নজরুল ও বঙ্গবন্ধু : অভিন্ন চেতনার সঙ্গী

মজিদ মাহমুদ

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলের সশরীরের উপস্থিতির ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল শুধু কবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এটি ভাবা খুব স্বাভাবিক ছিল না যে, নজরুলের ৭৩তম জন্মজয়ন্তী ও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে স্বাধীনতার এই কবির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা। নজরুলের গান, কবিতা, ভালোবাসা আর অন্য দেশের একজন অসুস্থ নির্বাক নাগরিককে নিজের দেশে আনতে চাওয়ার ঝক্কি ও আকাঙ্ক্ষা সাধারণ বৌদ্ধিক চেতনার সমান্তরাল নয়। আর এখানেই বঙ্গবন্ধুকে দেখতে হবে নজরুল-চেতনার ভেতর দিয়ে। এতেই প্রমাণিত হবে, ইতিহাসের এই দুই মহান পুরুষের শুভ চেতনালোকে কোনো তফাত ছিল না। একজন বাণীতে যা প্রকাশ করেছিলেন, অন্যজন কর্মে তা পরিণত করেছিলেন। একটি পরাধীন জাতির চিৎপ্রকর্ষে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা, তা-ই নজরুলের ভেতর দিয়ে বাণীরূপ পাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের কথায়, একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ঈশ্বর সবার মধ্যে নয়, বিশেষ কারো মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন; নজরুলই যে জাতির সেই বিশেষ ব্যক্তি, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি; তার কণ্ঠস্বরই হয়ে উঠেছিল জাতির কণ্ঠস্বর; আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মূর্তিমান রূপ।

বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে নজরুলকে বাংলাদেশে আনার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু-তনয় শেখ কামাল কবির ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে। সেখানে তিনি প্রথমে কবিপুত্র সব্যসাচীর সঙ্গে আলাপ করেন। সব্যসাচী তাকে জানান, ভারত সরকার সম্মত হলে তার অমত নেই। এরপর বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের নেতৃত্বে কবিকে আনার জন্য দুই দেশের মধ্যে কূটনীতিক পর্যায়ের যোগাযোগ সম্পন্ন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু কেবল জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাহেতু নজরুলকে এ দেশে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন, এমন নয়। পাকিস্তান আমলে শাসকদের নজরুল-প্রকল্প ছিল তথাকথিক মুসলিম মানসের রাজনৈতিক অভিপ্সা; যেখানে নির্বাক নজরুলকে মুসলিম পাকিস্তানের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ছিল নিরন্তর চেষ্টা। তাদের দৃষ্টিতে ‘হিন্দু রবীন্দ্রনাথে’র সমান্তরালে দাঁড় করানোর জন্য কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কোনো জুতসই বিকল্প ছিল না। যদিও ইকবালের পাণ্ডিত্য ও পাকিস্তান চেতনার যথার্থতা ছিল; কিন্তু তার উর্দুভাষিতার কারণে তাকে বাঙালি-মনে নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা দেয়ার চেষ্টা ছিল বৃথা। তাছাড়া পাকিস্তানের পশ্চিম অংশটা নিয়ে তো আর পাকিস্তানি শাসকদের কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না; তাদের ভয় ছিল বাঙালিয়ানার বিকাশমানতা নিয়ে। তাদের আশঙ্কা ছিল বাঙালিয়ানাকে ক্ষুণ্ণ করতে না পারলে একদিন পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে শাসক ও শাসক-অনুগামীদের মধ্যে এমন সব মূর্খতার জন্ম হয়েছিল যা রীতিমতো ভয়ের এবং হাস্যকরও বটে। আর এসবই হচ্ছিল ইসলামি তমুদ্দুনের দোহাই দিয়ে। সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলোতে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছিল; আর সে-সব ফরমানের সমর্থনে স্বাক্ষর করছিলেন বাংলা ভাষাভাষী কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই। এমনকি নজরুলের গান-কবিতা থেকে হিন্দুয়ানি শব্দের নির্বাসনের মাধ্যমে। এসব কবিতা শিশুদের উপযোগী করে পাঠ্যপুস্তকে সংযোজনও করা হচ্ছিল; তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, নজরুলের ‘তরুণের অভিযান’ কবিতাটির একটি অংশ, যেখানে নজরুল লিখেছিলেন, ‘নব-নবীনের গাহিয়া গান/সজীব করিব মহাশ্মশান।’ এই ‘মহাশ্মশান’ যেহেতু হিন্দুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জায়গা, সেহেতু সেটি পরিবর্তন করে ‘গোরস্তান’ করা হয়। এ ধরনের পরিবর্তন যারা করেছিলেন, তারা কখনো ভেবে দেখেননি, গোরস্তান সর্বদা সজীবই থাকে। মহাশ্মশান থাকে ঊষর।

পাকিস্তান আমলে নজরুলকে ঢাকায় আনতে কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তা নানা কারণে সফল হয়নি। তখন দু’দেশের মধ্যে নজরুল একটি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে অমীমাংসিত ছিল। তাছাড়া নজরুলকে পূর্ব-পাকিস্তানে প্রধান কবি করার প্রচেষ্টা থাকলেও এতে সবার মত ছিল না। যারা নজরুল-সাহিত্য ও চেতনার অখণ্ড বিকাশ চাইতেন, তারা সর্বদা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিলেন, আবার অনেকেরই খায়েশ ছিল পাকিস্তানি তমুদ্দুনের প্রধান কবি হবার। নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে মৌল সাযুজ্যের ধরনটা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। এই দুই সেরা বাঙালি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের বাংলাভাষী অঞ্চলে। নজরুল-জন্মের প্রায় বিশ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বয়সের দূরত্ব থাকলেও একই ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের জন্ম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাত্র কিছুদিন আগে বাঙ্গালী পল্টন ভেঙে দেয়ার পরে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম তল্পিতল্পা নিয়ে বন্ধু মুজফ্ফর আহ্মদের আশ্রয়ে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে চলে আসেন। যুদ্ধফেরত কবির জীবন-জগৎ সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল, তা একই সঙ্গে ঐতিহাসিক ও অভিজ্ঞতা সঞ্জাত। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু একটি মুসলিম পরিবারে নজরুলের জন্ম। নজরুল সারা-জীবনে এককটি বিষয় উপলব্ধি করেছিলেন- ভারতবর্ষ থেকে বিদেশি শাসন বিতাড়িত না হলে এ দেশের মানবিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সুদূর পরাহত। ইংরেজরা কেবল ছলে-বলে-কৌশলে এ দেশের শাসন ক্ষমতাই গ্রহণ করেনি, তারা ঔপনিবেশিক ব্যবসায় ও লুটতরাজের দ্বারা সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত করে তুলেছিল খুব অল্প দিনের মধ্যে।

নজরুলের লেখালেখির উত্তঙ্গুপর্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। আর একই বছরে নজরুলের ‘খেয়াপাড়ের তরণী’, ‘কোরবাণী’সহ বহু কবিতা মোহিতলাল মজুমদারের মতো সাহিত্য-সুহৃদদের হৃদয় আকর্ষণ করছে। আর এই বছরেই শেরে-বাংলা এ. কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে এবং নজরুল ও তার বন্ধু মুজফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-এর প্রকাশ হচ্ছে। আর এই হলো বাঙালি মুসলমানের নবযুগের সূচনা। এই সূচনা পর্বেই বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব; তার চলার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও নজরুলের মতো পূর্বসূরিরা। নজরুল মানসে যেমন স্বাদেশিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, তেমনি বঙ্গবন্ধুর মানস-গঠন ও কর্মের প্রেরণায় ছিল এ ধরনের মূল্যবোধ।

বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৪০ সালের দিকে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন, তখনো নজরুলের সক্রিয় সাহিত্য রচনার কাল। এই সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু সর্ব-ভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে চলে আসেন; এবং পূর্বতন নেতাদের সঙ্গে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় তিনি তার পূর্বসূরি নেতাদের মতো মুসলিম লীগের বিভাজিত রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন কৌশল হিসেবে। নজরুল পাকিস্তান আন্দোলনকে ‘ফাঁকিস্তান’ বলেও উপহাস করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে ভারত বিভাজিত করে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা জোরালো ছিল না। অখণ্ড ভারতবর্ষই তো ছিল, হিন্দু ও মুসলমানের অখণ্ড দেশ। তাছাড়া ভারত বিভাগের বিষয়টি ব্রিটিশ এদেশ ছাড়ার মাত্র কিছুদিন আগে আকস্মিকভাবে উত্থাপিত হয়েছিল। নজরুল জানতেন, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পরিকল্পনা ইংরেজের সর্বশেষ কূট-কৌশল।

নজরুল ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে চিরতরে নিস্তব্ধ হওয়ার আগে ‘বাঙালির বাঙলা’ শীর্ষক রচনায় বলেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালির মতো জ্ঞানশক্তি ও প্রেমশক্তি এশিয়া কেন, বুঝি পৃথিবীর কোনো জাতির নেই। কিন্তু কর্ম-শক্তি একেবারে নেই বলেই তাদের এই দিব্যশক্তি তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে।’ নজরুল সে সময়ে বাঙালিকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন, জাগিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন, ইংরেজ বিদায়ের পরে যেন নতুন কোনো অসুরের জন্ম না হয়। ‘এ আমাদের ভগবানের দান, এ আমাদের মাতৃ-ঐশ্বর্য! খবরদার, যে রাক্ষস একে গ্রাস করতে আসবে, যে দস্যু এ ঐশ্বর্য স্পর্শ করবে তাকে ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ দিয়ে বিনাশ করবো সংহার করবো।’ এ রচনায়, বাংলা অঞ্চলকে তিনি ‘বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করছেন, এর আগে যার বিরল উদাহরণ রয়েছে। বাঙালির বাঙালিত্ব যে আবার কোনো ষড়যন্ত্রে বিনাশ হতে পারে, তার জন্য তিনি অভয়মন্ত্র রচনা করছেন। বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাতে বলেছেন :

‘এই পবিত্র বাংলাদেশ

বাঙালি- আমাদের।

দিয়ে ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’

তাড়াব আমরা, করি না ভয়

যত পরদেশী দস্যু ডাকাত

‘রামা’দের ‘গামা’দের।’

বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’

কে জানত এই মন্ত্রই একদিন বাঙালির মুক্তির মন্ত্র হয়ে উঠবে। এই ‘জয় বাংলা’ই হয়ে উঠবে সেই মুক্তির স্লোগান! বঙ্গবন্ধুর স্লোগান।

নজরুলের সঙ্গে ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ ঘটে তার উল্লেখ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ব্রিটিশ আমলে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। এই বৃহত্তর ফরিদপুর শহরে নজরুল ৭ বার আগমন করেন। তার এই আগমন ছিল কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগদান, মৎস্যজীবী সম্মেলনে যোগদান, নিজের নির্বাচনী প্রচারের কাজে, কৃষি-শিল্প সংস্কৃতি সম্মেলনের অতিথি হিসেবে, জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে যোগদান, ফরিদপুর সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের ছাত্র সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে। এই শেষ সফরে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষভাবে নজরুলের সংস্পর্শে আসেন।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ তিনি লিখেছেন-

‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে। (আসল তারিখ ১২ আগস্ট ১৯৪১ খ্রি.) ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্সে শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন কবীর, ইব্রাহীম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না। ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ূন কবীর সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।...’

বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শেষাংশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন, তা আক্ষরিক অর্থে নজরুলই প্রথম ব্যবহার করেন তাঁর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায়। আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘ভাঙার গান’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। মাত্র কয়েক মাস পরে ১১ নভেম্বর গ্রন্থটি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। কারণ কবিতাটির পরতে-পরতে ছিল বাঙালির মুক্তির ইঙ্গিত-বিজয়ের ইঙ্গিত।

পূর্ণ অভিনন্দন

জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আজি-অন্তরীণ!

জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!

এক অভিন্ন চিন্তাচেতনা ও স্বপ্নের নায়ক ছিলেন নজরুল ও বঙ্গবন্ধু। জাতি-ধর্ম ভেদাভেদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন এই দুই মহান নেতা।

বিদ্রোহী কবি উচ্চারণ করেন-

‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/

মুসলিম তার নয়ন-মণি হিন্দু তাহার প্রাণ।

বঙ্গবন্ধু বলেন,

‘বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’

বিদ্রোহী কবি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতির রজত-জুবিলি অনুষ্ঠানের ভাষণে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চে ভাষণে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই।’ বিদ্রোহী কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শেষাংশে বলেন, ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে লড়াইয়ের ডাক দিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদরে মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণে তিনি আরো বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার সারাৎসারও ছিল তাই, ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-/বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত।’ সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্’ গানটিকে বাংলাদেশের রণসংগীতের মর্যাদা দেন।

স্বাধীনতার নজরুলকে বাংলাদেশে আনার জন্য বঙ্গবন্ধু পরিবার ও নজরুল পরিবারের মধ্যে প্রথম সরাসরি যোগাযোগ হয়। পরে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানোর অনুমতিদানের জন্য। অসুস্থ নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানো ভারতের জন্যও খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না; শুধু বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে তিনি রাজি হয়েছিলেন। কথা ছিল, জন্মজয়ন্তীর পরে নজরুলকে আবার ভারতে ফেরত পাঠানো হবে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে নজরুলকে ঢাকায় আনা হয়। এদিন ছিল এ দেশের মানুষের জন্য এক স্মরণীয় ঘটনা; তাদের প্রাণের কবি, স্বাধীনতার কবি তাদের মধ্যে উপস্থিত। হাজার হাজার লোক সেদিন মিছিল করে বিমানবন্দর থেকে নজরুলকে ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে কবি ভবনে নিয়ে আসেন। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সশরীরে কবিভবনে বিদ্রোহী কবির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে যান। তিনি নজরুলকে ‘বাংলার চিরন্তর বিদ্রোহী আত্মার প্রতীক ও ইতিহাসের রূপাকার’ বলে উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কবির জন্য মাসিক এক হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। তিনি ডেপুটি সেক্রেটারি পদের একজন কর্মকর্তাকে এই দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত করেন। কবিকে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করা হয়। কবিভবনে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উড্ডীনের ব্যবস্থা রাখা হয়। পরের দিন নজরুলের জন্মদিনে মানুষের ঢল নামে; হাজার হাজার মানুষ কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কবিভবনে গমন করে। এখানে কবির যত্নে ও চিকিৎসার সর্বোত্তম ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘদিন অসুস্থ ও অযত্নে কবির পিঠে ও কোমরে ক্ষতের সৃৃষ্টি হয়। কবিভবনে উন্নত চিকিৎসা ও পরিচর্যার ফলে কবির স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সম্মান-সূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সম্মাননাপত্রে বলা হয়, ‘দেশকালের জরা-শোক-অবক্ষয়-অন্ধকারকে নীলকণ্ঠের মতো ধারণ করে প্রজ্জ্বলন্ত আকাঙ্ক্ষার, আনন্দের, সংগ্রামের আলোকিত চেতনাকে যাঁরা বিশ্বলোকে পৌঁছে দিতে সক্ষম, তারাই মহৎ। তেমনি এক মহত প্রতিভা আপনি, কাজী নজরুল ইসলাম।’

নজরুলের বাণী ও প্রেরণা যে বঙ্গবন্ধুর জীবনে আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর কর্মের মাধ্যমে তার প্রকাশ সম্পন্ন হয়েছে। নজরুল স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিদেশি শোষণমুক্ত একটি স্বাধীন বাঙালি জাতির, বঙ্গবন্ধু কর্মের মাধ্যমে তার রূপদান করেছিলেন। হটিয়ে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি দুঃশাসনকে। তাই একই বৃত্তে এই দুই মহান ব্যক্তির অবস্থান বাঙালির জাতির ইতিহাসে সবকালে সমানভাবে প্রজ্জ্বলিত থাকবে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাইরের শাসন-শোষণমুক্ত হলেই, শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষের আন্দোলন শেষ হয়ে যায় না। দেশি শাসকরাও অনেক সময় বিদেশি শাসকদের মতো শোষণ-শাসনে অবতীর্ণ হয়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর চেতনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অংশ; আর আমরা যদি তা ভুলে যাই, তাহলে মনে রাখতে হবে, তাদের শিক্ষা আর আমাদের ওপর কাজ করছে না।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে, অসুস্থ নজরুলকে দেখতে গিয়ে তিনি তার বিছানায় কিংবা চেয়ারে পর্যন্ত বসতেন না। বাংলাদেশের জাতির পিতা হাসপাতালের মেঝেতে বসে অসুস্থ কবির খোঁজখবর নেয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেছেন। সর্বকালের সেরা এই দুই মহান মানুষের কর্ম ও শিক্ষা হোক আমাদের প্রেরণার উৎস। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকতার দিক থেকে সমান্তরাল অবস্থানে রয়েছেন।’ তিনি অনুষ্ঠানে আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া। নজরুলও চেয়েছেন বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে। দু’জনের স্বপ্ন ছিল এক ও অভিন্ন। দু’জনই ছিলেন বিদ্রোহী। একজন সাহিত্যে, অন্যজন রাজনীতিতে। এজন্য একজনকে বলা হয় ‘পোয়েট অব লিটারেচার’, অন্যজনকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’।” পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের বিশেষ সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুতনয়া আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন দেশের শোষণপীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম-আন্দোলন করেছেন, কারাবরণ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, ঠিক তেমনি নজরুলও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কথা লেখনীর মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন। আর এ কারণেই কারাবরণ করতে হয়েছে। তাই একদিকে বাংলা সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তেমনি অন্যদিকে রাজনীতির কবি শেখ মুজিবুর রহমান।’

একটি কথা সত্য, পাকিস্তানের তেইশ বছরে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে অনেককে পেয়েছিলেন; কিন্তু ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের আগে কবিদের খুব একটা সঙ্গে পাননি। এই সময়-পর্বে নির্বাক নজরুলের গান-কবিতা ও জীবনের সংগ্রামশীল চেতনা বঙ্গবন্ধুর পাথেয় ছিল। এই দুই বাঙালি যতদিন বাঙালির চেতনায় ভাস্বর থাকবে, ততদিন বাঙালি বাঙালির থাকবে।