বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু
দুলাল মাহমুদ
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ক্রিকেট কি শুধু পরিসংখ্যানের খেলা? পরিসংখ্যানে কতটুকু সত্য থাকে? কোনো মহাকাব্যিক ইনিংস কি অনুভব করা যাবে পরিসংখ্যান দেখে? ১৯৬০ সালে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টাই টেস্টের পরতে পরতে যে উত্তেজনা ও অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা স্নায়ুকে বিকল করে দিয়েছিল, তা কি ফুটে ওঠে পরিসংখ্যানের কঙ্কালে? ক্রিকেটের বর্ণাঢ্য চরিত্র ‘বুড়ো শয়তান’খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস বা সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সম্মানিত ডন ব্রাডম্যানকে পরিসংখ্যানে কতটুকু চেনা যায়? চেনা যায় না বলেই যুগে যুগে ক্রিকেট লিখিয়েরা তাদের মিষ্টি-মধুর কলমে পরিবেশন করেছেন ক্রিকেটের রূপ-রস-সৌন্দর্য। তাদের কলমের আঁচড়ে স্মরণীয় হয়ে আছে মহান ক্রিকেটারদের অমর কীর্তি আর মহাকাব্যিক ইনিংসের লাবণ্য ও সুষমা। সাহিত্যের অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায় যেমনটি বলেছেন : ‘আসলে ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে লেখা মানে যে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান পেশ করা নয়, তাকে যে প্রাণবন্ত করে তোলা যায়, একটি সুন্দর ইনিংস যে মোৎজার্টের একটি সিম্ফনি বা বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের বিলম্বিত ও মধ্যলয়ের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারে, এই আবিষ্কারই তো ওইসব লেখার প্রতি আমাদের মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল।’ ক্রিকেট যেমন ব্রিটিশদের গর্ভজাত, তেমনি ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেট সাহিত্যও তাদের দান।
বাঙালির রক্তে ক্রিকেট নেই- পঙ্কজ রায় অল্প কিছু পরিমাণে এবং সৌরভ গাঙ্গুলী তা পুরোপুরি খণ্ডন করে দিয়েছেন। এখন তো বাঙালিদের একটি দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলছে। তবে ক্রিকেট খেলায় নাম কুড়ানোর আগেই সমঝদার হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে বাঙালিরা। যদিও কথাসাহিত্যিক শঙ্করের মতো বাঙালিরা শুরুতে মনে করতেন : ‘ক্রিকেটটা কোনো খেলা নয়, কলোনিয়াল কালচারের একটি বর্বর প্রকাশ মাত্র, ফলে দু’জন লোক লাঠি হাতে সারাদিন খাটায় একাদশ নির্দোষ মানুষকে।’ অথচ একদিকে বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে মজেছে ক্রিকেট রসে। আস্তে-ধীরে বাঙালিরা আত্মস্থ করে নিয়েছেন ‘ক্রিকেট-কালচার’কে। আর এ থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলা ক্রিকেট-সাহিত্যের। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে পূর্ণতা দিয়েছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু (জন্ম : ২১ অক্টোবর, ১৯২৮, হাওড়া, কলকাতা)।
বাঙালির জীবনচর্যা ও সংস্কৃতিতে বহুল উচ্চারিত শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখনী নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্যিক হর্ষ বসু : ‘সে এক গভীর বিস্ময়, বাকরুদ্ধ স্তব্ধতা। কেবলই মনে হয়ছে, শুধু নিষ্ঠা বা মেধার জোরে এমন কালজয়ী কাজ করে ওঠা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জন্মগত বিরল প্রতিভা। শঙ্করীপ্রসাদ সেই বিরল প্রতিভাসম্পন্নদের মধ্যে একজন- যারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। কিন্তু যাদের সৃষ্টি প্রবহমান মানব সভ্যতাকে এক অপতিরোধ্য ঋণের জালে বেঁধে রেখেছে।’ জীবন ও সৃষ্টির নানাদিক নিয়ে মেতে উঠলেও শঙ্করীপ্রসাদ বসু স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলার ‘নেভিল কার্ডাস’ হিসেবে। ‘খেলার মাঠকে তিনি সারস্বত সাধনার ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন।’ প্রথম যৌবনে তিনি যখন ছিলেন ক্রিকেট নেশাগ্রস্ত, তখন ‘ক্রিকেটের নেশা আমাকে যখন পেয়ে বসল তখন একদিকে জীবনের মধুর শীতের দুপুরগুলো কাটাতে শুরু করলুম ইডেনের গ্যালারিতে বসে, অন্যদিকে বাড়ি ফিরে এসে চোখ ডুবিয়ে দিলুম ইংরেজিতে লেখা ক্রিকেটের অপূর্ব সব কাহিনিতে। ক্রিকেট যারা ভালোবাসে- তারা খেলা শুদু মাঠেই দেখে না, বইয়ের পাতাতেও দেখে থাকে’- এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটের রসকে কাগজে-কলমে রূপায়িত করেছেন। চোখের দেখা, ইংরেজি ক্রিকেট সাহিত্য আর পরিসংখ্যানের ফাঁকফোকর গলিয়ে আহরণ করেছেন ক্রিকেটের মাধুর্য। মহাজীবনের গাঁথা (১৯৫৩), মধ্যযুগের কবি ও কাব্য (১৯৫৫) ও চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির (১৯৬০) লেখক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ১৯৬০ সালে ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ লিখে কাঁপিয়ে দেন বাংলার ক্রিকেটানুরাগীদের। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন : ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসুও সেই দুর্লভ বাকশক্তির অধিকারী, অন্যের মনশ্চক্ষুকে যা অতি অকেশে খুলে দেয়। ছাত্রমহল জানে, তিনি একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক; ক্রীড়ামহল জানে, তিনি একজন দক্ষ দর্শক এবং পাঠকমহল জানে, তিনি একজন শক্তিমান লেখক, বাচনভঙ্গির চাতুর্যে নেপথ্যের ঘটনাকেও যিনি দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন। আমি তার এই বই (ইডেনে শীতের দুপুর) পড়েছি এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ঘরে বসেই ক্রিকেট খেলা দেখেছি। দেখা সম্ভব হতো না, তার ভাষা যদি-না বর্ণনাময় এবং বর্ণনা যদি-না নিখুঁত হতো। আসল কথা, ক্রিকেটকে তিনি ভালোবাসেন। ভালোবাসার বস্তুটিকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। দূরের থেকে কাছে টেনে এনেছেন। এ অতি শক্ত কাজ, তাতে সন্দেহ নেই।’ উপমা দিয়ে তাকে বাক্সময় সাকার রূপ দিয়েছেন, তা যে কবিকৃতি, তাতে সন্দেহ নেই।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘রমণীয় ক্রিকেট’। শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটকে মনে করেন ‘খেলার রাজা’, ‘ক্রিকেট মহান খেলা’। কারণ, ‘ক্রিকেটের সাহিত্য আছে। খেলার সাহিত্য যদি একমাত্র ক্রিকেটের থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ক্রিকেটই সবচেয়ে জীবনময় খেলা।’ ...‘জীবন বলতে কেবল উত্তেজনা বোঝায় না। জীবন অনেক ব্যাপক। উত্তেজনা, আবেগ ও ধীরতার নানারূপী বিন্যাস সেখানে। জীবনে আছে সূচনা ও সমাপ্তি। উভয়ের মধ্যে ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তনের তরঙ্গ গতি। ক্রিকেট সেই খেলা। ক্রিকেট জীবনের ক্রীড়া-সংস্করণ’। তিনি অসাধারণ যে দৃশ্যপট এঁকেছেন, তাতে ক্রিকেট রাজ্যে সবাই রাজা : ‘এসব কথাও ভুলে যান। মনে রাখুন একটি শীতের অপরাহ্নকে। সোনালি রোদের মদ। সবুজ মাঠ। আতপ্ত সুতৃপ্ত অবসর। আপনি সেই অবসরের অধীশ্বর। আপনার ইচ্ছার সম্মানে সাদা ফানেলে ঢাকা ব্যাট-বল হাতে কয়েকটি অভিনেতা। আপনি রাজা, সত্যই রাজা। রূপকথাগুলো এখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি- স্বপ্নে ও কামনায় একটি নিতান্ত রাজা। রাজা হয়ে বসে আপনি খেলা দেখছেন- দেখছেন খেলার রাজাকে। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই খেলার রাজত্বে। (রমণীয় ক্রিকেট)। এছাড়া ‘রমণীয় ক্রিকেট’ গ্রন্থে ‘চায়ের পেয়ালায় ক্রিকেট’, ‘রমণীয় ক্রিকেট’, ‘নাতি রমণীয় ক্রিকেট’, ‘সমালোচকের সমালোচক’, ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম’, ‘ক্রিকেটের কুরুক্ষেত্র’, ‘ক্রিকেটারের বউ’, ‘কলমে ক্রিকেট’, ‘ইডেন-গার্ডেনে’ লেখাগুলো ভিন্ন স্বাদের।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসের সব মহান ও মহৎ চরিত্ররা। ডব্লিউ জি গ্রেসের মতো এতটা আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য সব কীর্তি ও কুকীর্তি আর কোনো ক্রিকেটারের ঝুলিতে নেই- এ কথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটগাথার এই নায়কের গোটা জীবনটাই ক্রিকেটময়। ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেললেও ৪৪ বছরের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ১২৪টি সেঞ্চুরি ও ২৫১টি হাফ-সেঞ্চুরিসমেত ৮৭০ ম্যাচে ৫৪ হাজার ২১১ রান, ২৮০৯টি উইকেট আর ৮৭৬টি ক্যাচ নিয়ে তিনি এক কিংবদন্তি হয়ে আছেন। ‘দ্য ডক্টর’ নামে খ্যাত গ্রেসকে বলা যায়, আধুনিক ব্যাটিং পদ্ধতির প্রবর্তক। বিশাল চেহারা, লম্বা দাড়ি ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির এই ক্রিকেটার তার মহত্ত্ব, তার চালাকি ও তার অনবদ্য ছেলেমানুষি দিয়ে ক্রিকেটের রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছেন। ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এই চরিত্র ডব্লিউ জি গ্রেসকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে : ‘ক্রিকেট, গ্রেসের কাছে ক্রীড়ামাত্র ছিল না, ছিল জীবনের অঙ্গ। ক্রিকেট এবং জীবনবোধ- একই কথা এবং জীবন যেহেতু সাজানো ড্রইংরুম নয়, তাতে কৌতুক আছে, কৌশল আছে, ভদ্রতা এবং পরিমিত মাত্রায় ইতরতা, সবই আছে- গ্রেসের ক্রিকেটেও তাই ছিল। আনন্দোচ্ছ্বল দুর্বৃত্ততার গুণে জিতে গিয়েছিলেন গ্রেস। তার চরিত্রও ওই রকমই ছিল। সাধারণ ইংরেজদের চরিত্রও তাই সহানুভূতি, সহৃদয়তা, সংকীর্ণতা ও রক্ষণশীলতার বিচিত্র সমন¦য়। অন্য বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও অনেকে খেলার মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু তাদের সেই ব্যক্তিরূপ তাদের জাতিরূপের একাংশকে মাত্র প্রকাশ করেছে। অপরপক্ষে ডা. গ্রেস ছিলেন সব সাধারণ ইংরেজের প্রতিনিধি। সুতরাং সাধারণের স্বভাব অনুযায়ী তিনি খেলা থেকে কৌতুকময় দুষ্টুমি বা ভদ্র স্বার্থপরতা বাদ দিতে পারেননি।’ (বল পড়ে ব্যাট নড়ে)।
সুরে, সুধায় ও জীবনকে যারা মিলিয়েছেন ক্রিকেটের রাখীবন্ধনে, সেই ক্যারিবীয় দ্বীপের ক্যালিপসো সুর।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’। এই গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত। মহান ক্রিকেটার ভিক্টর ট্রাম্পার ‘বিদ্যুতের অক্ষরে ক্রিকেটে মহাকাব্যের অনেকগুলো পৃষ্ঠা লিখে গিয়েছিলেন মাঠে-মাঠে’। স্বপ্নের নায়ক ট্রাম্পারকে জীবনে প্রথম আউট করার পর স্পিনার আর্থার মেইলির অনুভূতি হয়েছিল এমন : ‘অপসৃয়মাণ সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে কিন্তু কোনো জয়ের আলো ছিল না। একটি সুন্দর পাখিকে আমি মেরে ফেলেছি- হ্যাঁ, ঠিক তাই করেছি- আমি অনুভব করেছিলুম।’ ট্রাম্পার মারা যাওয়ার পর বলা হয়েছিল- ‘ঈগলের পাখা থেমে গেছে, এখন কাক আর চিলের কাল’। তার সম্পর্কে লিখেছেন : ‘পরমোজ্জ্বল সুপ্রখর প্রতিভা, অথচ সদানন্দ সুস্মিত মানুষ। প্রচণ্ডতম আক্রমণের মধ্যেও সৌজন্যস্নিগ্ধ। সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাট করতে গিয়েছেন। মাঠ ভিজে, ভিজে মাঠের মহাপাতক জ্যাক স্যান্ডার্স বল করছেন। তার প্রথম বল ট্রাম্পারকে হারিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্যান্ডার্স ভাবলেন- পেয়েছি। সবাই তাই ভাবল। ট্রাম্পার হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে বললেন- পুরোনো দোস্তের সঙ্গে একি ব্যবহার? যা হোক ভায়া, আজ তোমার দিন কি আমার দিন। সে দিনটা কারো নয়- একমাত্র ক্রিকেট-দেবতার। ট্রাম্পার ষাট মিনিটে একটি দেবভোগ্য সেঞ্চুরি করলেন।’ (ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট)।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘নটআউট’। ১৯৬৪ সালে ইডেন গার্ডেনে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচের শীতের তীব্র হাওয়া হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও পাঁচ দিনের খেলা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। ক্রিকেট থেকে ‘অনিত্যের মধুপান’ করেছেন। তার রোমান্টিক চোখে ক্রিকেটীয় সুধা পান করার পাশাপাশি ক্রিকেট মাঠের রসিকতাটুকুও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। পঞ্চ দিন স্থায়ী বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশটি তার কাছে মনে হয়েছে বিশ্বজীবনের খণ্ডরূপে। তাই ম্যাচ শেষে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর হৃদয়ে বয়ে যায় আরেক অনুভূতির মিশ্র অনুভূতি: ‘... আমরা সকলে যখন পঞ্চম দিনের শেষে হাজির হলুম- যখন মাঠ ছেড়ে যাবার সময় এল- তখন সহসা অভাবিত নিঃস্বতায় ভরে গেল মন- ক্রিকেট হারালুম বলে নয়, অনেক মানুষের সঙ্গ হারালুম বলে। ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের সঙ্গ পাই আমরা- আজ ক্রিকেট আমাদের সামাজিক উৎসব।’
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট শঙ্করীপ্রসাদ বসু বাংলাদেশে খুব বেশি পরিচিত বলে মনে হয় না। যে কারণে তার কোনো গ্রন্থ খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। তবে ক্রিকেট-পিপাসু কিছু অনুরাগী আছেন, যারা তার লেখার সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচিত। এদের একজন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নূরুল আনোয়ার। রবীন্দ্রসংগীত ও ক্রিকেটের পাগলপ্রেমিক এই ভদ্রলোক শুধু তার অনুরাগীই নন, তাকে ‘সর্বদাই অত্যুক্তিতে উদ্ব্যস্ত’ করে চলেছেন। যে জন্য প্রতিটি গ্রন্থে ড. নূরুল আনোয়ারকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন লেখক। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে অধ্যাপক নূরুল আনোয়ারের মূল্যায়নটা এমন : ‘ইডেনে শীতের দুুপুর’ (১৯৬০), ‘রমণীয় ক্রিকেট’ (১৯৬১), ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ (১৯৬২), ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’ (১৯৬৩), ‘নট আউট’ (১৯৬৫), ‘লাল বল লারউড’ (১৯৬৭) এবং ‘সারাদিনের খেলা’ (১৯৭৬)- এই সাতটি ক্রিকেট-ক্লাসিকের যে কোনোটিই পড়তে থাকলে ঐন্দ্রজালিক কথোপকথন, দুর্লভ বাকশক্তি, চাতুর্যপূর্ণ লেখার শক্তি ও মনোরমময় বর্ণনা পাঠককে নিমেষে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলবে (যেমন হয়ে থাকে উচ্চতর প্রতিভাবান গায়ক-গায়িকার উচ্চতর রীতির গান শুনে), স্বচক্ষে দেখা বা শোনা ক্রিকেট খেলা, খেলোয়াড়দের চরিত্র, ক্রিকেট-ঘটনা পাঠকের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বিমূর্ত ভাব সৃষ্টি করবে। পাঠকের সৌভাগ্য, বৈষ্ণব সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছ থেকে- জীবন থেকে টেনে এনে, অন্তরঙ্গ অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি ক্রিকেটের বহু চরিত্র ও ঘটনাকে তারা অনুপম সাহিত্য মাধ্যমে পড়তে পেরেছেন।
বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের রূপকার শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেটবিষয়ক সাতটি অসাধারণ গ্রন্থ লিখে চুকিয়ে দিয়েছেন তার লেনদেন। এ কারণে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন : ‘ক্রিকেট লেখার সময় সারাক্ষণ মাথায় ক্রিকেট ঘুরত। অনেকগুলো ক্রিকেট বই লেখার পর মনে হলো, আমার যতদূর সাধ্য লিখে ফেলেছি। আরও ভালো কিছু লেখার ক্ষমতা নেই। এখন ইতি টানাই উচিত। তাছাড়া আমার মূল কর্মবৃত্তির সঙ্গে এই ক্রিকেট-লেখক ভূমিকার একটা সংঘাত ছিলই।’
শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেট লেখা থেকে দূরে সরে গেলেও পাঠকরা কিন্তু তাকে কখনো ভুলতে পারেনি। ক্রীড়া সাহিত্যের যে রস তিনি উপহার দিয়েছেন, তা পাঠকদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। আর কোনো লেখক এখন অব্দি তার শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু পাঠকের মনের মণিকোঠায় চির-অম্লান হয়ে আছেন। তার লেখা এখনকার পাঠকদের দারুণভাবে আপ্লুত করে। আর এ কারণে তার সাতটি গ্রন্থের সমন¦য়ে ১৯৭৬ সালে দুই খণ্ডে ‘ক্রিকেট অমনিবাস’ এবং ১৯৯৯ সালে বাছাইকৃত লেখা নিয়ে ‘বাছাই ক্রিকেট’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
এখন অনেক পাল্টে গেছে ক্রিকেট। এসেছে ওয়ানডে ক্রিকেটের জোয়ার। ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার বোলের মতো ক্রিকেটেও দ্রুততার ঝড় বইছে। ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে যেমন উত্তাল সমুদ্রের প্রলয়ঙ্করী ঢেউ, তেমনি বোলারদের বলে মহাকাশ যানের তীব্র গতি। ক্রিকেটে এখন রঙের বাহার। নানা রঙে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। ২৪ ঘণ্টাই এখন ক্রিকেটের। দিনেও ক্রিকেট, রাতেও ক্রিকেট। ফ্লাড লাইটের আলোয় ক্রিকেটের রূপ খোলতাই হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ড্রইংরুমে নিয়ে এসেছে ক্রিকেটকে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যায় ক্রিকেটের মাধুর্য। টিভি আম্পায়াররা যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে সিদ্ধান্ত দেন, তেমনি দর্শকরা একই বল নানা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে পারেন। সঙ্গে নানা গ্র্যাফিক্স ও তথ্যের সমাহার। ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেটার ও ক্রিকেট পণ্ডিতদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। সবই টাটকা। এখন সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্য ক্রিকেট! পণ্য তো বটেই; কেননা ক্রিকেটকে ঘিরে বিশাল ব্যবসা গড়ে ওঠেছে। আর এই ব্যবসায়ীরা তাদের মর্জিমাফিক পরিচালনা করছেন ক্রিকেটকে। যে কারণে ক্রিকেটের সেই বনেদীয়ানাটা হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে কত গল্প আর কাহিনির ঘনঘটা। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া আলাদীনের চেরাগের মতো ক্রিকেটের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় দর্শকের দরবারে হাজির করলেও তাতে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। কল্পনাশক্তি আর রসের ভিয়েন মিশিয়ে কলমের ক্রিকেটের ঐন্দ্রজালিকতা পাঠককে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়। অথচ ক্রিকেটের নতুন দিনের সুর, ছন্দ ও রোমাঞ্চকে শব্দে শব্দে খোদাই করার জন্য নেভিল কার্ডাস, জ্যাক ফিঙ্গলটন কিংবা পেলহ্যাম ওয়ার্নারের মতো সহজাত সৃজনী ক্ষমতার অধিকারী ক্রিকেট লিখিয়েদের অভাব এখন দারুণভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। এরা ক্রিকেট সাহিত্যকে মহাসমৃদ্ধশালী ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পঙ্ক্তিতে স্থান করে দেয়ার পাশাপাশি চিরঞ্জীব করে রেখেছেন সেই সময়ের ক্রিকেটার ও ক্রিকেটকে। বাংলা ভাষায় ক্রিকেটকে ভালোবেসে এই কাজটি করেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তিনি স্বপ্ন, কল্পনা ও ভালোবাসা দিয়ে বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যকে যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা এ কালের ক্রিকেট রসিকদের কাছে মনোবেদনার কারণ হয়ে আছে। কেননা শঙ্করীপ্রসাদ বসু সরে দাঁড়ানোর পর বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য যেন হঠাৎ থমকে গেছে। কলমের ক্রিকেটের সেই মাধুর্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির ব্যাটে-বলে যখন নতুন দিনের সূর্য, তখন বাঙালির ক্রিকেট সাহিত্যে যেন অস্তগামী সূর্যের আভা। বাঙালিদের একটি দল যখন টেস্ট ক্রিকেট খেলছে এবং সৌরভ গাঙ্গুলি শুধু ভারতকে নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, বিশ্ব ক্রিকেটে গড়ছেন নতুন নতুন মাইলফলক, তখন বাঙালি ক্রিকেট লিখিয়েদের কলমে কেন বেলা শেষের গান? এমন একটা সন্ধিক্ষণে বারবার মনে পড়ে যায় শঙ্করীপ্রসাদের কথা। তার মিষ্টি-মধুর কলমের কথা।