শেখ কামাল : আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের রূপকার
সাইদুর রহমান প্যাটেল
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ জন্ম নিয়েছেন, প্রতিনিয়ত নিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও জন্ম নেবেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীয় কৃতিত্বে অমলিন হয়ে থাকেন পৃথিবীর কোটি মানুষের হৃদয়ে। আজ যে মানুষটির কথা বলতে হচ্ছে, তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান শেখ কামাল। আমার পরম প্রিয় বন্ধু। আত্মার আত্মীয়। বাঙালি জাতির গর্বিত এক সন্তানের নাম শেখ কামাল।
শেখ কামালের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক বাড়িতে। সময়টা ১৯৬৬ সাল। আমি তখন গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং স্কুল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি। বলা যায়, সে সময় বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি গঠিত হয় গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার মনে আছে, তখন স্কুল কমিটি করতে গিয়ে কতটা নির্যাতন আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। শারীরিকভাবে গুরুতর আহত হতে হয়েছে মুসলিম লীগের গুণ্ডা বাহিনীর হাতে। সে সময়ে আমি সিরু, নজরুলসহ বেশ কয়েকজন বন্ধু জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখতাম। আমার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জগন্নাথ কলেজের ভিপি রাজু ভাই, আলী রেজা ভাই, সাইফুদ্দিন ভাইসহ অন্য নেতারা আমার ওপর খুব খুশি ছিলেন। মনে পড়ে, ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্র ভাইদের নিয়ে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করি। পোস্তগোলার হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরি পর্যন্ত সব ইংরেজি সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলি এবং প্রত্যেক গাড়ির ইংরেজি নাম ফলক কালো রং দিয়ে মুছে ফেলি। ফেরার পথে তৎকালীন আরসিন কোম্পানির গেটের সামনে সূত্রাপুর থানা ওসি আবদুস সালামের নেতৃত্বে পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং ওসি আমাকে ধরে মারাত্মকভাবে প্রহার করেন। আমি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে জগন্নাথ কলেজে যাই। রাজু ভাই, রেজা ভাই, সাইফুদ্দিন ভাইয়েরা সব শুনে ক্রোধান্নিত হন এবং সূত্রাপুর থানার ওসির বিরুদ্ধে জগন্নাথ কলেজের ক্যান্টিনে প্রতিবাদ সভা করেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘গেন্ডারিয়া স্কুলের ছাত্রদের উপর সূত্রাপুর থানার ওসির আক্রমণ’ শিরোনামে খবর ছাপা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার রাজনৈতিক তৎপরতার যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মতো আমি জাতির জনকের সাক্ষাৎ লাভ করি। রাজনৈতিক কারণে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র নেতাদের সঙ্গে ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন নেতৃবৃন্দ আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরিচয় দিলে বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমার সর্দার বল্লব ভাই প্যাটেল। আমার মেঞা চান। সেদিনই শেখ কামালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। অনেক কথা হয়। আমি তার আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে যাই। পর্যায়ক্রমে আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। শেখ কামাল বঙ্গবন্ধুর সন্তান, এই পরিচয়ের বাইরে গিয়ে যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে বলতে হয়, ব্যক্তি কামালের মতো এত সৎ, এত যোগ্য এবং এত মহান মানুষ তৎকালীন সময়ে খুবই দুর্লভ ছিল। তিনি ছিলেন খুবই প্রতিভাবান একজন মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছিলেন একজন ভালো মানুষ। বড় মনের মানুষ।
অনেকেই জানেন না, দেশের জন্য শেখ কামালের ভূমিকা এবং অবদানের কথা। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের সময় যখন বঙ্গবন্ধুকে আইয়ুব সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয়, তখন জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর গোপন নির্দেশনা অনুযায়ী শেখ কামাল অনেক ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন ঢাকা শহরে চুয়াল্লিশটি ইউনিয়নে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সে সময় পুরান ঢাকার ইউনিয়নভিত্তিক আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা হলেন- ফজলুল করিম, গেন্ডারিয়ার শহীদ আহসান উল্লাহ সরদার, রমজান আলী, আলী আশরাফ, গোলাপ চান, মনা মেম্বার, আফতাব মাস্টার, ফাইজুদ্দিন, ফরিদাবাদের মেন্দি মিয়া, পোস্তগোলার গেদু মিয়া, ফরাশগঞ্জের মনির ভাই, পাটুয়াটুলির ডাক্তার মোয়াজ্জেম ভাই, ইসলামপুরের আব্দুল্লাহ ভাই, রায় সাহেব বাজারের বাদশা ভাই, নবাবপুরের হাবিবুর রহমান, লক্ষ্মীবাজারের রুচিরা গ্রুপের তারন ভাই, ইব্রাহিম ভাই, বশির ভাই, কালু ভাই, হুমায়ুনসহ অন্য বড় ভাইয়েরা, বাংলাবাজারের বেবী, লক্ষ্মীবাজারের নান্দুু, হেলাল, শান্তিনগরের কার্জেন, মালিবাগের পাহাড়ি। কামাল ছয় দফা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বঙ্গবন্ধুর গোপন নির্দেশ তাঁদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ৭০-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত সূত্রাপুর-কোতোয়ালিতে খাজা খায়রুদ্দিনকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধু বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। সে ছিল সত্যিই একটা ইতিহাস। কারণ ওই জায়গার বেশিরভাগ লোক ছিল মুসলিম লীগের অনুসারী। কামাল প্রতিনিয়ত সে সময় নির্বাচনের মাঠে কাজ করেছেন এবং সফল হয়েছেন। এটা ছিল বাংলাদেশে রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ কারণে যে সেদিনের সেই নির্বাচনের ফল পরবর্তী সময়ে দেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার প্রস্তাবে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। এই সমিতিরই উদ্যোগে গঠন করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। এই দলটি গড়ে তুলতে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি। ‘গোষ্ঠপাল একাদশ’-এর সঙ্গে কলকাতা মোহনবাগান মাঠে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের দ্বিতীয় খেলা দেখার জন্য উপস্থিত ছিলেন শেখ কামাল। তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানীর এডিসি। তিনি মাঠে ঢোকার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং আমার এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বৃষ্টির মধ্যে পুরো সময় খেলা উপভোগ করেন। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল যুদ্ধ-পরবর্তী একটা দেশকে গড়ে তোলার জন্য সাংগঠনিক কাজে দক্ষতার পরিচয় দেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াক্ষেত্রে শেখ কামালের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একজন ভালো ক্রিকেটার ও ফুটবলার। জনপ্রিয় বাস্কেটবল খেলোয়াড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাথলেটিক্সের পরিচিত মুখ। সর্বোপরি একজন বিদগ্ধ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধু যেমন দেশপ্রেমিক এবং ক্রীড়ানুরাগী ছিলেন, শেখ কামালও বাবার সেই গুণগুলোকে ধারণ করতেন মনে-প্রাণে। তিনি ছিলেন আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা। দিনের পর দিন তিনি অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন আবাহনীর জন্য। তার ডাকে আবাহনীর হয়ে সমাজের বিভিন্ন লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছেন। অবদান রেখেছেন। আয়ারল্যান্ডের প্রথিতযশা কোচ বিল হার্টকে করা হয় আবাহনীর কোচ। এর ফলে সফলতাও পেয়েছিলেন হাতেনাতে। সারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ঢেলে সাজানোর জন্য তার চেষ্টার কমতি ছিল না। সে সময়ে অনেকেই তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে নানান রকমের মিথ্যাচার করেছে। কিন্তু তিনি তাতে পিছু হটেন নি। কুণ্ঠিত হন নি এতটুকুও। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্বাধীনতার পরে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, বিশেষ করে ফুটবলে যে বিপুল জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা সম্ভব হয়েছিল শেখ কামালের সাংগঠনিক তৎপরতার কারণে।
শেখ কামাল তার চলনে, বলনে প্রতিটি কাজে প্রচণ্ড সাদাসিধে একজন মানুষ ছিলেন। আজ সত্যিই খুব কষ্ট পাই, যখন নিন্দুকের ছড়ানো রিউমারে কত লোক তাকে না জেনে, না বুঝে তার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু যারা তাকে কাছাকাছি থেকে জেনেছেন, দেখেছেন তারা জানেন কতটা আদর্শ জীবনযাপনের অধিকারী ছিলেন জাতির জনকের সন্তান। আমি ছিলাম শেখ কামালের সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমি তাকে যতটা জানতাম, বুঝতাম ততটা অন্য অনেকেই জানতেন না। কতটা দুঃখজনক যে, সেই শেখ কামালকে নিয়ে তথাকথিত ঈর্ষাপরায়ণ, বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন বিরোধীরা তার নামে নানান বিষয়ে করেছে চরম মিথ্যাচার, বানিয়েছেন কল্পিত যতসব আজগুবি গল্প। আমার মনে আছে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজল সাহেব। তিনি তখনকার কোনো একটি অনুষ্ঠানে শেখ কামাল সম্পর্কে দারুণ প্রশংসা করে বলেছিলেন, শেখ কামাল ছিলেন আদর্শবান মানুষ। তার কোনো অহংকার ছিল না। অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র ছিল। জেলে বসে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, তার সেই কথার কিছু দিনের মধ্যেই তাকে হারাতে হয়েছিল উপদেষ্টার পদ। ভীষণ বন্ধুবৎসল ছিলেন শেখ কামাল। দারুণ সংস্কৃতিমনা ছিলেন। ভালো সেতার বাজাতেন। খুব ভালো অভিনয় করতেন। নাটকের অনুরাগী ছিলেন। যে কারণে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পগোষ্ঠী’। ছাত্র হিসেবে ছিলেন তুখোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। কামাল সবসময় এটা মাথায় রেখে চলতেন তিনি কার সন্তান, যেন বাবার নামের এতটুকুও অমর্যাদা না হয়।
দেশ স্বাধীনের পরের কথা। তৎকালীন রাজনীতিতে এক ধরনের ক্রাইসিসের সৃষ্টি হয়। নানা মতাদর্শের কিছু দলের উদ্ভব ঘটে। স্বাধীনতার বিরোধীরা নানাভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। মনে পড়ে, এ রকম এক পরিস্থিতির সময় হঠাৎ একদিন কামাল আমার গেন্ডারিয়ার বাসায় আসে। তার চেহারায় খুব বিমর্ষভাব। আমাকে বলল, প্যাটেল বাবা আমাকে তোর কাছে পাঠিয়েছে। তোদের কী অবস্থা? ব্যাপারটা এ রকম ছিল যে, আমাদের এলাকার বেশ কিছু যোগ্য রাজনৈতিক নেতা তখন জাসদের যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রমিক নেতা মো. শাহজাহান, মেজবাহ, আতাউর, দেলোয়ার, হাফিজ। এ কারণে বঙ্গবন্ধু খুব চিন্তিত ছিলেন। আমি কামালকে হেসে বললাম, দোস্ত যারা যাবার তারা চলে গিয়েছেন। তবে তাদের সঙ্গে সাধারণ কর্মীরা নেই। কামাল প্রথমে আমার কথায় খানিকটা সন্দিহান হলো। আমি কামালের কাছ থেকে দুই ঘণ্টা সময় চেয়ে নিলাম। চারদিকে খবর পাঠিয়ে দিলাম। দুই ঘণ্টার মধ্যে দীননাথ সেন রোডের একটি পরিত্যক্ত বাড়ি, সেই বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাঘাট সব জনস্রোতে ভরে যায়। কামাল হতবাক হয়ে গেল। দেখল, সেখানকার আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দলকে, যারা আমার নেতৃত্বে এক হয়ে সেখানে কাজ করছেন। কামাল জনসম্মুখে বক্তৃতা দিল। আমিও দিলাম। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন। তারা যেন বঙ্গবন্ধুর কথা শুনছেন। কামাল যেন জুনিয়র বঙ্গবন্ধু। দেখতেও বাবার মতো ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, তখনকার আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের জন্য কাজ করেছেন সিরু, মঈন সিনহা, সোহরাওয়ার্দী কলেজের হেলাল (ভি.পি.), নান্দু (জি. এস.), আবদুল আজিজ (ফিফা রেফারি), মঈন, দুলাল (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার), মুক্তিযোদ্ধা দুলু (ফরিদাবাদ), ডাক্তার আলী জিলকদ, শাহজাহান, আকবর, শিবু, বাদল, বেবী (বাংলাবাজার), খোরশেদ আলম বাঘা (মুক্তিযোদ্ধা), ফরহাদ, প্রকাশ চন্দ্র সাহা (প্রাক্তন পরিচালক জাতীয় জাদুঘর) আরও অনেকে ছিলেন। এরা সবাই শেখ কামালের ভক্ত ছিলেন। কামাল ফিরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পুরো বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি শুনে আশ্বস্ত হন।
১৯৭৪ সালের কথা। আমি তখন প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে দিলকুশা ক্লাবে খেলি। তবে বলে রাখা ভালো, ইস্টঅ্যান্ড ক্লাবে খেলতে শুরু করি ১৯৭৫ সালে এবং সে বছর অধিনায়কও হই। যে দিনটার কথা বলছি, সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ইস্টঅ্যান্ড বনাম আবাহনী ক্রীড়াচক্রের খেলা। খেলার মাঝে দুই দলের সাপোর্টারদের মধ্যে কিছু কথা কাটাকাটি হয়, যা আমি ও কামাল মিলে সমঝোতা করে ফেলি। খেলার পরে দুই দলের সব খেলোয়াড়রা চলে গিয়েছেন। আমার জিপ বাইরে। কামালের টয়োটা গাড়িটা আবাহনীর তারেক তার প্রয়োজনে নিয়ে যায়। আমরা মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সব সাপোর্টারও চলে গিয়েছেন। এমন সময় সার্জেন্ট রকিব (সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক) ভাই আমাকে ইশারা করে ডাকলেন। বললেন, কামাল তোর সঙ্গে আছে। বাইরে দেখলাম বেশ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি দেখে ভালো মনে হচ্ছে না। আমি কামালকে বললাম সে কথা। আমার কথার তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে মজা করে বললেন, আমাকে দেখার জন্য ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিন্তু সময় নিলাম না মোটেও। রকিব ভাই আর আমার মাঝে কামালকে নিয়ে স্টেডিয়াম গেট থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কোথা থেকে যেন একটা ইট ছুটে এলো আর গেটের সাটারে গিয়ে পড়ল। অবাক হয়ে দেখলাম, প্রায় শ’ দুয়েক লোক উত্তেজিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। পরক্ষণেই আরেকটা ইটের টুকরা কামালের কপালে এসে লাগল। তার কপালটা ফুলে গেল। আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম। কামালকে ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে আমার জিপে তুললাম। জনা পঞ্চাশেক লোক জিপ আগলে দাঁড়াল। আমি চিন্তা করলাম যা হওয়ার হবে। সুতরাং প্রচণ্ড বেগে জিপ চালিয়ে দিলাম। ওরা জীবনের ভয়ে সরে দাঁড়াল। আমরা বেরিয়ে এলাম স্টেডিয়াম এলাকা থেকে। দুই সপ্তাহ পরে কামাল আমাকে জানাল, জানিস প্যাটেল, সেদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি তদন্তে জানা গিয়েছে, আমাকে মেরে ফেলার জন্য টাঙ্গাইল থেকে গণবাহিনীর বেশ কিছু লোক হায়ারে আনা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক বিভিন্ন আলোচনায় এ বিষয়টি বহুবার ওঠেছিল এবং কামাল সব সময় সে কথা বলত। কামাল বলত, প্যাটেল আম্মা তোর জন্য অনেক দোয়া করেছেন। সবাই তোর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।
এক বিকেলে জাতির জনকের বাসায় গেলাম। আমার জিপটা বাড়ির ভেতরে রাখলাম। কামাল ওর টয়োটা-৬৯ করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেড কমান্ডারের অফিসে ঢুকল। ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল এবং ব্রিগেড মেজর গাফ্ফার তাদের অফিসে বসে আছেন। কামাল তাদের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল। সেদিন আমরা নানা বিষয়ে আলাপ করলাম। তখন ঢাকা শহরে কম্বিং অপারেশন চলছে। মেজর গাফ্ফার বললেন, প্যাটেল সামনের সপ্তাহে তোমার গেন্ডারিয়া, ফরিদাবাদ এলাকায় সার্চ হবে। কার্ফু দেব আমরা। শুনে কামাল মুচকি হাসল। আমি বললাম, আমার এলাকায় এসবের দরকার নেই। তিনি বললেন, কী বলো প্যাটেল? আমি জবাবে বললাম, এটা করব আমরা। তারপর হঠাৎ করেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এত কনফিডেন্স তোমার? আমি বললাম, অবশ্যই। কারণ হলো, যে কাজটা শত শত পুলিশ এবং আর্মি দিয়েও সম্ভব হতো না, সেটা ভলান্টিয়ারি কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকার জনগণ, যুবসমাজকে নিয়ে, দলমত নির্বিশেষে আমি করেছি। নিজেরা অস্ত্র উদ্ধার করে থানায় জমা দিয়ে এসপি মাহবুবকে ফোন করে জানিয়ে দিতাম, যাতে কোনো ধরনের ইনফরমেশন গ্যাপ না থাকে। রাত ১টার পরে আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফিরে আসি। আমার জিপ নিয়ে যখন আসার উপক্রম করলাম তখন কামাল আমাকে থামিয়ে দিল। বলল, তোর শত্রুর অভাব নেই। এত রাতে তোর নিজের গাড়ি দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। ইতোপূর্বে আমাকে একবার গুলি করা হয়েছিল। চুয়াত্তর সালের পহেলা রমজানের আগের রাতে। ভাগ্যক্রমে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। সুতরাং কামাল আমাকে বঙ্গবন্ধুর ব্লাক মার্সেডিজ গাড়িটি ড্রাইভার এবং সেন্ট্রিসমেত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। বলে দিল, তুই নবাবপুর এবং নারিন্দা দিয়ে যাবি না। যাত্রাবাড়ী হয়ে পোস্তগোলা দিয়ে বাসায় যাবি। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম এটা ভেবে যে, কামাল আমাকে কতটা ভালোবাসে। আজও চিন্তা করলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমার প্রবেশাধিকার ছিল সব সময়। কামালের বিয়ের কয়েক দিন পরের একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখলাম বঙ্গবন্ধুর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পরম শ্রদ্ধেয়া বেগম মুজিব। আমি তাকে মায়ের মতো শ্রদ্ধ করতাম। আমি সালাম দিলাম, তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কামাল তো বাসায় নেই প্যাটেল। আমি এটা শুনে নেমে আসতে যাব, এমন সময় তিনি আবার ডাকলেন। বললেন, উপরে আসো। আমি ভেতরে ঢুকতেই তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর টেবিলে নিয়ে বসালেন। তারপর দুই প্লেটে করে কয়েক রকমের মিষ্টি এনে আমার সামনে দিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে অপর পাশে বসলেন। এ বাড়ির সবাই জানতেন, আমি মিষ্টি খুব পছন্দ করি। তিনি আমাকে পরম মমতায় মিষ্টি খাওয়ালেন। বললেন, জামালের শ্বশুর বাড়ি থেকে এ মিষ্টি এসেছে। সেটাই ছিল বঙ্গমাতার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কিছুকাল আগের কথা। আমি তখন গেন্ডারিয়াতে বাসায়। মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাউন্ডে তখন জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্প চলছে। এক সকাল বেলায় কামাল তার শ্বশুরবাড়ি থেকে সরাসরি ক্যাম্পে চলে আসে এবং গোলকিপার সান্টুকে ডেকে তোলে। সান্টু পরবর্তী সময়ে এসব কথা আমাকে জানিয়েছিল। প্র্যাকটিস শুরু হওয়ার আগে আধাঘণ্টা ধরে শুধু আমাকে নিয়ে কামাল তার সঙ্গে কথা বলেছিল। কামাল ওকে বলেছিল, ‘আমার কত বন্ধু কত সময় কত কিছু চেয়েছে। কিন্তু প্যাটেল কখনও কিছু চায়নি। ওর জন্য কিছু একটা করতে চাই। সান্টু, ঢাকা শহরে বিয়ে একটা হবে এবং সেটা হবে প্যাটেলের বিয়ে। আমরা এক সপ্তাহ ধরে আনন্দ-উৎসব করব। নানান ধরনের খেলাধুলা হবে। ইস্টঅ্যান্ড ক্লাব মাঠে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ হবে। ডেক ভরে কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াব।’ নিজের বিয়েটা খুব মামুলিভাবে হওয়ায় কামালের মনে একটা আক্ষেপ ছিল। তার বিয়েটা হয়ে টি-পার্টির মাধ্যমে। যে কারণে সে আমার বিয়েটা খুব জাঁকজমকভাবে আয়োজন করতে চেয়েছিল। আমার বিয়েতে বঙ্গবন্ধু উকিল শ্বশুর হবেন, এমন কথাও হয়েছিল তখন। কিন্তু সে সবের কিছুই আর হয়নি।
আবাহনী ক্লাব ছিল শেখ কামালের স্বপ্ন ও ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি ঘটনার কথা। আমি ইস্টঅ্যান্ড ক্লাবের খেলোয়াড় হলেও আবাহনীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। এর কারণ, শেখ কামাল। তহবিল সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমি তার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমি মাঝে মাঝে আবাহনী মাঠে ক্লাবের ফুটবলারদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম। একদিন কামাল আমাকে বলল, কালকে ভোরে একটু আগে আসিস। আমি সেই অনুসারে পরের দিন আসার পর দেখি, কামাল হাতে একটি বড় টেপ নিয়ে এসেছে। আমার হাতে টেপের এক প্রান্ত দিয়ে বর্তমান আবাহনী ক্লাবের ভবন এলাকা ও মাঠ মাপজোখ করে। মাঠ মাপার পর সে উল্লসিত হয়ে ওঠে। নির্ধারিত স্থানে ভবন ও মাঠের সংকুলান হয়ে যাওয়ায় সে এই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সেই সময় আরও যারা কামালকে আবাহনী গড়ে তোলার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন, তারা হলেন- প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হারুনুর রশিদ, তানভীর মাজহার ইসলাম তান্না, তারেক, বাদল, বরকত, ওমর, মন্টু, বাচ্চু প্রমুখ।
ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে প্রাণ দিতে হয়েছিল নির্মমভাবে। জাতি হারিয়েছিল তার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে। আমি সেই সঙ্গে হারিয়েছি আমার প্রাণের বন্ধু শেখ কামালকে। সে অনেক কিছু করতে চেয়েছিল। বদলে দিতে চেয়েছিল এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে। কিন্তু মাত্র ২৬ বছর বয়সে মেধাবী এই যুবককে চলে যেতে হওয়ায় তার সেই আশা অপূর্ণ রয়ে যায়।
বড় বেশি প্রাণোচ্ছ্বল ছিল শেখ কামাল। কখনও ভুলতে পারব না তাকে। কামাল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতো। সমগ্র জাতি পাশে পেত তাকে। বঙ্গবন্ধুর পরিবার বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কত যে গৌরবের, সে কথা কারও অজানা নয়। যতদিন পৃথিবী থাকবে, বাংলাদেশের মানুষ কখনও তোমায় ভুলবে না শেখ কামাল। তুমি বেঁচে থাকবে বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গহিনে, চির অম্লান হয়ে।
লেখক : সাইদুর রহমান প্যাটেল, প্রস্তাবক, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল