জীবনের জয়-পরাজয় ও সার্থকতা

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নির্জন বনে ইবাদতে নিমগ্ন দরবেশের হাত কাটা যায় চুরির অভিযোগে। সে কাহিনি আগের কিস্তিতে আলোচনা করেছি। দরবেশ তকদিরের ফায়সালা সানন্দে মাথা পেতে নিয়ে পরীক্ষায় চমৎকারভাবে উত্তীর্ণ হন। আল্লাহর কাছ থেকে গায়েবি দুটি হাত তিনি লাভ করেন। তিনি মনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন যে, আমি আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছি। কাজেই এমন শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। ইতোপূর্বে আলোচিত এই কাহিনির উপসংহারে মওলানা রুমি বলেন, দরবেশের কাছে ইলহাম আসে, হে দরবেশ! তুমি সত্য। আধ্যাত্মিকতায় তুমি কামালিয়াত হাসিল করেছ। তার প্রমাণ, তুমি মৃত্যুভয়কে জয় করেছ। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার আগ্রহ ব্যক্তির কামালিয়তের প্রমাণ। এখানেই শাহাদাতের মাহাত্ম্য নিহিত।

মওলানা রুমি প্রমাণ হিসেবে মুসা (আ.) এর সঙ্গে ফেরাউনের জাদুর প্রতিযোগিতা আর জাদুকররা হেরে গিয়ে মুসা (আ.)-এর প্রতি ঈমান আনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। সেই জাদুকররা মৃত্যুর ভয়কে জয় করেছিল। ফলে প্রাণদণ্ডের নিশ্চিত শাস্তির আশঙ্কা সত্ত্বেও তারা ঈমানহারা হয়নি। আসলে ঈমান, সত্য ও ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকাই মোমিন জীবনের আসল সাফল্য। নচেত হারজিৎ সবার জীবনে আসে। মরণের স্বাদও প্রত্যেককে গ্রহণ করতে হবে। জীবন সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, জীবনটা কীভাবে শেষ হলো, তার ভিত্তিতেই নিরূপিত হবে মানুষের জীবনের সার্থকতা। শাহাদাত যেহেতু অত্যন্ত সচেতনভাবে ও সানন্দে প্রাণের প্রাণ মহান আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা সেহেতু শাহাদাতের মর্যাদা অতুলনীয়। মওলানা রুমি ফেরাউনের জাদুকরদের শাহাদাতের তামান্নার বিষয়টি তুলে ধরেছেন এখানেÑ

সা’হেরা’ন রা’ নেই কে ফেরআউনে লয়ীন

কর্দ তাহদীদে সেয়া’সত বর যমীন

জাদুকরদের অভিশপ্ত ফেরাউন কি

দেয়নি কঠোর শাস্তি দেয়ার হুমকি?

কিন্তু তারা ফেরাউনের শাস্তির হুমকির পরোয়া করেনি; বরং হাত পা কাটা যাওয়া আর শূলে ঝুলার শাস্তি তারা বরণ করে নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, সত্যের ওপর থাকা সত্ত্বেও তাদের কেন বাহ্যত পরাজিত হতে হলো। হাত-পা কর্তিত হয়ে শূলে চড়ে কেন প্রাণ বিসর্জন দিল। তাহলে সত্যের পক্ষে থাকার সার্থকতা কোথায়? এই জটিল জিজ্ঞাসার বিশ্লেষণ মওলানা রুমি কীভাবে করেছেন, তা জানার জন্য ঐতিহাসিক ঘটনাটি সামনে আনা প্রয়োজন। যারা ইসলামি জ্ঞানে পারদর্শী তাদের জন্য মসনবির সামান্য ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ লোকদের জন্য কোরআন মজিদে বর্ণিত কাহিনি বিশদভাবে জানলে এর সত্য তাৎপর্য বোধগম্য করা সহজ হবে।

মুসা (আ.) তার শ্বশুর হজরত শোয়াইব (আ.)-এর বাড়ি মাদায়েন থেকে মিশরে আসার পথে তুয়া উপত্যকায় নবুয়ত লাভ করেন। আল্লাহতায়ালা তাকে আদেশ দেন, তুমি ফেরাউনকে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দাও এবং বনি ইসরাইল বংশের লোকদের মুক্ত কর। আদেশ পেয়ে তিনি সম্রাট ফেরাউনের কাছে গিয়ে বলেন, ‘হে ফেরাউন! আমি বিশ্বপালক আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার প্রতি প্রেরিত হয়েছি।’ (সুরা আরাফ : ১০৪)।

‘এটা স্থির নিশ্চিত যে, আমি আল্লাহর সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত কোনো কথা বলব না। (তা হলো, তিনি এক তাঁর কোনো শরিক নেই)। আমি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছি। সুতরাং (আমার পরিষ্কার দাবি) তুমি বনি ইসরাইলকে আমার সঙ্গে যেতে দাও।’ (সুরা আরাফ : ১০৫)।

তাদেরকে তুমি দাস বানিয়ে রেখো না। তাদের ওপর জুলুম অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছ। তাদেরকে আমি পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাস নিয়ে যেতে চাই।

ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ বলেন, নানা ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়ে ইউসুফ (আ.) ও তার মাতাপিতা কেনান তথা আজকের ফিলিস্তিন থেকে মিশরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ইউসুফ (আ.) এর ইন্তেকালের পর তার বংশধর বনি ইসরাইলের জনসংখ্যা বেড়ে যায়। এক সময় ফেরাউন মিশরের ক্ষমতা গ্রহণ করে বনি ইসরাইলকে দাসত্বে শৃঙ্খলিত করে। ফেরাউন ও তার বংশ কিবতিরা তাদের ওপর নানা ধরনের করারোপ, অপমান লাঞ্ছনার জীবন এবং হীন তুচ্ছ কাজে সেবাদাসগিরি করতে বাধ্য করে। ফেরাউনের ক্ষমতার দাপট চরম পর্যায়ে পৌঁছলে সে নিজেকে খোদা বলে দাবি করে। এমন প্রতাপশালী বাদশাহর সম্মুখে মুসা (আ.) যে বক্তব্য পেশ করলেন, তা ছিল রীতিমতো ধৃষ্টতা।

মুসা (আ.) ও ফেরাউনের মধ্যকার এই তর্ক ও সংলাাপের বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সুরা আরাফে। ফেরাউন ভেবেচিন্তে বলল, মূসা তোমার দাবির সত্যতার পক্ষে-‘তুমি যদি কোনো নিদর্শন এনে থাক, দেখাও দেখি। তুমি যদি সত্যবাদী হও।’ (সুরা আরাফ : ১০৬)। মুসার হাতে তখন লাঠিখানা ছিল। বললেন, তোমার হাতে এটি কী? ফেরাউন বলল, লাঠি। ‘অতঃপর মুসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল এবং তৎক্ষণাৎ তা সাক্ষাৎ অজগরে পরিণত হলো।’ (সুরা আরাফ : ১০৭)।

মুসা হাত থেকে লাঠি মাটিতে রাখলেন। তৎক্ষণাৎ তা নরসর্পে পরিণত হলো। এক বিরাট অজগর। ভাবতেই পারেনি যে, লাঠি সাপ হয়ে যাবে। সাপ বিশাল হা করে ভয়াবহ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল ফেরাউনের দিকে। এখনই বুঝি ফেরাউনের তখতসহ রাজপ্রসাদ গিলে খাবে। আতঙ্কে ফেরাউন সিংহাসন থেকে ছিটকে পড়ল। পালিয়ে গেল তো মলমূত্র ত্যাগ করে জামা কাপড়ের অবস্থা বেহাল। সাপ এখন লোকদের দিকে ফিরল, যারা ছিল ফেরাউনের চাকর-বাকর। চারদিকে হৈহুল্লোড় চিৎকার। একদল তো আতঙ্কে সেখানেই মারা পড়ল। আরেক দল পলাতে লাগল।

পলায়নপর ফেরাউন নতশিরে বলল, মুসা! সাপ থামাও। আমি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব এবং বনি ইসরাইলকে তোমার সঙ্গে পাঠিয়ে দেব। মুসা (আ.) সাপখানা ধরতেই তা লাঠি হয়ে গেল। পরিস্থিতি শান্ত হলে ফেরাউন জানতে চাইল, মুসা তোমার কাছে কি অন্য কোনো নিদর্শন আছে, যা তোমার সত্যতার পক্ষে সাক্ষী হতে পারে? মুসা বললেন, আমার আরেকটি নিদর্শন আছে। এই বলে তিনি তার হাতখানা বগলের নিচে রাখলেন। পরক্ষণে বের করলেন। আল্লাহপাক সে কথাই সংক্ষেপে বলেছেন-‘এবং সে তার হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হলো।’ (সুরা আরাফ : ১০৮)।

অর্থাৎ ফেরাউন ও অন্যদের সামনে একেবারে শুভ্র সমুজ্জ্বল আলোকিত একখানা হাত। সে হাতের জ্যোতিতে সূর্যের আলোও নিষ্প্রভ হয়ে গেল। মুসা (আ.) হাতখানা তার জামার ভেতরে বা বগল তলে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা আগের মতে স্বাভাবিক হাতে পরিণত হলো।

ফেরাউন ভয়ের চোটে মুসার প্রতি ঈমান আনার কথা বললেও, এর অর্থ তো মুসার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা। বনি ইসরাইলকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলে তো দেশ অচল হয়ে যাবে। দাস শ্রমিক শ্রেণি কাজ না করলে কিবতিদের জীবনযাত্রা অচল। কিবতিদের কর্তৃত্বের অবসান হবে। ফেরাউন সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একবার চিন্তা করল, মুসাকে হত্যা করে আপদ দূর করবে। ফেরাউনকে তার সভাসদরা সান্ত¡না দিল-‘ফেরাউনকে সম্প্রদায়ের প্রধানরা বলল, এ তো একজন সুদক্ষ জাদুকর।’ (সুরা আরাফ : ১০৯)।

তাকে হত্যা করা উচিত হবে না। কারণ জনগণের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তারা সন্দেহ করবে যে, মুসা সত্য ছিল। তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। বরং লোকটি তো জাদুকর। তাকে জাদু দিয়েই জব্দ করতে হবে। তাতে তার মিথ্যাচার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে এবং সে যে মস্তবড় জাদুকর তা প্রমাণিত হবে। মতামতটি ফেরাউনের মনঃপূত হলো। ফেরাউন জ¦ালাময়ী ভাষণ দিল, হ্যাঁ, এক মস্ত জাদুকর এসেছে দেশে। ‘এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায়।’ (সুরা আরাফ : ১১০)।

সে তার জাদুর বলে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে তাড়াতে চায়। ফেরাউন ও কিবতিদেরকে মিশর থেকে তাড়ানোই তার উদ্দেশ্য। সে একটা বিপ্লব ঘটাতে চায়। কারণ তোমাদের জীবন-জীবিকা তো বনি ইসরাইলের সেবাকর্ম আর প্রদেয় কর এর উপর নির্ভরশীল। বনি ইসরাইলকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, তোমাদের জীবন-জীবিকা ও আয়ের পথ বন্ধ করে দেয়া। এখন তোমরা কি পরামর্শ দাও। ‘তারা বলল, তাকে ও তার ভাইকে কিঞ্চিৎ অবকাশ দিন এবং বিভিন্ন শহরে জাদুকর সংগ্রাহকদের পাঠিয়ে দিন।’ (সুরা আরাফ : ১১১)। ‘আদেশ দিন, যেন তারা আপনার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ জাদুকর উপস্থিত করে।’ (সুরা আরাফ : ১১২)।

মিশরের বিভিন্ন শহরে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ওঝারা ছিল। জাদু দেখানোই ছিল তাদের পেশা। রাজকীয় ফরমান পেয়ে চারদিক থেকে তারা সমবেত হলো। ‘জাদুকররা ফেরাউনের কাছে এসে বলল, আমরা যদি বিজয়ী হই তবে আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?’ (সুরা আরাফ : ১১৩)। ‘সে বলল, হ্যাঁ এবং তোমরা অবশ্যই আমার সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা আরাফ : ১১৪)।

বেতন ভাতা পুরস্কার তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা, তোমরা আমার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হবে। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কি চাও। নির্ধারিত দিনক্ষণে জাতীয় উৎসবের দিনে জাদুকররা মুসার উদ্দেশ্যে বলল-‘তারা বলল, হে মুসা! আপনি কি আগে নিক্ষেপ করবেন, নাকি আমরাই নিক্ষেপ করব?’ (সুরা আরাফ : ১১৫)। ‘মুসা (আ.) বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা নিক্ষেপ করল, তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল তাদেরকে আতঙ্কিত করল এবং তারা এক বড় রকমের জাদু দেখাল।’ (সুরা আরাফ : ১১৬)।

মওলানা রুমি অন্যত্র বলেন, এই যে জাদুকররা মুসা (আ.)-কে সমীহ করল। মুসা (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করল যে, আগে কি আপনি নিক্ষেপ করবেন, নাকি আমরা নিক্ষেপ করব, তার মধ্যে আল্লাহর নবীর প্রতি আদব প্রকাশ পেয়েছিল তারই বরকতে আল্লাহ তাদের ঈমান নসিব করেছিলেন। ফেরাউন তাদের প্রাণদণ্ড দিয়ে শাস্তি দিলেও তাদের পরকালীন জীবন হয়েছিল সুন্দর, সুখময় ও সত্যের আলোতে সমুজ্জ্বল।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৩য় খণ্ড, বয়েত : ১৭২১ ; ব্যাখ্যা তাফসিরে মাইবেদি অবলম্বনে)