ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যানজট-জলজট

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
যানজট-জলজট

বিভিন্ন মৌসুমে, বিভিন্ন দিনে, এমনকি ঘণ্টায় ঘণ্টায় পর্যন্ত চাহিদার পরিবর্তন হতে পারে। যার ফলে উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকা বা উৎপাদন ক্ষমতার ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি হয়। যেমন অফিসযাত্রার সময় এবং ছুটির সময় বাসের অত্যধিক ভিড় হয় আবার অন্যান্য সময় বাস ফাঁকা থাকে। ঈদের সময় ট্রেনে-লঞ্চে ভিড় অনিয়মিত চাহিদার উদাহরণ। ছুটির দিনে চিড়িয়াখানা ও শিশুপার্কের ভিড়, অন্যদিনে কমসংখ্যক লোকের উপস্থিতি একই সমস্যার উদাহরণ। গণপরিবহন, টেলিফোন, বিদ্যুৎ পরিষেবা, ট্যুরিজম এবং এভিয়েশন খাতে এই সমস্যাটি প্রকট। এক্ষেত্রে সমস্যাটি সমাধানের প্রথম উপায়টি হচ্ছে বাড়তি-কমতি চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমন্বয়ের সক্ষমতা অর্জন অথবা ভোক্তার চাহিদার সময়সূচিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালানো।

ভোক্তাদের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ বৃদ্ধি করা সেবা খাতে প্রায় অসম্ভব। ঈদের সময় যে পরিমাণ লোক ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলা শহরে যায় তাদেরকে যদি প্রত্যেককে একটি করে সিট দিয়ে বসানো হয়, তাহলে ঢাকা থেকে জেলা শহরে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ গুণ করতে হবে। ঈদের সময় অত্যধিক চাহিদা থাকলেও বছরের অন্যান্য সময় এই বাসগুলোকে বসিয়ে রাখতে হবে। আর বাস বসিয়ে রেখে কেবলমাত্র ঈদের সময় পরিচালনা করলে স্বাভাবিক সময়ে যাত্রীদের বাসের ভাড়া কমপক্ষে পাঁচ গুণ পরিশোধ করতে হবে। একই অবস্থা লঞ্চের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঈদের আগে যেই পরিমাণ যাত্রী লঞ্চে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে চায়, তাদের যদি স্বাভাবিক সময়ের মতো আরামদায়কভাবে বাড়িতে পৌঁছাতে হয়, সে ক্ষেত্রে লঞ্চের সংখ্যাও কমপক্ষে ১০ গুণ বাড়াতে হবে এবং বছরের অন্যান্য সময়ে এই লঞ্চগুলো বসিয়ে রাখতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা যেখানে আছে, সেখানেও একটি শহর এবং তার আশপাশ থেকে থেকে তিন-চার দিনের মধ্যে প্রায় এক কোটি লোককে স্থানান্তর প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বাংলাদেশে ঈদের সময় বাস এবং লঞ্চের ভাড়া অনেক বেড়ে যায়, মানুষ ট্রেন বাস এবং লঞ্চের টিকিট পায় না, দাঁড়িয়ে যেতে হয়, পরিবহনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে, মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না। এবং এ নিয়ে গণমাধ্যমে হৈ চৈ হয়, টিভিতে টকশো হয়। ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে অর্থনৈতিক জ্ঞানবিবর্জিত ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদমুখর হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবীর কম দেশেই বাস, লঞ্চ-স্টিমার বা ট্রেনের ভাড়া সারাবছর বা দিনের সব সময় একই রকম থাকে। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিমানের টিকিটের মূল্য নির্ধারিত হয় এবং এটা স্বাভাবিক সময়েই হয়ে থাকে। ঈদের দুই-তিন দিন আগে ভাড়া স্বাভাবিকভাবেই দুই-তিন গুণ হওয়া উচিত, এটাই অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী স্বাভাবিক। কারণ ঈদের দুই-তিনদিন আগে ঢাকা থেকে ছেড়ে যে লঞ্চ বরিশাল বা পটুয়াখালী যাচ্ছে, আসার সময় কিন্তু পুরো লঞ্চটিকে খালি আসতে হচ্ছে। কারণ ঈদের আগে কেউই বরিশাল বা পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় আসছে না। স্বাভাবিক নিয়মে লঞ্চের আসা-যাওয়ার ভাড়া বাবদ প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা যৌক্তিক। আর একেবারেই ঈদের আগের দিন যারা যাবে তাদের কাছ থেকে তিন গুণ ভাড়া আদায় করারও যুক্তিকতা থাকতে পারে। কারণ জাহাজের যেসব কর্মচারী ঈদে নিজে বাড়ি না গিয়ে যাত্রী পরিবহন সেবায় নিয়োজিত থাকে এ জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত ওভারটাইম ভাতা দেয়া উচিত এবং সে জন্য যাত্রী ভাড়াও তিনগুণ হওয়া উচিত।

অফিস সময়ের আগে পরে রেলের ভাড়ার ভিন্নতা আছে বিভিন্ন দেশে। অনেক দিন আগে আমি একবার লন্ডন থেকে বার্মিংহাম যাওয়ার জন্য হিউস্টন স্টেশনে টিকিট কিনতে গিয়েছিলাম। সকাল ৮টায় টিকিট কাউন্টারের বয়স্ক ভদ্রমহিলাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম বার্মিংহাম যাওয়া-আসার জন্য আমাকে কত পাউন্ড দিতে হবে। সে বলল, ৩০ পাউন্ড। আমি একটু ভরকে গেলাম। মাত্র ১০১ কিলোমিটার দূরবর্তী লন্ডনের পার্শ্ববর্তী একটা শহরে যাব এর জন্য ৩০ পাউন্ড ভাড়া। আমি একটু ইতস্তত করছিলাম। আমার মনে হলো টিকিট কাউন্টারের বিপরীতে থাকা ভদ্রমহিলা আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বার্মিংহাম কেন যাচ্ছ? আমি বললাম, ‘তেমন কোনো কাজ নেই, বেড়াতে যাচ্ছি।’ তখন ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, ‘তুমি সাড়ে ৯টার পরে আসো।’ আমি কিছুক্ষণ লন্ডন ইউনিভার্সিটি এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আশপাশে ঘুরাঘুরি করে আবার একই কাউন্টারে এলাম। তখন ভদ্রমহিলা আমাকে বলল ১০ পাউন্ড দাও। লন্ডন থেকে বার্মিংহাম যাওয়ার টিকিট হয়ে গেল। মাত্র দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে ভাড়া তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেল। এটা হচ্ছে চাহিদা ব্যবস্থাপনার একটা অন্যতম উদাহরণ। আমাদের দেশে ঢাকা শহরে অফিসের সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়। অনেকে বাসে উঠতেই পারে না। কিন্তু সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা এই সময় বাসগুলো অনেকটা ফাঁকা থাকে। ঢাকা শহরে যদি বাসের ভাড়া ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয় তাহলে যাদের একদম বেশি জরুরি প্রয়োজন নেই তারা সকাল সকাল অফিস যাত্রীদের সঙ্গে বাসে ওঠার জন্য প্রতিযোগিতা করবে না। তারা ১১টার পরেই বাসে উঠবে। আরেকটা কাজ করা যেতে পারে, ঢাকা শহরের চলাচলকারী অভ্যন্তরীণ রুটের বাসগুলোকে দেড়তলা করে দেওয়া। উপরের তলায় শুধু সিট বসানো থাকবে, কোনো ছাদ থাকবে না। লন্ডনের ট্যুরিস্ট বাসগুলোর মতো। অফিস সময়ে প্রচণ্ড ভিড়ের সময় দেড় তলা বাসে অধিক মানুষ চলাচল করতে পারবে। ট্রেনের একই অবস্থা। শত বাধা দিয়েও ঈদের সময় মানুষকে ট্রেনের ছাদে ওঠা থেকে বিরত রাখা যায় না। আমি একবার রেলওয়ের এক ইঞ্জিনিয়ারকে সুপারিশ করেছিলাম, মানুষ যখন ছাদে করে যাবেই তাহলে ছাদগুলোতে বসার ব্যবস্থা করে দিলেই তো হয়। ট্রেনগুলোও দেড় তলা করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। অন্তত ঈদ বা তাবলিগের ইজতেমার প্রচণ্ড চাহিদার সময় এই ব্যবস্থাটা কাজে লাগানো যেতে পারে।

আমাদের দেশে বিভিন্ন সেবা অথবা পণ্যের জন্য অতিরিক্ত দাম নিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিক্রেতাকে দায়ী করা হয়। ক্রেতার প্রচণ্ড চাপ এবং তাঁর নিজস্ব সুবিধাকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি কখনো আলোচনায় আসে না। ঢাকা শহরের মাংস বিক্রেতাদের সবাই সমালোচনা করে, ক্রেতা মাংস বিক্রেতাকে যে মাংস দিতে বলে বিক্রেতা কসাই কখনোই সেই মাংস দেয় না। দিলেও সুকৌশলে ওই মাংসের সঙ্গে কিছু হাড় এবং পুরনো মাংস মিশিয়ে দিয়ে দেয়। ক্রেতা কেবল বাড়িতে আনার পরে অথবা রান্নার পরেই বিষয়টি টের পায়, সে যে মাংসটুকু চেয়েছিল কসাই তাঁকে সেই মাংসটুকু দেয়নি। এক্ষেত্রে কিন্তু আমি পুরো দোষটা কসাইদের দেব না। কসাই যখন পশু কিনে সে কিন্তু মাংসের সঙ্গে হাড়সহই পশু কেনে। আমরা সবাই যদি শুধু রানের মাংস নিতে চাই তাহলে অন্যান্য অংশের মাংস বা হাড়গুলো সে কার কাছে বিক্রি করবে। যদি এমনটা হতো, আমি শুধু রানের মাংস নেব এবং এর জন্য আমি দেড় গুণ মাংসের দাম দেব তাহলে হয়তো কসাই এই কাজটি করত না। আমরা সবাই সবচেয়ে ভালো মাংসটা চাইব; কিন্তু অতিরিক্ত দাম দিতে চাইব না। এমনটি হলে তো মাংস বিক্রেতা যা করছে সেটা মেনে নেওয়াই উচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একই পশুর মাংস বিভিন্ন অংশের জন্য বিভিন্ন দাম রাখা হয়। আমাদের দেশেও আধুনিক মাংস বিক্রেতা যেমন- ‘বেঙ্গল মিট’, তাদের দোকানে মাংস বিভিন্ন দামে বিক্রি করে। সেক্ষেত্রে ক্রেতারা জেনেশুনেই অতিরিক্ত দাম দিয়ে তার পছন্দের মাংসটুকু কিনতে পারে।

একইভাবে আমরা যদি সবাই সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ শেষ করতে চাই এই সময় টেলিফোনের মিনিটপ্রতি কলের মাশুল বেশি দিতে হবে। কারণ টেলিফোনের যে অবকাঠামো টেলিফোন কোম্পানিগুলো তৈরি করে তা কিন্তু ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত টেলিফোনের মিনিট প্রতি কল চার্জ একটু কমিয়ে দিলে যারা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে অনেকটা বিনা প্রয়োজনে বা কম জরুরি প্রয়োজনে টেলিফোন করে তাদের অনেকেই এই সুযোগটা নেবে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত টেলিফোনের মাশুল চার ভাগের এক ভাগ করে দিলে যারা দিনের বেলায় অনেক লম্বা সময় ধরে অন্যের সঙ্গে কথা বলে তারা হয়তো তাদের এই খোশ আলাপের সময়টি পরিবর্তন করে গভীর রাতে করবে। এতে দিনের বেলায় যারা জরুরি প্রয়োজন ফোন করবে তারা টেলিফোন লাইন ব্যস্ত থাকার ঝামেলা থেকেও বেঁচে যাবে। কখনো কখনো টেলিফোন কোম্পানিগুলো ভোর রাতের দিকে ফ্রি টেলিফোন করার সুযোগ দেয়। এটাও কিন্তু অনিয়মিত চাহিদা ব্যবস্থাপনা কৌশল। যারা অনেক লম্বা সময় ধরে টেলিফোন করে তাদের কারণে অনেক নিয়মিত সাবস্ক্রাইবার অফিস আওয়ারে লাইন ব্যস্ত থাকার কারণে সময় মতো টেলিফোন সংযোগ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে অন্য কোম্পানির সিম নিয়ে নেয়। যার কারণে নিয়মিত সাবস্ক্রাইবারদের সুবিধার্থে লাইন ফ্রি রাখার জন্য কোম্পানিগুলো এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

হোটেল, মোটেল এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবা ও বিনোদন শিল্পে ‘পিক’ এবং ‘অফ’ সিজনে চাহিদা সমপরিমাণে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো মৌসুমি ডিসকাউন্টের সুবিধা দিয়ে থাকে। ঝড়-বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের সিজনে কক্সবাজারের হোটেল মোটেলগুলোতে চার ভাগের এক ভাগ ভাড়ায় হোটেল কক্ষ পাওয়া যায়। আবহাওয়ার খবর এর দিকে খেয়াল রেখে ট্যুর প্ল্যান করলেই এই সুযোগ পাওয়া যাবে। কক্সবাজারের এক হোটেল মালিক আমাকে বলেছিলেন, যখনই দেখবেন ৭ বা ৮ নম্বর বিপদ সংকেত দেয়া হয়েছে, তখনই কলাবাগানে গিয়ে কক্সবাজারের বাসে উঠে যাবেন। পরদিন সকালে যখন আপনি কক্সবাজারে পৌঁছবেন তখন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত চলছে। হোটেলে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, ‘ভাই ভাড়া কত’? হোটেল ম্যানেজার বলবে, ‘ভাড়া লাগবে না, আসেন আমাদের সঙ্গে বসে বসে জিকির করেন; কোনো টাকা দিতে হবে না’। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অপারেটিং কস্টের ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণ করে। অর্থাৎ চলতি খরচ উঠলেই হয়। কারণ অফ সিজনে হোটেল-মোটেল বন্ধ রাখলেও পরিবর্তনশীল খরচগুলো যেমন কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও আনুষঙ্গিক খরচ অব্যাহত থাকে। যার কারণে অফ সিজনে কক্ষগুলো খালি থাকা অবস্থাতেও পরিবর্তনশীল খরচগুলো অব্যাহত থাকায় যাতে লোকসানের সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্য ভাড়ায় বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকে। পিক সিজনে কখনো কখনো হোটেলগুলোতে ভিন্ন পারপাসে ব্যবহৃত কক্ষগুলোতে দলগতভাবে আসা পর্যটকদের জন্য বিছানার বিন্যাস সাজিয়ে ওইগুলো ভাড়া দিয়ে হোটেলের আসন সংখ্যা বাড়াবাড়ি নজিরও আছে। স্টাডি ট্যুরে আসা ছাত্রদের জন্য এই ব্যবস্থাটি বহুল প্রচলিত।

যত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক না কেন, হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে চাহিদা বেড়ে গেলে কোম্পানি এবং ভোক্তা উভয় পক্ষেরই অসুবিধা হয়। অনেকটা বর্ষাকালে ঢাকা শহরের নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরির মতো অবস্থা। যদি নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে বৃষ্টি হয় তাহলে ঢাকা শহরে অল্প কিছু জায়গা ছাড়া বাকি জায়গায় জলজট হবে না। যদি ২৪ ঘণ্টায় ৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়, তাহলেও তেমন বড় কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু বর্ষাকালে যখন আশপাশের নদনদীগুলো পানিতে টইঠুম্বুর থাকে, ঠিক সেই সময়ে যদি কোনোদিন ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, আর আমরা যদি তাৎক্ষণিকভাবে পানি সরে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা দেখতে চাই, তাহলে ঢাকা শহরের সবগুলো রাস্তাকে ড্রেনে রূপান্তর করতে হবে। পৃথিবীর প্রায় শহরেই এই হঠাৎ করে অল্প সময়ের মধ্যে অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টি হলে জলজট তৈরি হয়। মুষলধারে বৃষ্টি হলে এমনটি হবেই। সতের শতকের গোড়ার দিকে লন্ডনের পয়োনিষ্কাশন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা এখনকার মতো তত উন্নত ছিল না। লন্ডনবাসী অনেকেই রাস্তার মধ্যে ময়লা ফেলত (৩০০ বছর পরেও আমরা ঢাকাবাসীরা যেমনটা এখন করছি)। ময়লার বিষক্রিয়ায় অনেক কুকুর-বিড়াল মারা যেত। প্রচুর বৃষ্টি হলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো এবং মরা কুকুর-বিড়াল ভেসে যেত। যার কারণে ‘মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে’- এটার ইংরেজি হচ্ছে It’s raining cats and dogs. ইংরেজ কবি Jonathan Swift ১৭১০ সালে প্রকাশিত তার কবিতা City shower-এ বৃষ্টির পরে বন্যা অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ক্যাটস অ্যান্ড ডগস’ বাগধারাটির (idioms) ব্যবহার করেন। এর পর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টির ইংরেজি হিসাবে এই বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মুষলধারে বৃষ্টি হলে এমনকি সৌদি আরবের জেদ্দায় এবং তুরস্কের ইস্তান্বুলের মতো পাহাড়ি শহরেও জলাবদ্ধতা দেখা যায়। এটা একটা আরবান প্রবলেম। শহরের বেশিরভাগ জায়গায় পাকা আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে ফেলায় পানি প্রাকৃতিক নিয়মে মাটি ভেদ করে নিচের দিকে যেতে পারে না। এটাই শহরে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ।

অনেকে বলে ডিএনডি (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা) খালের ভেতর বর্ষার দিনে জলাবদ্ধতা হয়ে মাছ চাষের অবস্থা হয়। আমি বলেছিলাম গত শতকের ষাটের দশকে ঢাকা শহরে তাজা শাকসবজি এবং মাছ সরবরাহের জন্য ডিএনডি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। প্রকল্প প্রস্তাবে তাই লেখা ছিল। ওখানে মাছ চাষ করারই কথা ছিল; কিন্তু মাছের জায়গায় মানুষ গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। অতএব জলজট হবেই। এই সমস্যাটি আসলে কোনো সমাধান নেই। ওয়াসা এবং সিটি করপোরেশন চেষ্টা করলে এবং আমরা নাগরিকরা সচেতন হলে (সব কিছু ওয়াসার ড্রেনে না ফেললে) সমস্যাটি কিছুটা কমানো যাবে; কিন্তু হঠাৎ করে একদিনে অনেক বৃষ্টি হলে এই সমস্যাটি হবেই। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে এবং এটাকে দুর্যোগ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। যেমনটি হয় নিউইয়র্ক ও তার আশপাশে এলাকায় শীতকালে বরফ জমে যায় এবং এর কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারে না। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট সব বন্ধ থাকে দিনের পর দিন। শত শত উড়োজাহাজ এবং ট্রেন যাত্রা বাতিল করে। মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। আমাদের এখানে এটাকেই ধনী দেশের বরফ পড়া সমস্যার মতো মোকাবিলা করতে হবে (ওরা ধনী বলে ওদের শহরে বরফ পড়ে আর আমরা গরিব বলে আমাদের এখানে পানি আসে!)। খিলগাঁও, বাসাবো, বাড্ডা, মাণ্ডাসহ যেসব এলাকায় হঠাৎ করে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা বৃষ্টি হয়, সেখানে বাসাবাড়ি এবং দোকানপাটগুলো এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে হঠাৎ করে বৃষ্টি হলে সর্বোচ্চ পানি হলেও যেন দোকানপাট এবং বাসাবাড়ির মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর যেদিন এরকম বৃষ্টি হবে নিউইয়র্কের মতো ঢাকা শহরের স্কুল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ দিয়ে দিতে হবে; এছাড়া আপাতত আর কোনো সমাধান নেই।

অনিয়মিত চাহিদা মোকাবিলায় বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তালে তালে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটাকে বলা হয় সিনক্রো মার্কেটিং (synchro marketing)। নৃত্যের তালে তালে সাঁতার কাটার মতো (synchro swimming)।

লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়

ও সাবেক ভিসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত