হোপ যখন বিদায় নেন মিরাজের শর্ট বলে ছক্কা মারার চেষ্টায়, জয়ের জন্য তখনো ৭৭ বলে ১০২ রান লাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। কিন্তু রাদারফোর্ড ও জাস্টিন গ্রেভস মিলে সেই চ্যালেঞ্জ উড়িয়ে দেন যেন স্রেফ তুড়ি বাজিয়ে! ফিফটি থেকে সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে রাদারফোর্ডের লাগে স্রেফ ৩০ বল। পরের দুই বলে টানা দুটি ছক্কা মারেন সৌম্য সরকারকে। এরপর অনেক বাইরের বল তাড়া করে শর্ট থার্ড ম্যানে ধরা পড়েন তিনি।
জয় ধরা দেয় একটু পরই। টেস্টে ফেরার ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পর ওয়ানডেতে ফেরার ম্যাচে গ্রেভস অপরাজিত থাকেন ৩১ বলে ৪১ রান করে। উইকেট যে ব্যাটিংয়ের জন্য দারুণ, তা প্রমাণ হয়ে যায় সকালে ম্যাচের শুরুতেই। দ্বিতীয় ওভারে জেডেন সিলসের মাথার ওপর গিয়ে বল সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলেন তানজিদ হাসান, যে ডেলিভারিটি হাফ ভলি ছিল না মোটেও। সৌম্য সরকারের তিন বাউন্ডারিতেও তা ফুটে ওঠে ভালোভাবেই। তবে আগের অনেকবারের মতোই শরীর থেকে দূরে স্টাম্পের বাইরে ব্যাট পেতে দিয়ে উইকেট হারান সৌম্য (১৮ বলে ১৯)। তিনে নামা লিটন দাস দুই রান করে আউট হন আলগা শটে। এই বছরে আগের দুই ওয়ানডেতেই তিনি আউট হয়েছিলেন শূন্যতে। সব মিলিয়ে টানা ১১ ওয়ানডেতে ফিফটি নেই তার। বাংলাদেশের বিপদ বাড়তে পারত আরো। মিরাজ ১ রানে জীবন পান কেসি কার্টির হাতে। সুযোগ পেয়ে তিনি জুটি গড়ে তোলেন তানজিদের সঙ্গে। তানজিদ শুরু থেকেই ছিলেন ছন্দে। নিজের জোনে বল পেলে যেমন দারুণ কিছু শট তিনি খেলেছেন, তেমনি বাউন্ডারি বানিয়েছেন ভালো বলেও। ফিফটি করেন তিনি ৪৬ বলে। অস্বস্তিময় শুরুর পর মিরাজও ক্রমে নিজেকে ফিরে পান। শাফল করে দারুণ একটি ছক্কা মারেন সিলসের বলে। ৩১ রানে আবার ক্যাচ দিয়ে রক্ষা পান সেই কার্টির হাতেই। আলজারি জোসেফকে কাট করে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে শেষ হয় তানজিদের ইনিংস। জুটির সমাপ্তি ৭৯ রানে।
আফিফ শুরু করেন সেখান থেকেই। এক বছর পর ওয়ানডেতে ফিরে সাবলিল ব্যাটিংয়ে এগোতে থাকেন তিনি মিরাজের সঙ্গে। গড়ে ওঠে আরেকটি অর্ধশত রানের জুটি। ৫৪ রানের জুটির পর দুজন বিদায় নেন অল্প সময়ের মধ্যে। ফ্লিক করে ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন আফিফ (২৯ বলে ২৮)। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে সিলসকে উইকেট দিয়ে ফেরেন মিরাজ। বাংলাদেশ তাতে একটু হলেও বিপাকে পড়ে। ৫ উইকেট হারিয়ে রান তখন ১৯৮, ইনিংসের বাকি ১২ ওভারের বেশি। মাহমুদউল্লাহ ও জাকের সেখান থেকে এগিয়ে নেন দলকে। জাকের শুরু থেকেই রান তোলেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। মাহমুদউল্লাহ শুরুতে একটু সময় নেন। পরে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শেষ দুই ওভারে দুই ছক্কায় ফিফটি হয় তার। তিনটি করে চার ও ছক্কায় ৪৮ করে শেষ ওভারে আউট হয়ে যান জাকের। তিনশর কাছাকাছি রান তুলে খুশিই ছিলেন মিরাজরা। কিন্তু নির্মমভাবে বাস্তবতা বুঝিয়ে তাদের খুশি কেড়ে নেন হোপ-রাদারফোর্ডরা। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ আজ মঙ্গলবার।