ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন ও গণতন্ত্র

সামছুল আলম দুদু এমপি
শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন ও গণতন্ত্র

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতাকালে প্রায়ই একটি কথা বলেন। সে কথাটি হচ্ছে, ‘জনগণের কল্যাণ করতে হলে একটি দর্শন থাকতে হয়।’ সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলানোর সুযোগ তৈরি না হলে গণতন্ত্র অর্থবহ হয় না। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অর্থবহ কথা। আমরা যারা রাজনীতি করি তাদের হৃদয়ঙ্গম করা খুবই জরুরি যে, মানুষের কল্যাণ ছাড়া রাজনীতিরও কল্যাণ হয় না। মানুষকে নিয়েই রাজনীতি। জননেত্রী শেখ হাসিনা যে দর্শনের কথা বলেন সেটি হচ্ছে সার্বিক উন্নয়ন দর্শন। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়। ছাত্রদের তিনি সাদামাটা আদর্শিক জীবনযাপন করার লক্ষ্যে অর্থের মোহ ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার লাভ হবে না। জ্ঞান অন্বেষণ করতে হবে। জ্ঞান যত বৃদ্ধি পাবে, সম্পদও তত বৃদ্ধি পাবে। জ্ঞানভিত্তিক সম্পদই মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে। অবৈধ অর্থ মানুষের মধ্যে জিঘাংসার জন্ম দেয়। সে জন্য আমাদের নেত্রী অবৈধ রোজগার থেকে বিরত থাকতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ তথা সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই পরামর্শটাই নেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন। এই উন্নয়ন দর্শনকে কেন্দ্র করে আমাদের নিজেদেরকেই একটি প্রশ্ন করতে হবে : জাতীয় জীবনের কাঠামো আমরা কোন ভিত্তির ওপর গড়ে তুলব? শিক্ষা বিস্তার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিল্পের উন্নতি, প্রতিরক্ষা এবং সমাজ কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে এই পরিকাঠামো সর্বত্র গড়ে উঠেছে আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলোর অধিকাংশই সমাধান করতে পারব। যে জন্য আমরা বলে আসছি, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে রূপান্তর হবে। বর্তমানে যেসব পশ্চিমা দেশ রয়েছে, সেগুলোকে আমরা উন্নত দেশ হিসেবে মনে করে থাকি। কিন্তু সার্বিকভাবে সে দেশগুলো উন্নত কিনা তা ভাবতে হবে। তারা অর্থ-বিত্ত-বৈভবে সমৃদ্ধ হলেও মানবতা ও মানবিকতায় কতটা সমৃদ্ধ- সে প্রশ্নটি থেকেই যায়। তবু তাদের কাছ থেকে মানবতার ছবক নিতে হয়, মানবাধিকারের শিক্ষা নিতে হয়। দেখুন, আর্থসামাজিক ও বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে কী ধরনের মানুষ তৈরি হবে? তারা কী চতুর, শঠ প্রকৃতির হবে? ক্রমবর্ধমান জ্ঞান যাদের কাছে অন্যকে শোষণ ও বঞ্চিত করার একমাত্র হাতিয়ার? তারা কী উন্নত জাতি হতে পারে? কিংবা উন্নত দেশ হতে পারে? উন্নত জাতি না হলে উন্নত দেশও হবে না। পশ্চিমা কথিত ধনী বিশ্বে যা দেখে এসেছি এবং এখন দেখছি। মারণাস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে অন্যকে আঘাত করার লক্ষ্যে, লাখ লাখ নিরীহ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে বুলেটের আঘাতে। যাদের অস্ত্রে এগুলো হচ্ছে, তারা সবাই নিজেদের উন্নত জাতি হিসেবে ভাবছে ও গৌরব করছে। আমাদের নেত্রী এমন উন্নতির কথা বলেন না। তিনি মানবিক উৎকর্ষের কথা ভাবেন। এবং মানবিক উৎকর্ষের লক্ষে রাজনীতি করছেন। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিককে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশের মানুষ যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হলো, তখন থেকেই গণতন্ত্রের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত ধারণার ওপর চরম আঘাত আসতে শুরু করে। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তোলা হলো জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। কিছু রাক্ষস প্রকৃতির লোক জনজীবনকেও বিপর্যস্ত করে ফেলে। গণতান্ত্রিক সমাজে তিন ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রণিধানযোগ্য। প্রায় ১ হাজার বছর আগের কথা- ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজা ছিলেন ভুর্তহরি। তিনি কবিও ছিলেন বটে। তিনি বলেছেন, সমাজে কিছু সৎমানুষ আছেন, যারা নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে সর্বদা পরহিতে কাজ করেন। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ততক্ষণেই অন্যের মঙ্গল করবেন, যতক্ষণ তার নিজের স্বার্থে ঘা না লাগে। আর এক ধরনের মানুষ আছেন, যারা মানব রাক্ষস। এই মানব রাক্ষসরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অন্যের কল্যাণকে বলি দেয়। ভুর্তহরি সৎমানুষ, বলতে ভালো মানুষ বুঝিয়েছেন। ভালত্ব হচ্ছে যাদের ব্যক্তিসত্তার অন্যের কল্যাণ চিন্তায় এমনই পরিপূর্ণ যে, স্বার্থের কালিমা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। এ রকম মানুষ নিজের স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু অন্যের মঙ্গলই করে যান। এরাই মহত্তম মানুষ, নিউ টেস্টামেন্টের ভাষায় বলতে গেলে এরা হচ্ছেন ‘Salt of the earth’. অর্থাৎ পৃথিবী এদের জন্যই টিকে আছে। এটাই হচ্ছে উন্নয়ন দর্শন। এ ধরণের সৎ মানুষ যারা রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় ছিলেন তাদের চারিত্রিক মহিমা জনগণকে যুগে যুগে প্রভাবিত করবে। ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও আমাদের জাতির পিতা ছিলেন এ ধরনের মানুষ। তারা ইচ্ছা করলে আরাম-আয়াসে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তারা তা না করে অন্যের মধ্যে নিজেদের প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজেদের ক্ষুদ্র আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যের কল্যাণার্থেই জীবনযাপন করে গেছেন। লাখ লাখ স্বদেশবাসীকে দাসত্ব ও ভয়ের হাত থেকে মুক্ত করতে এবং মানুষের ভেতর মানবীয় মর্যাদা ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। ভুর্তহরি দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষদের বলেছেন সাধারণ মানুষ। সমাজে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের মানসিকতা হচ্ছে, যতক্ষণ নিজের স্বার্থে আঘাত না লাগবে ততক্ষণই অন্যের স্বার্থ দেখবে। একেই ব্রিটিশদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনে ‘এনলাইটেড সেলফ ইন্টারেস্ট’ বা মার্জিত আত্মস্বার্থ বলা হয়েছে। বাংলাদেশে এই দর্শনের কদর ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ খুবই দরকার। এ দর্শনটি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে। কেননা ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রয়োজন। বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো চাই। তা না করে নির্বোধের মতো শুধু নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা করলে ধনী আরও ধনী হবে, গরিব আরও গরিব হবে। যে রাষ্ট্রে অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রচলিত, সেখানে সম্পদ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বানচাল হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। যারা শুধু নিজের সম্পদ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করার অর্থ হচ্ছে সমাজকে অসুস্থ করে তোলা।

আরেক শ্রেণির মানুষকে ভুর্তহরি ‘মানব রাক্ষস’ বলেছেন। এরা দুষ্ট প্রকৃতির লোক। এদের চারিত্রিক পৈশাচিকতা এভাবে প্রকাশ পায় যে, এরা ব্যক্তিগত লাভের উদগ্র বাসনায় অন্যের সুখ-শান্তি হরণ করে। অন্যের সর্বনাশ করে। ভুর্তহরি ‘মানব রাক্ষস’ কথাটির পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও আমাদের দেশে অসংখ্য ‘নর রাক্ষসের’ সৃষ্টি হয়। নররাক্ষসের থাবা থেকে রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও আমরা যেন পেরে উঠছি না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই রাক্ষসের হাত থেকে মুক্তির জন্য তিনি মহান এক উন্নয়ন দর্শন উপস্থাপন করেছেন। মানব রাক্ষসরা খাদ্যে ভেজাল করছে, ওষুধে ভেজাল করছে- লাখ লাখ মানুষের দুঃখ ও যন্ত্রণার বিনিময়ে নিজেরা সুখী ও সমৃদ্ধিশালী হচ্ছে। কিন্তু এই সুখই যে একদিন দুঃখের আধার হয়ে উঠবে, তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না। সে জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার উচ্চারণ করছেন সততার সঙ্গে জীবনযাপনের কথা। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সমগ্র জনসাধারণকে সাশ্রয়ী হওয়ার, মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক ইঞ্চি চাষযোগ্য জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সে দিকটায় খেয়াল রাখতে বলেছেন। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটকে বিবেচনায় নিয়ে শ্রমজীবীদের স্বার্থরক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করার দিকে জোর দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণে এমনটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে, একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক হয়ে উঠার অর্থ, সেই রাষ্ট্রের মানুষ নাগরিক হিসেবে তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে ওঠা; শেখ হাসিনা ধীরলয়ে হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গণতন্ত্রে পরিণত করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তার এই উদ্যোগে সবাইকে শামিল হতে হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত