মাওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৩৫০)
জীবন হোক আল্লাহতে সমর্পিত
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষের হাত-পায়ে জিঞ্জিরবেড়ির বাঁধন বা কারাগারের লৌহকপাট যতই শক্ত হোক, কোনো না কোনোভাবে খোলা যাবেই। কারণ তা প্রকাশ্যে দেখা যায়। কিন্তু মানুষের ভাগ্যের ওপর যে জিঞ্জিরবেড়ি তা খোলার সাধ্য নেই। এ বাঁধন কখনও মানুষকে সৌভাগ্যের আকাশে নিয়ে যায়, কখনও ধ্বংস অধপতনের গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যায়। এ বাঁধন অদৃশ্য, শুধু তারাই দেখতে পায়, যারা স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী।
বন্দে তকদির ও কাযায়ে মুখতাফি
কে নবীনদ অ’ন বজুয জা’নে সফী
তকদিরের ফায়সালা নিয়তির অদৃশ্য বাঁধন
দেখে শুধু সে যার হৃদয় স্বচ্ছ আয়নার মতো।
কাজেই ভবিষ্যতের কোনো কাজের দায়িত্ব আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সোপর্দ করাই বিচক্ষণ লোকের কাজ। কিন্তু গহিন বন নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন দরবেশ সে নিয়ম মানেননি। নিজ হাতে গাছ থেকে আমরুদ পেড়ে খাবেন না বলে আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করার সময় ইনশাআল্লাহ বলেননি। যার ফলে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হলো।
পাঞ্জ রোয অ’ন বাদ আমরুদি নরিখত
যা’তশে জুআশ সবূরি মী গুরিখত
এরপর থেকে পাঁচদিন বাতাসে পড়ল না আমরুদ ঝরে
ক্ষুধার আগুনে দরবেশের ধৈর্য পালাল দেশ ছেড়ে।
পাঁচ দিন ধরে কিছু খায়নি দরবেশ। ক্ষুধার আগুনে তার পৃথিবী গদ্যময়। থোকা থোকা আমরুদ ঝুলছে। অথচ একটিও ঝরে পড়ে না বাতাসের দোলায়। এরপরও তিনি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখালেন। একবার প্রবল বাতাস বয়ে গেল। দরবেশ ভাবলেন, এ বুঝি টুপ করে একটি আমরুদ ঝরে পড়বে, তিনি ক্ষুণিœবৃত্তি করবেন। কিন্তু না, পড়ল না। ক্ষুধা, দুর্বলতার সঙ্গে তকদিরের ফায়সালা তাকে কাবু করে ফেলল। তিনি হাতটা বাড়িয়ে ক’টি আমরুদ পাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরে খবর হয়ে গেল। তুমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছ। আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ভঙ্গের শাস্তি ভোগ করতে হবে। হ্যাঁ, আল্লাহর তরফে এমন শাস্তি এলো, যা তার দিব্যচক্ষু খুলে দিল।
দরবেশ বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আচমকা জনাবিশেক ডাকাত এসে জটলা পাকাল সেই বাগানে। ডাকাতির মালমাত্তা ভাগ করে সেখানে বসে। ঘটনার ওপর নজরদারি ছিল সরকারি গোয়েন্দার। থানায় খবর দিল, অমুক বনে ডাকাতের দল চোরাই মালামাল ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত। এখনই অভিযান চালালে হাতেনাতে পাকড়াও হবে। অতি দ্রুত গতিতে র্যাপিড অ্যাকশন টহল দল ঘটনাস্থলে হাজির। ডাকাতরা হাতেনাতে পাকড়াও। দ্রুত কার্যকর আইনে বিচার হলো। শরিয়াহ আইনে প্রত্যেকের বাম পা, ডান হাত কাটা হলো। চরম হট্টগোলের মধ্যে বেচারা দরবেশের বিচার এবার। ডাকাত দলের সঙ্গে থাকায় বেচারা চোর সাব্যস্ত হলো। প্রথমে তার ডান হাত কাটা হলো, তারপর বাম পা কর্তিত। দরবেশ এগিয়ে দিল পা। দূর থেকে অশ্বারোহী দারোগা ডাক দিল, ওহে কী করো। ইনি তো চোর নন, ডাকাত নন। আল্লাহর অলি, অমুক আব্দাল। বাছবিচার না করে কেন মহান বুজর্গের হাত কাটলে তোমরা?
আল্লাহর অলির পরিচয় শুনে পুলিশ বেচারার পিলে চমকে উঠল। একি করলাম, হায় খোদা! আল্লাহর কসম না জেনে এত বড় জঘন্য পাপ করেছি। দরবেশের পায়ে ক্ষমা চায় পুলিশ। দরবেশ বললেন, অস্থির হইও না। এই শাস্তি আমার পাওনা ছিল।
মন শেকাস্তাম হুরমতে আয়মা’নে উ
পস ইয়ামীনাম বুর্দ দা’দেস্তা’নে উ
আমি তার সঙ্গে অঙ্গীকারের করেছি সম্মান হানি,
তার বিচারই কেটে নিয়েছে আমার ডান হাতখানি।
আল্লাহর সঙ্গে আমিই অঙ্গীকার করেছিলাম, আমরুদ গাছের ফল যেটি ঝড়ে পড়বে শুধু সেটিই কুড়িয়ে খাব। নিজে গাছ থেকে পেড়ে খাব না। (আল্লাহ রিজিকদাতা- এই ঈমানে সিদ্ধি লাভ করব।) কিন্তু সেই অঙ্গীকার আমি নিজেই ভঙ্গ করেছি। অথচ জানতাম যে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে ভোগ করতেই হবে। দারোগার উদ্দেশ্যে শেখ বললেন,
দস্তে মা’ ও পা’য়ে মা’ ও মাগজ ও পুস্ত
বা’দ আই ওয়ালি ফেদা’য়ে হুকমে দূস্ত
আমার হাত, আমার পা অস্থি মজ্জা চামড়া যত
বন্ধুর হুকুমের তরে হে দারোগা নিয়ত উৎসর্গিত।
এ শাস্তি আমার ভাগ্যে ছিল, আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। যেহেতু না জেনে করেছ এর অশুভ প্রতিক্রিয়া থেকে তুমি নিরাপদ। আমার প্রকৃত অবস্থা তো তিনিই জানেন, যার ইচ্ছার সঙ্গে লড়ার সাধ্য কারও নেই। দেখ না, অনেক বিচক্ষণ পাখি খাবারের খোঁজে গিয়ে নিজের গর্দানটা এগিয়ে দেয় শিকারির পাতানো জালে। বিচক্ষণ মাছও খাবারের লোভে বড়শির কাঁটা গিলে প্রাণ দেয়। বহু পূতঃচরিত্রের ভদ্রজন, ফুলের মতো চরিত্র, অথচ কখন যৌনতার ডোবায় পড়ে দুনিয়া আখেরাত বরবাদ করে দেয়, টেরও পায় না। আদালতের বিচারপতি, দেশজুড়ে যার সুনাম সুখ্যাতি। দেখা যায়, হঠাৎ ঘুষের অন্ধকূপে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংসের গহ্বরে তলিয়ে গেল।
কোরআনে বর্ণিত হারুত-মারুত ফেরেশতার ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয়। এ জন্যই তো বায়েজিদ বোস্তামি যখন দেখলেন, নামাজে তার অলসতা আসে। বুঝতে পারলেন, পানি পান করার কারণে তার এ জড়তা, আড়ষ্টতা। তাই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, ১ বছর পানি পান করবেন না। ১ বছর পানি পান থেকে বিরত থাকা ছিল বায়েজিদ বোস্তামির কৃচ্ছ্রসাধনার ন্যূনতম নমুনা। নচেৎ তার কৃচ্ছ্রসাধনা ছিল অসাধারণ। তাই তিনি আরিফদের কুতুব, সুলতানুল আউলিয়া হিসেবে দুুনিয়াতে নন্দিত। দেখা গেল, পেটের তাড়নায় যখন দরবেশের হাত কর্তিত হলো, তখন তিনি আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পিত। এরই সুবাদে লোক সমাজে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ‘শেখে আকতা’ (হাত কাটা শায়খ) হিসেবে।
একদিন হঠাৎ এক দর্শনার্থী দরবেশের আস্তানায় প্রবেশ করে দেখে, ডান হাত কর্তিত শেখ দিব্যি দুই হাতে একটি ঝুড়ি বুনছেন। বিচলিত দরবেশ তাকে ভর্ৎসনা করে বললেন, বিনা অনুমতিতে কেন আমার আস্তানায় প্রবেশ করলে? ভয়ে কাচুমাচু আগন্তুক বলল, হুজুুর আপনার প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার আকর্ষণে আমি এমনটি করেছি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না। দরবেশ বললেন, যাক। এখন কথা হলো আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি আজকের এই ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারবে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে আরেকদিন কয়েকজন লোক জানালার ফাঁকে লক্ষ্য করল, শেখ দুই হাতে ঝুড়ি বুনছেন। দরবেশ টের পেয়ে সরাসরি আল্লাহর কাছে অনুযোগ করলেন, প্রভু হে! এই রহস্য তো তোমার জানা। আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম, এখন তুমিই তা ফাঁস করে দিয়েছ। কারণ তো আমার বুঝে আসে না।
আল্লাহর তরফ থেকে ইলহাম এলো, সেই বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে তোমার হাত কাটা যাওয়ায় কিছুলোক তোমার বুজর্গিকে অস্বীকার করেছিল। তুমি আমার প্রিয়জন তোমার প্রতি কারও বিদ্বেষ আমি বরদাশত করতে পারি না। তারা বলছিল, এই লোক আসলে ভ-। আল্লাহ তাই তাকে মানুষের সামনে এভাবে অপমানিত করেছেন। কিন্তু তুমি আমার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রমাণ করেছ, তুমি সত্য, তোমার বুজর্গি সত্য। আল্লাহর অলির প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণে এ দলটি কাফের হয়ে যাক, তা আমি চাইনি। এজন্যই তোমার কারামত তাদের সামনে ফাঁস করে দিয়েছি।
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো অলির প্রতি শত্রুতা পোষণ করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।’ (বোখারি শরিফ)। অবশ্যই এ কারামাতের আগেই আমি তোমাকে আমার সান্নিধ্য দিয়ে আত্মিক প্রশান্তিতে ডুবিয়ে রেখেছি। তার প্রমাণ, তুমি দেহের মৃত্যু, অঙ্গহানির ধাপ অতিক্রম করে মৃত্যুভয়কে জয় করেছ। দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতা নয়, আমার সাক্ষাৎ লাভই তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। ফেরাউনের রোষানলে পড়ে জাদুকররাও এভাবেই পরকালীন জীবনকে বেছে নিয়েছিল আল্লাহ প্রেমের আকর্ষণে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, তৃতীয় খণ্ড, বয়েত : ১৬৭২-১৭২০)