শুক্রবার ছিল বিশ্ব অটিজম দিবস। এ দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়া হলেও অনেকেরই অটিজম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আসুন জেনে নিই এ সম্পর্কিত নানা তথ্য
অটিজম কী
অটিজম হলো জীবনভর মারাত্মক স্নায়ু বিকাশজনিত অসুখ, যাতে আক্রান্ত শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ, প্রতিক্রিয়া, ভাষাগত বিভিন্ন সমস্যা হয়ে থাকে। ছেলেশিশু মেয়েশিশুর চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি অটিজম সমস্যায় ভুগে থাকে। আমেরিকায় ২০১২ সালে প্রতি ৮৮ জনে একজন শিশুর অটিজম সমস্যা দেখা দিত। ২০১৪ সালের হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি ৬৮ জনে একজন। আমাদের দেশে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। কাজেই দিন দিন অটিজমের সমস্যা বাড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের প্রশংসনীয় উদ্যোগে আমাদের দেশে অটিজম বিষয়টি সাধারণ মানুষের গোচরে আসে এবং বিশেষ গুরুত্ব পায়। ২০০৮ থেকে প্রতি বছর ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হয়।
অটিস্টিক শিশুর কী কী লক্ষণ থাকে
শিশুর বয়স দেড় থেকে ২ বছর হলে সাধারণত লক্ষণগুলো দেখা দেয়। ৩ বছর বয়সের মধ্যেই মা-বাবা সমস্যাটি ধরতে পারেন। সাধারণত অটিস্টিক শিশুর যেসব লক্ষণ দেখা দেয় তা হলো যে বয়সে যে কথা বলার তা না বলা বা একেবারেই কথা না বলা, অদ্ভুত বা অনুপযুক্ত আচরণ, অন্যের প্রতি সহানুভূতিহীন, আনন্দ বা বিরক্তি প্রকাশ না বোঝা, কোনো কিছুর দিকে সঠিক দৃষ্টি না দেয়া, প্রচ- জেদি বা রাগী, অমনোযোগী ইত্যাদি। অটিস্টিক শিশুর কল্পনাশক্তি কম থাকে। বাঁধাধরা নিয়ম পছন্দ করে, ব্যত্যয় ঘটলে চরম প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাদের অন্যান্য শিশুর চেয়ে বেমানান ও বিচ্ছিন্ন মনে হয়।
কেন শিশুর অটিজম সমস্যা হয়
ঠিক কী কারণে অটিজম সমস্যা হয় তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তবে যে পরিবারে মানসিক বা আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু আছে, পরবর্তী সময়ে সে পরিবারে তাদের শিশুর অটিজম সমস্যা দেখা দেয়ার ঝুঁঁকি বেশি। অন্যদিকে অধিক বয়সের মা-বাবার সন্তানের মধ্যে অটিজম সমস্যার প্রাদুর্ভাব বেশি। পরিবেশ দূষণ, ক্ষতিকর কীটনাশক, খাদ্যে ভেজাল, প্লাস্টিক-জাতীয় পাত্রে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ এবং সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অটিজমের কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে এখন বলা হচ্ছে, গর্ভাবস্থায় দুশ্চিন্তা কমানোর ওষুধ, ঘুমের ওষুধ বা মৃগী রোগের ওষুধ ইত্যাদি সেবন করলে অটিস্টিক শিশুর জন্ম হতে পারে। তাছাড়া কম ওজন নিয়ে জন্মানো
শিশু, অপরিপক্ব শিশু, টেস্টটিউবের মাধ্যমে জন্মানো শিশুর অটিজম সমস্যা বেশি হয়। বর্তমানে শিশুর অসময়ে এবং অপ্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করাকেও অটিজম সমস্যার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।
অটিজমের চিকিৎসা কী
চিকিৎসার মাধ্যমে অটিজম সমস্যার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো, অটিস্টিক শিশুকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ও কার্যক্ষম রাখতে চেষ্টা করা।
তাদের জন্য আচরণ-ভাষা ও শিক্ষাগত এবং শারীরিক বিশেষ থেরাপি দেয়া হয়। অতিরিক্ত চঞ্চলতা কমানোর জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অটিস্টিক শিশুর সেবা দিয়ে থাকে। সঠিক যতœ পেলে অটিস্টিক শিশুও উপার্জনক্ষম হয়ে স্বনির্ভর জীবনযাপন করতে পারে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অটিস্টিক শিশুকে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকে। তার মধ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, প্রয়াস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
প্রতিরোধের উপায়
অটিজম সমস্যাটি মূলত তৈরি হয় গর্ভাবস্থায় যখন শিশুর ব্রেন বা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তবে গর্ভধারণের আগে ও প্রসবপরবর্তী সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু অটিজম সমস্যার কোনো নিরাময় নেই, তাই প্রতিরোধের জন্য সচেতন হতে হবে। পরিবারে কোনো শিশুর অটিজম, অন্য কোনো মানসিক বা আচরণগত সমস্যা থাকলে তাদের পরবর্তী সন্তানের অটিজম হওয়ার ঝুঁঁকি বেশি। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ অত্যন্ত জরুরি। উপযুক্ত বয়সে সন্তানধারণ, সন্তানধারণের আগেই অধিক ওজন থাকলে তা কমানো, ফলিক এসিড-জাতীয় ভিটামিন, সুষম ও ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণ, রঙ ও স্বাদ বৃদ্ধির কৃত্রিম রাসায়নিক, প্লাস্টিক-জাতীয় পাত্র পরিহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপে থাকতে হবে, যাতে অপরিপক্ব বা কম ওজনের সন্তানের জন্ম না হয়। তা ছাড়া গর্ভাবস্থায় দুশ্চিন্তা কমানোর ওষুধ, মৃগী রোগের বা ঘুমের ওষুধ; এমনকি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যে কোনো ওষুধ বর্জন করতে হবে। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, তার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, অপ্রয়োজনীয় টিকা না দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো অটিজম প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
ডা. রেজাউল করিম কাজল
সহযোগী অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়