ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উট ও খচ্চরের সংলাপে পরকাল দর্শন

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
উট ও খচ্চরের সংলাপে পরকাল দর্শন

মরুময় আরবে দূরপাল্লার সফরের নির্ভরযোগ্য বাহন ছিল উট। তাই উটের আরেক নাম মরুভূমির জাহাজ। ধূসর মরুর নিকট-পাল্লার আরেকটি যানবাহন খচ্চর। খচ্চর একদিন উটের কাছে জানতে চায়, বন্ধু! আমিও তোমার মতো যানবাহনের কাজ করি; কিন্তু তোমার তুলনায় আমি অনেক পিছিয়ে, কারণ কী? তোমাকে দেখি, উঁচু টিলায় চড়ে, মরুর বুক চিরে, এমনকি অলিগলি দিয়ে চড়াই-উতরাই সমানে মাড়িয়ে পথ চলো। কোথাও হোঁচট খাও না: ক্লান্ত হও না! অথচ আমার অবস্থা পথভোলা মানুষের মতো। আমি পা পিছলে পড়ে যাই। পদে পদে হোঁচট খাই। এর কারণ কি বলতে পার? তোমার তালিম পেলে আমার পদক্ষেপও শক্ত হবে, আশা করি।

উট বলে, ছোট বন্ধু! এর কারণ, দুটি দিক দিয়ে আমি তোমার চেয়ে অগ্রগামী। একটি, আমার চোখের জ্যোতি। তোমার দৃষ্টিশক্তির চেয়ে আমার দৃষ্টিশক্তি প্রখর। দ্বিতীয়ত, আমার গর্দান তোমার গর্দানের চেয়ে অনেক উঁচু। এ কারণে অনেক ওপর থেকে দেখার সুবিধাটা আমার আছে।

চোন বরা’য়াম বর সরে কূহে বোলান্দ

আখেরে আকবা বেবিনাম হুশমান্দ

যখন উঠি কোনো উঁচু পাহাড়ের ওপর

বিচক্ষণতায় দেখি গিরিপথের শেষ স্তর।

আমি পাহাড়ের ওপর উঠলে গিরিপথের শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই। রাস্তার খাদণ্ডখন্দক, চড়াই-উতরাই সবকিছু দেখে নেয়ার সুবিধাটা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। ফলে-

হার কদম রা’ আয সরে বিনশ নাহাম

আয এশার ও উফতাদন ওয়া রাহাম

প্রতিটি কদম ফেলি সংযমে সতর্কতায় দেখে দেখে

আমার পা পিছলায় না, হোঁচট খায় না, এই কারণে।

আমি হুঁশজ্ঞান ঠিক রেখে পথ চলি, তাই আমার পথচলার পদক্ষেপ মজবুত। জীবনযাত্রার পথে পথে আমি গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাই না। কোনো কাজ করতে হলে বুঝে শুনে অগ্রসর হই। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের আলো না দেখা পর্যন্ত আমি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করি না। আর তোমার অবস্থা হলো-

তো বেবিনি পিশে খোদ য়্যক দো সে গা’ম

দা’না বীনী ওয়া নবীনী রঞ্জে দা’ম

সম্মুখের এক পা দুই পার বেশি দেখ না তুমি

ছড়ানো দানা দেখ, দেখ না পাতানো ফাঁদখানি।

তোমার দৃষ্টি সংকীর্ণ। সম্মুখের এক কদম দুই কদমের বেশি দেখ না। শিকারি মাঠে দানা ছড়ায়। তুমি সেই দানা ও খাবারটাই দেখ, নিচে পাতানো ফাঁদের জাল দেখ না। ফলে বস্তু ও ভোগের কবলে গ্রেপ্তার হয়ে পদে পদে হোঁচট খাও। এখন তুমিই বিচার করো-

ইয়াস্তাবিল ‘আমা লদাইকুম ওয়াল বসীর

ফিল মাকামে ওয়ান্নুযুলে ওয়াল মাসীর

তোমার দৃষ্টিতে অন্ধ আর দৃষ্টিবান কি এক সমান

পথ চলায়, উঠতে নামতে, যখন উভয় দণ্ডায়মান?

একজন লোক অন্ধ, আরেকজন দৃষ্টিবান। তারা যখন দাঁড়ায়, কিংবা নিচে নামে বা পথ চলে, তখন উভয়ের অবস্থা কি সমান হয়? আল্লাহ পাক বলেন, ‘কাফের ও মোমিনের অবস্থা দুই শ্রেণির লোকের মতো। একটি শ্রেণি অন্ধ ও বধির। আরেক শ্রেণি দৃষ্টিবান ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন। উভয় শ্রেণির অবস্থা কি এক রকম হতে পারে? এরপরও কেন তোমরা সত্যকে উপলব্ধি করতে পার না।’ (সুরা হুদ : ২৪)।

মওলানা রুমি (রহ.) বলতে চান, জীবন পথে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ মজবুত হতে হলে তোমার দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করতে হবে। চিন্তায় চরিত্রে আহারে-বিহারে যাবতীয় হীনতুচ্ছ বিষয় পরিহার করতে হবে। এক কথায় জীবন পথের শেষ গন্তব্য উপলব্ধি করার শক্তি অর্জন করতে হবে। তখনই তুমি সত্য ও ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকার শক্তি পাবে। মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারবে। সেই শেষ গন্তব্য পরকাল।

যারা পরকালে বিশ্বাসী নয় তাদের প্রশ্ন, মানুষ যখন মৃত্যুর পর মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, পরকালে আবার কীভাবে নতুন জীবন লাভ করবে? মওলানা বলেন, আল্লাহতায়ালা যখন ইচ্ছা করেন, তিনি মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করেন। প্রাণ সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর প্রাণে এমন আকর্ষণ শক্তি দান করেন, যে শক্তি তার বর্ধিত হওয়া, বিকশিত হওয়ার প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে নেয়। মানব শিশুর প্রাণে গচ্ছিত সেই আকর্ষণশক্তির কার্যক্রম জন্মের পরও চলতে থাকে। দীর্ঘ ৪০ বছর খাদ্য পানীয়সহ নানা উপাদান সে প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্রহ করে জীবনকে সাজায়। এই শক্তি তাকে দেয়া হয়েছে স্ব^ভাবজাতভাবে। মানব জীবনের গতিপ্রকৃতি তো এটাই, যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি।

জযবে আজযা রূহ রা’ তালিম কর্দ

চোন নদা’নদ জযবে আজযা শাহে ফর্দ

যে খোদা দিয়েছেন প্রাণকে উপাদান সংগ্রহের তালিম

বিছিন্ন অঙ্গ জড়ো করতে পারবেন না, বলতে চাও কি?

অকাট্য যুক্তি বিন্যাসে মওলানা রুমি জোরালো ভাষায় বলতে চান, আল্লাহতায়ালা যখন মাতৃগর্ভের ভ্রƒণে প্রাণ সঞ্চার করেন, তখনই প্রাণকে এ ক্ষমতা প্রদান করেন যে, সে নিজের বর্ধিত হওয়া, মানুষে রূপান্তরিত হওয়া ও জীবন ধারণের যাবতীয় উপাদান খাদ্যপানীয়, শ্বাস-প্রশ্বাস বা অন্য যে কোনো উপায়ে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। জীবনকে সাজায়, চালায়। এখন যদি প্রাণদাতা আল্লাহ মৃত্যুর পর ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়ো করে জীবিত করেন, তাহলে অবাক হওয়ার বা অবিশ্বাস করার কী আছে? পরকালে মানবদেহ পুনরায় জীবিত হওয়ার আরেক প্রমাণ ঋতুচক্রের বিবর্তন। খরায় মৃত উদ্ভিদ, তরুলতা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি আসলে পুনরায় জীবন ফিরে পায়।

‘হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্বন্ধে যদি তোমরা সন্দিহান হও হবে অনুধাবন কর যে, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে। তারপর শুক্র থেকে, তারপর আলাকা থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোশতপি- থেকে- তোমাদের কাছে এ কথা ব্যক্ত করার জন্য যে, আমি যা ইচ্ছা করি তা এক নির্দিষ্টকালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি, তারপর আমি তোমাদের শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কারও কারও মৃত্যু ঘটান হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয় হীনতম বয়সে। যার ফলে তারা যা কিছু জানত সে সম্বন্ধে তারা সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, অতঃপর আমি তাতে ভারি বর্ষণ করলে তা শস্য-শ্যামলা হয়ে আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং সব ধরনের নয়নাভিরাম উদ্ভিদ উদ্গত করে। এটা এ জন্য যে, আল্লাহ সত্য এবং তিনিই মৃতকে জীবন দান করেন এবং তিনি সব বিষয়ে শক্তিমান এবং কেয়ামত আসবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং কবরে যা আছে তাদের নিশ্চয় আল্লাহ উত্থিত করবেন।’ (সুরা হজ : ৫, ৭)।

মওলানা রুমি বলেন, চিন্তাকে আরেকটু কাজে লাগাও, বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা দেখ। প্রতিদিন ঘুমাও, জাগ্রত হও। ঘুমের সময় আল্লাহ হুশজ্ঞান অনুভূতি মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। আবার যখন জাগ্রত হয়, সেই অনুভূতি, হুঁশজ্ঞান ও মানসিক শক্তি ফিরিয়ে দেন। এ তো মৃত্যুর পর দেহের বিচ্ছিন্ন অঙ্গগুলো প্রাণকে কেন্দ্র করে পুনরায় জড়ো হওয়ার প্রতিদিনের মহড়া, নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা। মওলানা বলছেন, প্রতিদিন ঘুম আর জাগরণের এ ব্যবস্থার পেছনে হেকমত কি?

তা’ বেদা’নি কা’ন আযু গা’য়েব নশুদ

বা’য আয়াদ চোন বেফরমা’য়াদ কে উদ

যাতে তুমি জান, তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় না কিছু

যখনই ‘ফিরে এসো’ আদেশ দেন হাজির হয়ে যায় সবকিছু।

প্রতিদিন তোমাকে এ বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করার পেছনে হেকমত হলো, তুমি যাতে জেনে রাখ, উপলব্ধি কর যে, কোনো জিনিসই, এমনকি হুঁশজ্ঞান, চেতনা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি আল্লাহর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের বাইরে নয়। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- ‘আল্লাহই প্রাণ হরণ করেন জীবগুলোর তাদের মৃত্যুর সময় এবং যাদের মৃত্যু আসেনি তাদের প্রাণও নিদ্রার সময়। অতঃপর তিনি যার জন্য মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করেন, তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অপরগুলো ফিরিয়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।’ (সুরা যুমার : ৪২)।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, তৃতীয় খণ্ড, বয়েত : ১৭৪৬-১৭৬২)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত