মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২১৭)
মানুষ তৈরির মাটি সংগ্রহের অজানা কথা
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দুনিয়ার প্রথম মানবের কায়া তৈরির মাটি সংগ্রহে পাঠানো হয় চারজন বড় ফেরেশতা। ভূপৃষ্ঠে এসে মাটির আপত্তির মুখে খালি হাতে ফেরত যান ফেরেশতা হজরত জিবরাঈল ও ইসরাফিল (আ.)। এবার আল্লাহপাক ইসরাফীল (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন, যাও পৃথিবীর বুক থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে এসো। ইসরাফীল (আ.)-কে দেখে আবারো জমিন কান্নাজুড়ে দিলো, দয়া করে হাত দেবেন না আমার গায়ে। আপনি আল্লাহর সম্মানিত ফেরেশতা। মানুষের জীবন মরণের নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে। আপনার ফুৎকারে কেয়ামতকাণ্ড ঘটবে, আরেক ফুঁকে মৃতপ্রাণী জীবন পাবে। কয়লায় ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। আবার একই ফুঁ দিলে আগুন নিভে যায়। আপনার ফুঁতেও এভাবে দুরকমের সৃষ্টিকর্ম সাধিত হবে।
তো ফেরেশতায় রাহমতি রাহমাত নামা’
হা’মেলে আরশি ও কেবলায় দা’দহা’
আপনি রহমতের ফেরেশতা রহম করুন আমার প্রতি
আরশ বহনকারী ন্যায়-ইনসাফের কেন্দ্রবিন্দু আপনি।
আল্লাহর আরশ হচ্ছে ন্যায়বিচারের প্রাণকেন্দ্র। সেই আরশ বহন করেন আপনি। আরশের নিচ থেকে মাগফেরাতের চারটি ঝরনা প্রবাহিত। সেই চার ঝর্ণার বর্ণনায় মওলানা বলেন, একটি দুধের নহর। দ্বিতীয় আছে মধুর নদী। তৃতীয় পবিত্র শরাবের প্রস্রবণ। আরো বয়ে যায় পানির দজলা। নদীগুলো আরশ থেকে বেহেশতের দিকে প্রবাহিত। অবশ্য এই ঝর্ণার আংশিক নমুনা-শাখা দুনিয়ার দিকেও বিস্তৃত। যদিও দুনিয়ায় আসা ঝর্ণা চারটি দুষিত ও ত্রুটিযুক্ত। তাই এই জগতের যত স্বাদ ও মজা কোনটার স্থায়িত্ব নেই, ত্রুটিমুক্তও নয়। এখানকার যত স্বাদ, সুখ ও আনন্দ সবকিছুর গতি ফুরিয়ে যাওয়ার দিকে। সবকিছুতে বিষাদ ও নিরানন্দ লুকায়িত থাকে। কিন্তু পরকালের খুশি ও আনন্দ চিরন্তন। স্থায়িত্ব ও পূর্ণতায় ভরপুর।
আল্লাহতায়ালা কেন চার প্রস্রবনের নমুনা এই জাহানে প্রবাহিত করেছেন? নিশ্চয়ই হেকমত আছে। হেকমত হলো, মানুষ যাতে তা দেখে ধাবিত হয় আসলের দিকে, এগিয়ে যায় উৎসের সন্ধানে। কিন্তু দুনিয়াপূজারীরা সেই পথে যায় না। দুনিয়ার তুচ্ছতা, ভোগ, বিলাস ও আনন্দে মজে থাকে। নেয়ামতের উৎসে যে নেয়ামতদাতা আছেন তাকে পাওয়ার চেষ্টা করে না।
মওলানা রুমি বলেন, দুনিয়াতে বেহেশতের চার ঝর্ণার নমুনা দেখলে অবাক হবে কত যে কোলাহল এই চারঝর্ণাকে ঘিরে।
শীর দা’দ ও পারওয়ারেশ আতফাল রা’
চাশমে কার্দে সীনেয়ে হার যা’ল রা’
দুধ দিয়েছেন শিশুর লালন-পালন হেতু
প্রত্যেক নারীর বুকটা করেছেন ঝর্ণার মতো।
দুনিয়াতে বেহেশতি নহরের নমুনা মায়ের বুকে দুধের নহর। দ্বিতীয় নমুনা শরাব। আঙ্গুরের মধ্যে জারি করেছেন সেই ঝর্ণা। শরাব দুঃখ-যাতনা ভুলিয়ে দেয়, বল সঞ্চার হয়। মওলানা আশরফ আলি থানবি (রা) বলেন, বেহেশতে শরাব পানে মানুষ জীবনের সকল দুঃখ যাতনা ভুলে যাবে, এর উপমা দুনিয়ার শরাব। তবে বেহেশতের শরাব পবিত্র। আর দুনিয়ার শরাব অপবিত্র। তৃতীয় ঝর্ণা মধুর নহর। মৌমাছির পেটের মধ্যে আল্লাহ জারি করেছেন এই ঝর্ণা, রোগের চিকিৎসায় তার জুড়ি নাই। বেহেশতের চতুর্থ ঝর্ণার নমুনা সাধারণ পানি। পবিত্রতা, আহার-বিহারের জন্য পানির বিকল্প নেই। পানির অপর নাম জীবন।
এসব দানের উদ্দেশ্য ছিল তুমি যেন তার পরিচয় লাভ করো। দুনিয়াতে বিস্তৃত এসব শাখার সূত্র ধরে তুমি যাতে আসলের সন্ধান কর, গোড়ায় যাওয়ার চেষ্টা কর। কিন্তু তুমি দুনিয়া নিয়ে মজে আছ। তোমার উচিত ছিল সৃষ্টিলোকে বিরাজিত নেয়ামতের আসল খনির কাছে যাওয়া। যেখান থেকে উৎপত্তি সেই উৎসের দিকে রুজু হওয়া। কিন্তু তুমি এই দুনিয়ার বিষয়-আশয় ছাড়া অন্যদিকে দৃষ্টি দাওনি।
এখন শুনো মাটির কাহিনী শেষে কোথায় গড়াল। ইসরাফীল (আ.) এর কানে কানে সে কী মন্ত্র পাঠ করল। বিমর্ষ, ব্যথায় কাতর ভাব নিয়ে জমিন ইসরাফীলকে বলল, মহান পবিত্র সত্তার দোহাই। আপনি আমার উপর জুলুম করবেন না। আমার কাছ থেকে মাটি নিয়ে যে কায়া গড়বেন, তাতে আমি অন্য কিছুর আশংকা করছি। দুর্ভাবনার পাহাড় চেপে আছে আমার মাথার উপর। সে আমার বুকের উপর খুনখারাবি করবে, রক্তপাত ঘটাবে। আপনি তো রহমতের ফেরেশতা। আমার প্রতি দয়া করুন। আপনি বিহঙ্গপক্ষীর মতো। যার কাঁধে বসেন তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনেন। আপনি তো সকল ব্যথার প্রতিষেধক, মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমতের প্রতীক। আপনিও সেই কাজ করুন, যা করেছেন আগের দুই ফেরেশতা জিবরাঈল ও মীকাঈল (আ)।
এ কথা শুনে ইসরাফীল (আ) উড়াল দিলেন আরশের পানে। পৃথিবীতে এসে কী ঘটল তার বর্ণনা দিলেন মহান মালিকের সন্নিধানে। বললেন, তুমি বাহ্যত নির্দেশ দিয়েছিলে ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটি আনার জন্যে; কিন্তু আমার মনের কানে বলেছ অন্যকথা। যাহেরিতে বলেছ মাটি নিয়ে এসো, কিন্তু আমার অন্তরে এমন দয়া মহব্বত ঢেলে দিয়েছ, যে কারণে মাটির কাকুতি মিনতি শুনে আমি বিগলিত হয়েছি। কঠোরতা দেখাতে পারিনি তাকে। শেষ পর্যন্ত রহমত জয়ী হয়েছে গযবের উপর। দয়ার জয় হয়েছে কঠোরতা চাপিয়ে। তোমার সৃষ্টি নৈপুণ্য তো নিত্যনব। তার হেকমত বুঝার সাধ্য কি আছে বান্দার।
এবার আজরাঈল (আ.)-কে ডেকে আল্লাহ বললেন, কল্পনা দুর্ভাবনায় তাড়িত মাটির কাছে যাও। মানুষ সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর হেকমত নিয়ে সে যে দুশ্চিন্তায় ভুগছে তার অবসান ঘটাও। মনের সংকীর্ণতায় সে আমার সৃষ্টিরহস্যের কুলকিনারা করতে পারছে না। সে আদম সন্তানের খুনখারাবির আশংকা করছে। অথচ আদম যে পৃৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি হবে, আমার হয়ে দুনিয়াকে সাজাবে সে রহস্য বুঝার শক্তি তার হয়নি।
আজরাঈল (আ.) ডানা ঝাপটিয়ে নেমে এলেন মাটির বুকে। তখন অসহায় মাটির সে কী ক্রন্দন। শতমুখে আল্লাহর কসম, দোহাই দিয়ে বলে, আমাকে নিয়ে যাবেন না দয়া করে। হে আজরাঈল! আপনি আল্লাহর খাস বান্দা, আরশ বহনকারী, আসমান জমিনে আপনার শাসন সদা কার্যকর। আপনি ফিরে যান মহান প্রভুর কাছে।
আমার কান্নার কথা বলুন। তিনি তো কারো কান্না বিফল করেন না। আজরাঈল বললেন, তোমার এসব বাহানা ছাড়। তোমার কান্না আল্লাহর আদেশ পালন থেকে আমাকে বিরত রাখতে পারবে না। মাটি বলে, আপনাকে আল্লাহ কঠোরতার আদেশ করেছেন, মানলাম। কিন্তু সহনশীলতা উদারতা দেখানোর নির্দেশও তো তিনি দিয়েছেন। আপনি আল্লাহর দেয়া জ্ঞানে সেই উদারতার পথেই চলুন। এটিও তো আল্লাহর আদেশ পালন। আজরাঈল বললেন, মাটি! তুমি আল্লাহর আদেশকে ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা করছ, তোমার এই প্রবণতা ভুল। তুমি নিজেকে ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা কর। যেখানে আল্লাহর পরিষ্কার আদেশ আছে, সেখানে ঘুরিয়ে ব্যাখ্যার টালবাহানা অন্যায়। তুমি তোমার চিন্তাকে শোধরাও, আল্লাহর আদেশকে শোধরানোর চেষ্টা করো না। পরিণতি হবে মারাত্মক।
তোমার কান্নায় আমার অন্তর কাঁদে না তা নয়। তোমার প্রতি দয়া দেখানোর প্রশ্নে আগের তিনজন ফেরেশতার চেয়েও আমার অন্তর অনেক নরম দয়ার্দ্র। কিন্তু আমার মধ্যে যে কঠোরতা আছে তা মিষ্টান্নের চেয়ে সুস্বাদু। কোনো এতিমের গালে যদি আমি চড় দেই তা কোনো উদার মানুষ তার হাতে মিষ্টান্ন দেয়ার চেয়েও উত্তম। আমি মৃত্যুর দূত, মানুষের জান কবজ করি, আমার মধ্যে আছে আল্লাহর পরাক্রমশীলতার প্রতিভাস কঠোরতা। তবে এই কঠোরতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অফুরন্ত দয়া। আমাকে দেখে তুমি কাঁদ, আমার কঠোরতায় তুমি ভয়ে জড়োসড়ো হও; কিন্তু তিনি যে আমার অন্তরে গোপন দয়ার ঢেউ তোলেন তা তুমি দেখ না। এই কঠোরতার মাঝে যে দয়া-অনুগ্রহ লুকায়িত তার উপমা হতে পারে গোবরের স্তূপে আকীক পাথর খুঁজে পাওয়ার মতো। আল্লাহ অনেক সময় মানুষকে বিপদের মুখে ফেলেন, সেই বিপদ দিয়ে আসলে বান্দাকে উদ্ধার করেন। তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেন, গুনাহ থেকে বাঁচান। কাজেই আল্লাহর কহর ও গযব আমার উদারতা সহনশীলতার চেয়ে বহুগুণে উত্তম।
বত্তরীন কাহরাশ বেহ আয হেলমে দো কউন
নে‘মা রাব্বুল আলামীন ওয়া নে‘মা আউন
তার তুচ্ছ কহরও উত্তম দু’জাহানের উদারতার চেয়ে
তিনি উত্তম প্রতিপালক উত্তম সাহায্যকারী বান্দার তরে।
লুতফহা’য়ে মুযমার আন্দর কাহরে উ
জান সেপুরদান জান ফযা’য়দ বাহরে উ
তার কহরের মধ্যে লুকায়িত অজস্র দয়া অনুগ্রহ
তার জন্য প্রাণ দাও তিনি প্রাণ দেবেন অহরহ।
যদি মনে কর তিনি তোমার প্রতি কঠোর হয়েছেন, তোমাকে বিপদগ্রস্ত করেছেন, তা দুই জাহানের চেয়েও তোমার জন্য উত্তম। কারণ, তিনিই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, বান্দার একমাত্র সাহায্যকারী তিনিই। তিনিই জানেন বান্দার জন্য কখন কী প্রয়োজন। তার কঠিন কঠোর আদেশের মধ্যে নিহিত থাকে শত শত দয়া ও অনুগ্রহের অনুষঙ্গ। জিহাদ ও আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে প্রাণ দেয়া নিশ্চয়ই কঠোরতা। কিন্তু তার মধ্যে যে দয়া লুকায়িত তার বর্ণনা আছে কোরআনে। ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তারা রিজিকপ্রাপ্ত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৬৯)।
কাজেই তুমি খারাপ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসো। গোমরাহির গহ্বর থেকে হেদায়তের প্রান্তরে পা রাখ। তার আহ্বানে সাড়া দাও।
অ’ন তাআলি উ তাআলীহা’ দাহাদ
মস্তী ও জুফতো ও নেহা’লীহা’ দাহাদ
তার সে আহ্বান নেবেন তোমাকে উন্নতির শীর্ষে
দেবেন মত্ততা, জোড় দেবেন আরো মখমল পেতে। (১৬৭০)
তার আদেশের অনুগত হও, তা যতই কঠিন কঠোর মনে হোক, তা পালন করলে, তোমাকে বেহেশতের শারাবান তহুরা দিয়ে আপ্যায়িত করা হবে (সুরা দাহার : ২১)। দেয়া হবে পবিত্র জীবন-সঙ্গীনী হুর গেলমান (সুরা বাকারা : ২৫)। আর মখমলের বিছানা আরাম কেদারা দেবেন তোমার সম্মানে (সুরা আর রহমান : ৫৪)। মাটির উদ্দেশ্যে জিবরাঈল বললেন, আমি তোমার আপত্তি, আহজারি, কান্নার পরোয়া করি না। আল্লাহর আদেশ পালন ছাড়া কিছু বুঝি না। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৬২০-১৬৮২)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা।
ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)