মকতবের দুষ্ট ছেলেরা সবাই মিলে উস্তাদকে অসুস্থ বলতে বলতে হুজুর মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেন। ভাবতে লাগলেন, আসলেই আমার অসুখ হয়েছে। শরীরটা যে ভালো না। মকতবের বুদ্ধিমান ছেলেটি দেখল, তাদের কুমন্ত্রণায় অসুস্থ উস্তাদ বিছানায় পড়ে আছেন ঠিকই; কিন্তু তাদের ছুটি দেয়ার কোনো কথা বলছেন না। মনে হচ্ছে তাদের পরিকল্পনা বিফলে গেছে। ছাত্ররা তখন মকতবের বাইরে অলিন্দে মাথা ঝুলিযে শরীর দুলিয়ে সবক ইয়াদ করার ভান করছিল। বুদ্ধিমান ছেলেটির মাথায় নতুন এক বুদ্ধি খেলে গেল। বলল, বন্ধুরা! তোমরা জোরে জোরে পড়। তাদের সমস্বরে আওয়াজে গমগম করে উঠল পুরো পরিবেশ। সে এবার বলে উঠল, এই ছেলেরা, তোমরা যেভাবে পড়ছ, উস্তাদজির কষ্ট হচ্ছে। তিনি অসুস্থ। কয় টাকা বেতন পান হুজুর। তিনি জীবনটা শেষ করে দিবেন বুঝি। তোমাদের শোরগোলে তিনি তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। উস্তাদ শুনে বললেন, ঠিক বলছ, বাবা তোমরা চলে যাও, তোমাদের ছুটি। আমার ভীষণ মাথা ধরেছে। উস্তাদকে সালাম দিয়ে ছেলেরা উড়াল দেয়ার আগে বলে গেল, আপনার রোগশোক দূর হয়ে যাক উস্তাদজি। তারা এখন বাতাসের বেগে বাড়ির পানে, যেন পাখিরা উড়াল দিয়েছে ডানা মেলে।
বাড়িতে গিয়ে দেখে মায়েরা উদ্বিগ্ন। জানতে চায়, মকতব থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কারণ। আজ তো পড়া দেয়ার দিন। অন্যদিনের চেয়ে দেরি হওয়ার কথা। মাকে জানাল, আমরা মকতব ফাঁকি দিয়ে আসিনি। আমরা কোনো দোষ করিনি। উস্তাদজি আজকে অসুস্থ, ভীষণ জ্বর, সারা শরীরে ব্যথা। এখন বাসায় শয্যাশায়ী। মায়েরা বিশ্বাস করে না দুষ্টদের কথা। বলে হয়তো কোনো ফন্দি করে এসেছ। সবক দেয়ার ভয়ে উস্তাদকে ফাঁকি দিয়েছ। ছেলেরা অভিযোগ অস্বীকার করে। ঠিক হলো, কাল আমরা গিয়ে খোঁজ নেব ব্যাপার কি হয়েছে।
মায়েরা পরদিন মকতবে এল খবর নিতে। দেখে উস্তাদজি ঘুমিয়ে আছেন কম্বল মুড়ে। কম্বলের গরমে ঘামে চপচপে শরীর। মাথায় পট্টি। মুখে অস্ফুট আওয়াজ উহঃ আহঃ। মহিলারা লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা পড়ল সমবেদনার সুরে। বলল, উস্তাদজি আল্লাহ শিফা দিবেন, আমরা জানতাম না আপনার এ রকম অসুখ হয়েছে। উস্তাদ বলেন, আমারও খবর ছিল না, দানির মার ছেলেটাই প্রথম আমাকে বলল, হুজুর আপনার তো অসুখ। আপনার চেহারার রঙ পাল্টে গেছে। আমি তো সারাক্ষণ ইলমচর্চা, পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকি। শরীরের খোঁজ কখন রাখি। ভেতরে এত রোগ শোক জানতাম না কখন বাসা বেঁধেছে।
মওলানা রুমি বলেন, মানুষ যখন কোনো বিষয় নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকে, নিজের দুঃখ বেদনার কথাও তখন ভুলে যায় সম্পূর্ণরূপে। উদাহরণ স্বরূপ, মিশরের অভিজাত রমণীরা যখন ইউসুফের সৌন্দর্য দেখে বিভোর ছিল, তখন নিজেদের হাত যে কেটে রক্তপাত করল সে ব্যাপারেও বেখবর ছিল।
ইউসুফ (আ.) এর প্রতি জুলায়খার আসক্তির ঘটনাবহুল বর্ণনা এসেছে সূরা ইউসুফে। সৎভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইউসুফ (আ.) কৈশোরেই মিশরের বাজারে কৃতদাস হয়ে নিলামে ওঠেন। তার অপরূপ নৌন্দর্যের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দিনদিন দাম বাড়তে থাকে নিলাম বাজারে।
শেষ পর্যন্ত দাঁড়িপাল্লার একপাশে ইউসুফ, আরেক পাশে স্বর্ণ দিয়ে মেপে ইউসুফকে কিনে নেন মিশর অধিপতি আজিয। তারপরের ঘটনা বিচিত্র। আজিযের পত্নী জুলায়খা কৃতদাস ইউসুফের প্রতি আসক্ত হয় বেসামালভাবে। আল্লাহর ভয়ে পয়গাম্বর তনয় ইউসুফ (আ.) চারিত্রিক সংযমের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কৃতদাসের প্রতি সম্রাজ্ঞীর এই প্রাণাসক্তির খবর চাউর হতে সময় লাগেনি। কানাঘুষা চলতে থাকে রাজধানীর কুলবধূদের অন্দর মহলে।
জটিল পরিস্থিতিতে বিচলিত বুদ্ধিমতি জুলায়খা পরিকল্পনা নেয়, বাস্তব আবস্থা ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে হাতেনাতে। তখনই তারা, আমি কেন প্রাণটা ইউসুফের পায়ে লুটিয়ে দিতে চাই, সে যৌক্তিকতা মানবে।
যেই চিন্তা, সেই কাজ। আয়োজন করলেন মহিলাদের বিরাট ভোজসভার। রাজকীয় আয়োজনে অভিজাত ঘরের রমণীরা সম্মানিত, আহ্লাদিত। পরিবেশিত হলো হরেক রকম ফলমূল। কেটে খাওয়ার জন্য প্রত্যেকের হাতে একেকটা ছুরি। ইউসুফের প্রতি জুলাইখার নির্দেশ ছিল, অন্তত মেহমানদের সামনে আমাকে লজ্জিত করতে পারবে না। কাজটা সামান্য। যখন ঈশারা করব, ভোজ সভায় একটু দেখা দিয়ে চলে আসবে। এ আমার আদেশ নয়, একান্ত অনুরোধ।
কানায় কানায় জৌলুসে যুলাইখা অথিতিদের শুভেচ্ছা জানালেন। বললেন, দয়া করে সামান্য আপ্যায়ন গ্রহণ করুন। সম্রাজ্ঞীর সম্ভাষণে আপ্লুত মিশর রমণীদের এক হাতে মাল্টা ধরা, আরেক হাতে ছুরি। জুলাইখার চোখ ঈশারায় ইউসুফ এক দরজা দিয়ে ঢুকে মুহূর্তে বেরিয়ে গেলেন আরেক দরজা দিয়ে। হঠাৎ খেলে গেল বিজলি চমক। মিশর রমণীরা হতচকিত বিহ্বল। একি দেখলাম! বিদ্যুতের ঝলক, নাকি ফেরেশতার নূরের বজ্রপাত। এরি মধ্যে ঘটে গেল অঘটন, বয়ে গেল রক্তের স্রোত। রমণীরা প্রত্যেকে অজান্তে জবাই করল নিজেরা নিজের হাত, খাওয়ার টেবিলে এ কেমন রক্তপাত!
এ বর্ণনাটি সরাসরি কোরআন মজীদ থেকে শোনা যাক। তবেই বোঝা যাবে আল্লাহর সৃষ্টি সৌন্দর্যের অপার রহস্য। বুঝা যাবে ইউসুফ কত সুন্দর ছিলেন, তার চেয়েও কত সুন্দর ছিলেন আমার প্রিয় রাসুল (সা.)। জুলায়খার অসহায়ত্বের প্রতিও হয়তো তখন ক্ষমা সুন্দর মমতা জাগবে। ইউসুফের চারিত্রিক দৃঢ়তা, আল্লাহর ভয় ও মহব্বত অনুরণিত হবে আমাদের ধমনীতে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন :
স্ত্রীলোকটি (জুলাইখা) যখন তাদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনল, তখন সে ওদের ডেকে পাঠাল। ওদের জন্য আসন প্রস্তুত করল। আর ওদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ছুরি দিলো (পরিবেশিত ফলমূল কেটে খাওয়ার জন্য) এবং (ইউসুফকে) বলল : ওদের সম্মুুখে বের হও! তারপর তারা (রমণীরা) যখন তাকে দেখল, তখন তারা তার গরিমায় অভিভূত হলো এবং নিজেদের হাত কেটে ফেলল (কারও হাত বাদ থাকল না) তারা বলল : অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য। এ তো মানুষ নয়, এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা। (সুরা ইউসুফ : ৩১)।
বস্তুবাদী বিজ্ঞানীরা বস্তুর বাইরে, ল্যাবরটরিতে যা পরীক্ষা করা যায় না বা আচরণে প্রকাশ পায় না, এমন কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করতে না রাজ। তারা এসব বিষয়কে মনের কল্পনা ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিতে চান। মওলানা রুমি এ গল্পের আদলে প্রমাণ করেছেন যে, বস্তুর অন্তরালে যে মনোজগতের অস্তিত্ব আছে তার ভূমিকা ও ক্ষমতা অপার। মনের ক্ষমতা দেহকেও প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করে। মানুষ যখন তার মনের ভুবনে তন্ময় হয়ে যায়, তখন দেহেরও খবর থাকে না। এর উদাহরণ মিশর রমণীরা। তারা গণহারে নিজের আঙুল কেটে রক্তপাত ঘটাল। অথচ তাদের হুঁশ ছিল না। মওলানা মানুষের বাস্তব জীবন থেকে মনোজ্ঞ উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, মনের প্রভাব অনস্বীকার্য। বহু বীর কেশরি আছে যুদ্ধের ময়দানে তাদের হাত-পা কাটা যায় অথচ তাদের খবর থাকে না নিজের অঙ্গহানী বা রক্তপাতের কথা।
মওলানা গল্পের উপসংহারে বলতে চান, আমরা যাকে মানুষ বলি সে দেহসর্বস্ব নয়। তার দেহের ভেতরে একটি সত্তা আছে। দেহ সেই সত্তার পোশাকের মতো। দেহরূপী পোশাকের ভেতরে যে সত্তা বিরাজ করে তার নাম রূহ। সেই রূহই আসল। তোমার উচিত বাইরের পোশাকের ভেতরের সেই মানুষকে খোঁজ করা। তোমার দেহ খুশি হয় দুনিয়ার ভোগের সামগ্রী নিয়ে। কিন্তু রূহ সন্তুষ্ট হয়, আল্লাহর তাওহীদের খোরাক পেলে। বাইরের দেহের অবয়বের অন্তরালে রূহের একটি অবয়ব আছে। তুমি যখন ঘুমে স্বপ্ন দেখ, তখন এমন কিছু দেখ যার হাত-পা অবয়ব আছে।
মনে করো না যে, স্বপ্নের দেখা বিষয়গুলো অবাস্তব। এসবেরও বাস্তবতা ও অস্তিত্ব আছে। আমি বলতে যেই সত্তা, তা আমার ভেতর জগতে বিরাজ করে। আমি যখন বলি আমার বই, আমার কলম। বুঝা যায়, আমি ভিন্ন আর আমার বই বা কলম ভিন্ন। অনুরূপ যখন বলি আমার হাত-পা।
তখন বুঝতে হবে আমি আমার হাত পায়ের চেয়ে আলাদা সত্তা। সেটিই আমি। এর নাম নফসে নাতেকা। মৃত্যু হলে সে সত্তাই দেহকে ছেড়ে চলে যায়। তুমি তোমার সত্তাকে চেনার চেষ্টা কর। তবেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। নচেত দুষ্ট ছাত্রদের কুমন্ত্রণায় উস্তাদের দেহসত্তা রোগাক্রান্ত হওয়ার মতো শয়তানের কুমন্ত্রণায় তোমার গোটা অস্তিত্ব বিপদগ্রস্ত হবে। যে পরম সত্তার কাছ থেকে তোমার রূহ মর্ত্যজগতে এসেছে তার সঙ্গে সংযোগ যত দৃঢ় হবে, তোমার জীবন ততই নিরাপদ, উভয় জগতে সফলকাম হবে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ,
তৃতীয় খণ্ড, বয়েত : ১৫৮৬-১৬১৩)