আমাদের আবার শকুনের কী প্রয়োজন

ইনাম আল হক

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চার দশক আগে আমরা খেয়াল করেছিলাম, কোথাও রাজশকুন চোখে পড়ে না। প্রথম দিকে আমরা এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করিনি। রাজশকুন দেখতে পাই না তো কী হয়েছে, রাজশকুনের সংখ্যা তো সব সময়ই কম ছিল। ভাগাড়ে অনেক শকুন নামলে বড়ো জোর একটি রাজশকুন আসত। সংখ্যায় কম বলেই সম্ভবত পাখিটি আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু অনেক দিন কোনো রাজশকুন না দেখে আমরা শেষে চিন্তায় পড়েছিলাম- পাখিটি কি উৎখাত হয়ে গেল দেশ থেকে! তখন সবাই মিলে খুঁজতে থাকলাম রাজশকুন; লাল মাথা আর কমলা পায়ের সেই সুদর্শন শকুনটি। খবর পেলাম সুন্দরবনে দু-একটি আছে। তখন সুন্দরবনে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করলাম। রাজশকুন পেলাম না। বাওয়ালিদের বললাম, রাজশকুনের সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার মিলবে। তারা মেলা গালগল্প শোনালেন; কিন্তু রাজশকুন দেখাতে পারলেন না। অবশেষে আমরা মেনে নিলাম, বাংলাদেশ থেকে রাজশকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বিশ শতক শেষ হলো তো বাংলাদেশে রাজশকুনও শেষ হলো। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ‘সাবেক’ পাখির তালিকায় যুক্ত হলো রাজশকুনের নাম। রাজশকুন বিলুপ্ত হলেও বাংলাদেশে বাংলা শকুন আছে। শুধু ‘শকুন’ বললে এ দেশে বাংলা শকুনই বোঝায়। বাংলার নামেই পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম হয়েছে ‘জিপস বেজ্ঞালেনসিস’। এক সময় এদেশে লাখ লাখ বাংলা শকুন ছিল। প্রতিটি শহরের আবর্জনা-স্তূপে এবং প্রতিটি গ্রামের ভাগাড়ে এদের দেখা মিলত। রাজশকুন বিদায় নেওয়ার ফলে একটি প্রতিযোগী কমেছে বলে বাংলা শকুনের একটু সুবিধাই হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। বাংলা শকুনও এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে এখন শকুন নেই বললেই চলে। শকুন না থাকায় নদীতে, হাওরে ও উপকূলীয় চরে আমরা প্রায়ই গৃহপালিত জীবজন্তুর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকতে দেখি। লোকালয় থেকে পশুর মৃতদেহ সরালেও জনবিরল প্রান্তর, জলাশয় ও বনে তা আমরা কখনও করি না; কোনোদিন করতে পারব না। শকুনের সাহায্য ছাড়া এসব মৃতদেহ দ্রুত অপসারণ করা আমাদের সাধ্যে কুলাবে না।

এ সপ্তাহেই একটি সংবাদ রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক বিরাজ করছে। সংবাদে বলা হয়েছে, অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরুর সংস্পর্শে এসে ছয়টি উপজেলায় বহু লোক আক্রান্ত হয়েছে। আমরা জানি, অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু স্পর্শ করলেও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মৃত গরুর দেহেও অ্যানথ্রাক্সের রোগজীবাণু বা ‘স্পোর’ দীর্ঘদিন টিকে থাকে এবং তা স্পর্শ করলে অন্য জীব ও মানুষ সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। তবে শকুন এর ব্যতিক্রম। অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু মারা গেলে তা খেয়ে শকুন সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, অ্যানথ্রাক্সের স্পোর শকুনের পেটে পুরোপুরি ধ্বংস হয়। অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু খেলেও শকুনের মলে অ্যানথ্রাক্সের স্পোর পাওয়া যায় না। শকুনের মলে মৃতদেহের প্যাথোজেন বা রোগজীবাণু সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। রোগজীবাণু ধ্বংসের এ অসাধারণ দক্ষতার ফলেই কোটি কোটি বছর ধরে মৃতদেহ খেয়ে শকুন টিকে আছে।

মৃতদেহের রোগজীবাণু শকুনের পেটে সহজেই যেমন ধ্বংস হয়ে যায়- ইঁদুর, কুকুর ও কাকের মতো বিকল্প শবভুক প্রাণীর পেটে তা হয় না। তাই এদের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স, খুরারোগ, জলাতঙ্কের মতো অসুখ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। মৃতদেহ খাওয়ার প্রতিযোগিতায় শকুনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন ছিল বলে আগে এদেশে ইঁদুর ও লাওয়ারিশ কুকুরের মাত্রাতিরিক্ত বংশবৃদ্ধির ভয় ছিল না। এদের সংখ্যার ওপর শকুনের প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণটি খর্ব হওয়ায় এখন জলাতঙ্ক রোগ বেড়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান জলাতঙ্ক রোগ রোধ করার জন্য ভারত ১০ বছরে ৮০ লাখ কুকুর বন্ধ্যা করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এশিয়া মহাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার জলাতঙ্ক ভ্যাকসিন বিতরণ শুরু করেছে।

শবভুক বলে শকুনকে এদেশের মানুষ ঘৃণা করতেই অভ্যস্ত ছিল। সমাজের শোষকদেরই আমরা শকুনের সঙ্গে তুলনা করেছি। কুদৃষ্টিকেই আমরা শকুনি দৃষ্টি আখ্যায়িত করেছি। কিন্তু আসলে শকুনের মতো নিরীহ প্রাণী আর হয় না। মৃতদেহ ছাড়া শকুন কিছুই স্পর্শ করে না; জীবিত প্রাণীর কোনো ক্ষতি কখনও সে করে না। শকুনের মতো উপকারী প্রাণী কমই আছে। শকুন প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা বুঝতে পেরেছি, এ পাখি আমাদের পরিবেশের জন্য কত প্রয়োজনীয় ছিল। এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনস্বাস্থ্যের খাতিরেই শকুন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমরাও বলতে বাধ্য হচ্ছি, শকুন আমাদের চাই। এখন আমরা শকুন বিলুপ্তির বিরূপ প্রভাব নিয়ে নানা তথ্য জানতে পারছি। তাই শকুন রক্ষা করার জন্য এখন বাংলাদেশের মানুষও সোচ্চার হচ্ছে। বন বিভাগ ও আইইউসিএন ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব শকুন সংরক্ষণ দিবস পালন করবে।

বাংলাদেশে আগে সাত প্রজাতির শকুন দেখা যেত। এর মধ্যে চার প্রজাতির শকুন এদেশের অনিয়মিত আগন্তুক। এদের নাম ইউরেশীয় গৃধিনী, হিমালয়ী-গৃধিনী, ধলা শকুন ও কালা শকুন। বাকি তিন প্রজাতির শকুন বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। এদের নাম বাংলা শকুন, সরুঠুঁটি শকুন ও রাজশকুন। ৪০ বছরে সরুঠুঁটি শকুন ও রাজশকুন বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কয়েকশত বাংলা শকুন এখনও বেঁচে আছে। এরাই বাংলাদেশের শেষ শকুন। বাংলাদেশের শেষ শকুনগুলো এখন দেখতে পাই সিলেট ও খুলনা বিভাগে। সংখ্যা বড়ো জোর ৩০০ হবে। এ শেষ শকুনগুলোও দু-চারটি করে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে অতিপ্রয়োজনীয় ও অতুলনীয় এ পাখি এখন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

শকুন বিলুপ্তির কারণ অবশ্য আমাদের অজানা নয়। শকুন মৃত্যুর বৃহত্তম কারণের নাম ‘ডাইক্লোফেন’ ও ‘কিটোপ্রোফেন’। ৪০ বছর ধরে এ উপমহাদেশে পশু চিকিৎসায় এসব সস্তা বেদনাহর ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ওষুধের বিষক্রিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের শতকরা ৯৯ ভাগ শকুন মারা গেছে। ২০০৬ সালে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেন ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকারও অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে এর ব্যবহার দিব্যি বহাল আছে। এর পাশাপাশি মানুষের ব্যবহারের জন্য যে ডাইক্লোফেন আছে, তা-ও গবাদি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, শকুনের অতিদ্রুত বিলুপ্তির একমাত্র কারণ পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার। আহার ও বাসস্থানের অভাবকে এমন স্বল্প সময়ে শকুন বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে না। কোনো প্রাকৃতিক অবনতি দিয়ে মাত্র ৪০ বছরে শকুনের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ব্যাখ্যা করা যায় না।

ভাগ্যক্রমে ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেনের বিকল্প একটি নিরাপদ ওষুধ বাজারে আছে; নাম ‘মেলোক্সিক্যাম’। মেলোক্সিক্যাম শকুনের জন্য বিষাক্ত নয়। পশু চিকিৎসায় মেলোক্সিক্যাম ব্যবহার করলে গরুও বাঁচে, শকুনও বাঁচে। মেলোক্সিক্যাম ব্যবহারের বিপক্ষে একটাই বড় কারণ আছে; তা হলো ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেনে বাজার ছেয়ে আছে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে ডাইক্লোফেনের ব্যবহার যতটা কমেছে, কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার ততটাই বেড়ে গেছে। শুধু পশু চিকিৎসার একটি ওষুধ দিয়ে ৪০ বছরের মধ্যে অজান্তে আমরা ভারতবর্ষের কোটি শকুন শেষ করে ফেলেছি- এটা বিশ্বাস করাও কঠিন। আরও কঠিন বাজার ছেয়ে ফেলা এ ওষুধগুলোর ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করা।

শকুনের মৃত্যু রোধ করা কঠিন; কিন্তু অসাধ্য নয়। বাংলাদেশের শেষ শকুনগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেন ব্যবহার শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। মেলোক্সিক্যামের মতো ভালো বিকল্প যখন রয়েছে, ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেন ব্যবহার বন্ধ না করার কোনো কারণ নেই। বন বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং আইইউসিএন শকুন রক্ষায় যা করছে, তা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমাদের আরও দ্রুত ও আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু নগরকেন্দ্রিক ও শহরভিত্তিক উদ্যোগে এত বড় কাজ এত দ্রুত করা সম্ভব না-ও হতে পারে; প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব মানুষ, যারা নিজেরাই নিজের ও প্রতিবেশীর রুগ্ণ পশুর চিকিৎসা করেন, তাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, পশু চিকিৎসায় এখন সস্তা ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেন ব্যবহার করায় গবাদি পশু ও শকুন উভয়েরই ক্ষতি হচ্ছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর ওষুধ বাজারজাত করা বন্ধ করায় ছোট ও চোরাগোপ্তা কোম্পানি সস্তায় সেসব ওষুধ বাজারে ছাড়ছে। এ ওষুধে শকুন মরছে ঠিকই; কিন্তু গবাদি পশুরও হয়তো ততটা উপকার হচ্ছে না।

এদেশে শকুনের প্রয়োজনীয়তাটা যারা বুঝেছেন, তাদের এখন শকুন সংরক্ষণে একটি বড় ভূমিকা নিতে হবে; তা হলো পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেন ও কিটোপ্রোফেন ব্যবহার বন্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পাওয়া হোক কিংবা হাতুড়ে পশু চিকিৎসক হোক, মেলোক্সিক্যাম ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক না ব্যবহার করার জন্য সবাইকে বলতে হবে। এটি একটি পাখি রক্ষার জন্য নিতান্ত শখের আবদার নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অতিপ্রয়োজনীয় দাবি।

লেখক : পাখিবিশারদ ও

প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব