ঢাকা ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বদেশপ্রেম

স্বদেশপ্রেম

বিভিন্ন দেশে গেলে কেন আমাকে বলা হবে পরবাসী? আমার দেশ, আমার বাড়ি, আমার ঘর এ ধরনের ভাবনা যুগে যুগে মনুষ্যত্বকে খর্ব করছে। মানুষের স্বাধীন চলার পথকে শীর্ণ করে তাকে আত্মকেন্দ্রিক করছে। আমার আমার করতে করতে মানুষ পরম আত্মীয়কে পর ভাবতে শিখছে। এমনকি তার আগের বিচারেও যারা আত্মীয়, নিজের দেশের লোক, তাদের এখন অতি সহজেই সে বলছে বিদেশি। কেউ কেউ আবার অন্য উপসর্গের শিকার, ভূত দেখে আঁতকে ওঠার মতো বা বিকারের ঘোরে নিজেদের ভাবছে বিদেশি, নিজের দেশকে মনে করছে বিদেশ। আসলে নিজের দেশকে বিদেশ ভেবে আলাদা রাজ্যের দাবি করা যেমন একটি রোগ, নিজের দেশের মানুষকে কথায় কথায় বিদেশি আখ্যা দেওয়াটাই তেমনই একটি মারাত্মক ব্যাধি।

এ মুহূর্তে সবার আগে দরকার মানুষে মানুষে বিশ্বাস সৃষ্টি, জাতিতে জাতিতে ও বর্ণে বর্ণে সম্প্রীতি স্থাপন। আমরা যে নিজের দেশকেও বিদেশ ভাবি বা নিজের দেশের মানুষকে বিদেশি আখ্যা দেই, তার মূলে কাজ করে পারস্পরিক অবিশ্বাস, ভুল বোঝাবুঝি। অবশ্য সত্যের খাতিরে এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে, নির্বিচার শোষণ এবং নির্লজ্জ অত্যাচারও অনেক সময় এ ধরনের মানসিকতার সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগায়। এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য গাছের মাথায় পানি না ঢেলে তার গোড়ার তদারকি দরকার। অর্থাৎ ঘন ঘন বৈঠক, আলাপ-আলোচনা ইত্যাদির মাত্রা কমিয়ে মূল গলদ দূর করার জন্য কার্যকরি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এমন ব্যবস্থা যা অনুন্নতদের উন্নতি বিধানে সহায়ক হয়, মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস সৃষ্টিতে ফলপ্রসূ হয়।

উন্নত চরিত্রের মানুষ সব দেশকেই নিজের দেশ ভাবেন, সব ঘরকেই মনে করেন নিজের ঘর। তাদের কাছে বিদেশ বলে কিছু নেই, অনাত্মীয় বলে কেউ নেই। তারা যখন যেখানে থাকেন, সেখানেই ভাবেন স্বদেশ যখন যাদের মধ্যে থাকেন তাদের ভাবেন স্বজাতি। দৃষ্টি সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত বলেই ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতিগত অনৈক্য তাদের কাছে কোনো সমস্যাই নয়। মাদার তেরেসা কত দূর দেশের মানুষ। কিন্তু তিনি নিজ গুণে কত সহজে পরকে আপন করে নিলেন। কত অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন পরদেশের অসহায় শিশুদের। ভগিনি নিবেদিতা সাগরপাড় থেকে এসে সাত সাগরের সুধা ঢাললেন মানুষের কল্যাণের জন্য। এদেশই যে তার নিজের দেশ হয়ে উঠেছিল, তা কি তার অতি বড় বিরোধিতা অস্বীকার করতে পারেন? শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজ করে গেলেন দূরদেশি এলম হাস্ট, পিয়ারসন প্রমুখ মনীষী। বিদেশকে স্বদেশ ভাবতে পেরেছিলেন বলেই না তাদের পক্ষে এই আত্মত্যাগ সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশের অনেকেই দেশে দেশে নিজের দেশকে খুঁজে পেয়েছেন। আমাদের আপনজনরা ইউরোপ বা আমেরিকার যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন তার আত্মীয়, অনুরাগী ও সুহৃদগোষ্ঠী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকের মধ্যেও বিদেশিদের আপন করে নিয়েছেন, সর্বস্বপণ করে তারা এগিয়ে গিয়েছেন তাকে সাহায্য করতে, তাছাড়া আছেন মওলানা ভাসানী, দেশে দেশে যার ঘর দেশে দেশে যার দেশ।

স্বদেশপ্রেম ও সমাজচেতনা আধুনিককালের চিন্তাধারা। এ চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে মানুষ মধ্যযুগে কত না সংগ্রাম করেছে। বিশেষ করে ইউরোপে রাষ্ট্রতন্ত্র যখন সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন যুদ্ধ ব্যবসায়ীরা স্বদেশ রক্ষার নামে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়েছেন। তারপর কত না উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে বিশেষ বিশেষগোষ্ঠী তাদের রাষ্ট্রীয় সীমারেখা চিহ্নিত করেছে। এ যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমারেখা, তাকে সুরক্ষিত করার জন্য সব দেশ সর্বদা তাদের নিজ নিজ সৈন্যবাহিনীকে সজাগ রাখে। তথাপি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমানা বিবাদ নিয়ে কখনও যুদ্ধ, কখনও ছায়াবিবাদ চলছে। এ অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে স্বীকার করে নিয়েই আধুনিক মানুষের জীবনে স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার বীজ উপ্ত হয়েছে। স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে সমাজচেতনা ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত। সমাজ সম্পর্কে সহানুভূতিশীল না হলে স্বদেশের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রক্ষা করা যায় না, কারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজকে নিয়ে স্বদেশ-এর বিশাল ধারণাটি রূপলাভ করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সিলেট থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিশ্লেষণ করলে সমাজচেতনার ধারণাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আমাদের এ বাংলাদেশে নানান ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় জাতি-উপজাতি অধিবাসী ও প্রত্যন্তবাসীদের অধিষ্ঠান। বিচিত্র তাদের সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠান। তথাপি এ বৈচিত্র্যময় সমাজের মধ্যে একটি ঐক্য সূত্র রয়েছে। সেই ঐক্য সূত্রটি হলো বাংলাদেশি অর্থাৎ বিচিত্র ধর্ম ও বর্ণের মানুষ হলেও আমরা একই বাংলাদেশের অধিবাসী এই সত্যটি সর্বদা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। এই সত্য ধারণাকে আমরা বলতে পারি স্বদেশ ভাবনা। অনুরূপভাবে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও ঐক্য বোধের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

স্বাদেশিকতা ভালো; কিন্তু উগ্র স্বাদেশিকতা ভালো নয়। স্বাদেশিকতা তথা স্বদেশপ্রেমের মূলে আছে মানবপ্রেম। অন্যান্য রাষ্ট্রে যেসব মানুষ বাস করে তাদের প্রতি যদি আমাদের যথোচিত শ্রদ্ধা থাকে, তবে উগ্র স্বাদেশিকতাকে আমরা অনায়াসে বর্জন করতে পারি। এ উগ্র স্বাদেশিকতার ফলে আমাদের মনে এ ধারণা জন্মায় যে, আমাদের দেশ ও জাতি পৃথিবীর অন্য দেশ ও জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তার ফলে অন্যান্য দেশে আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতা দেখা যায়। মানবসমাজে এ বোধটি উপ্ত হয়েছে। সে দিনই, যেদিন গুহাবাসী মানুষ আধুনিক দৃষ্টিতে ‘অসভ্য’ অবস্থাতেই গুহার মধ্যে থেকে বেরিয়ে গাছের ফলমূলকে দ্বিতীয় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে শিখল।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই ওই মানুষ ঝুঝতে শিখেছে একক বিক্রম নয়, গোষ্ঠীবদ্ধতা, বিদ্বেশ নয়, সখ্যের পথেই তাদের জীবন সংগ্রাম সিদ্ধ হতে পারে। এইভাবে পরনির্ভরশীলতার প্রেমময় পথেই মানুষবোধ নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছে আপন গোষ্ঠীর মধ্যকার অন্যান্যকে। তারপর সভ্যতার অগ্রগতিতে কখন যে তাদের এ সংকীর্ণ গোষ্ঠী সীমার বাঁধ ভেঙে গেছে তা কি তারা নিজেরা জানে? কিন্তু যেহেতু মানুষের আদিম প্রবৃত্তিতে মিশ্রিত রয়েছে হিংসা আর বিশ্বজুড়ে ‘নাগিণীরা ফেলেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’ তাই কখনও কখনও অবিশ্বাস ও সহনশীলতার অভাব কোথাও কোথাও প্রকট হয়ে পড়েছে। মানব সমাজের ফুলের ডালি ভরে উঠেছে ব্যথিতের কান্নায়, অপমানে, অত্যাচারে। তিল তিল পরিশ্রমে গড়া সভ্যতার চূড়ায় বসে আমরা হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করেছি মানবপ্রীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি।

আবার পঙ্কের মধ্যেই পঙ্কজের মতো পৃথিবীর এখানে ওখানে মহামনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের কল্যাণে অত্যাচারিত বিধ্বস্ত সমাজে আবার শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এসেছে। অজন্মা, কি মানুষের গড়া, দুর্ভিক্ষ রাষ্ট্রবিপ্লবে কিংবা খরা-বন্যায় যখন সংখ্যাতীত আর্ত-ব্যথিত-পীড়িতজনের অবর্ণনীয় দুর্দশার সৃষ্টি হয়, তখন সেবা নামক মঙ্গলবারী নিয়ে আর্তজনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর নামই মনুষ্যত্ব।

লেখক : পরিবেশবিদ ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত