ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মরণ : অধ্যাপক আ ত ম মুছলেহ উদ্দিন

জ্ঞান গবেষণার এক মূর্ত প্রতীক

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী
জ্ঞান গবেষণার এক মূর্ত প্রতীক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক আমার পিএইচডির সম্মানিত তত্ত্বাবধায়ক। ট্রিপল এমএ (আরবি, উর্দু ও ফার্সি) ডিগ্রিধারী আমার স্যার বিভাগের চেয়ারম্যান ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো প্রশাসনিক পদে ছিলেন না। ওস্তাদের প্রভাব সাগরেদের ওপর কিছু হলেও পড়ে। আমি অন্তত এ বিষয়ে তার যোগ্য উত্তরসূরি।

তিনি নিজে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন না; কিন্তু বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আর দ্বিতীয় কোন শিক্ষক ছিলেন, এমনটি আমার জানা নেই।

আমরা পাঁচজন তার কাছে মাস্টার্সে, পাঁচজন এমফিল এবং চারজন পিএইচডি গবেষণা করি। তন্মধ্যে আমি তার কাছে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি, আলহামদুলিল্লাহ।

তিনি আরবি, উর্দু এবং ফার্সি এই তিনটি সাহিত্যের ডিগ্রিধারী সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। যার কারণে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ তিনটি বিভাগে তার বিচরণ ছিল অবাধ। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ ছাড়াও থিওলজি অনুষদের তিনটি বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, বৃহৎ ইসলামি বিশ্বকোষ, আল কোরআন বিশ্বকোষ, সিরাত বিশ্বকোষ, আরবি-বাংলা অভিধান সব ক’টিতে তিনি সদস্য এবং সভাপতি ছিলেন।

তিনি ছিলেন ইসলামি ফাউন্ডেশনের নড়ড়শ ৎবারববিৎ. তিনি কত বই এবং কত থিসিস রিভিউ করেছেন এ পরিসংখ্যান ইসলামিক ফাউন্ডেশনও দিতে পারবে কি-না সন্দেহ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি, স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিভাগের থিসিস- যেগুলো ফাউন্ডেশনে প্রকাশের জন্য জমা দেয়া হতো অধিকাংশই মূল্যায়নের জন্য তাকে দেয়া হতো।

বড় বড় থিসিস আমি তার পড়ার টেবিলে দেখতাম; কিন্তু কোনোদিন ছুঁয়ে ধরার সাহস পেতাম না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জমা দেয়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকর্মীর থিসিসও দেখেছি স্যারের কাছে। তাদের কেউ কেউ আমাকে একটু সুপারিশের কথা বলেছেন। কিন্তু আমি সাহস পাইনি। কারণ তিনি এগুলো পছন্দ করতেন না।

তার আলমারিতে আমার গবেষণার কাজে লাগবে এমন বেশ কিছু গ্রন্থ ছিল। কিন্তু আমি কোনোদিন স্যারের কষ্ট হবে এজন্য ওই গ্রন্থের কথা বলিনি। তার বাসায় কেউ কিছু নিয়ে যাক এটা তিনি পছন্দ করতেন না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একজন সিনিয়র অধ্যাপক তিনি কিছু ফল নিয়ে গিয়েছিলেন, আমার সামনে তিনি ফেরত দিয়েছেন।

সুদীর্ঘ ২৭ বছর আমি তার বাসায় যাতায়াত করেছি। ওস্তাদের বাসায় যেতে যতটুকু না হলে অভদ্রতা দেখায় ঠিক ততটুকু নিয়ে যেতাম। কিন্তু তিনি আমাকে কখনও নিষেধ করতেন না।

আমার পিএইচডি ডিগ্রি হওয়ার পর স্যারের জন্য একটি পাঞ্জাবির কাপড়, ভালো একটি লুঙ্গি এবং একটি অফিসিয়াল ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি পাঞ্জাবির কাপড়টা ফেরত দিয়ে বললেন, আমার অনেক পাঞ্জাবি, এটা তোমার আব্বাকে দিও।

গবেষক হিসেবে তত্ত্বাবধায়কের অফিসিয়াল ছেঁড়া ব্যাগটি গোপনে সেলাই করে এনে দিয়েছিলাম কোনো একদিন। গবেষক হিসেবে তত্ত্বাবধায়কের জন্য করে দেয়া এটাই আমার প্রথম কাজ ছিল। অথচ আমার জানামতে আমরা অনেক তত্ত্বাবধায়কই গবেষককে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে থাকি। নানা অজুহাতে আমরা তাদের আর্থিক কষ্ট দিয়ে থাকি।

গবেষণায় তার স্বভাব ছিল, তার কাছে ফ্রেশ করে লেখে নিয়ে যেতে হতো। তিনি আমাকে বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সময় দিতেন। আসর, মাগরিব, এশা এ তিন ওয়াক্ত নামাজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে পড়তেন। (এলাকার লোকদের ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ার জন্য স্যারের একটি বড় কক্ষ নির্ধারিত ছিল)।

নাস্তাও এক-দুবার খাওয়া হতো। আমি পড়তাম আর তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। যেখানে সন্দেহ হতো সেখানে দ্বিতীয়বার পড়িয়ে নিতেন। ভুল থাকলে তিনি সংশোধন করে দিতেন। রেফারেন্সের সন্দেহ হলে তাকে বই খুলে সঠিক তথ্যটি দেখাতে হতো। এজন্য আমি একাধিকবার কুষ্টিয়া থেকে ব্যাগ ভরে বই নিয়ে সঠিক তথ্য দেখিয়ে নিস্তার পেয়েছি।

আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হই তৃতীয় বর্ষে একটি টিউটোরিয়ালে। ক্লাস শেষে একদিন তিনি আমাকে তার চেম্বার ডাকেন। টিউটোরিয়ালটা বের করে সামনে মেলে ধরেন। রেফারেন্সে বুলুগুল আরব গ্রন্থটির নাম ছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এই বইটি কোথায় দেখেছ? কারণ তার জানামতে গ্রন্থটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ছিল না। আমি বললাম, স্যার! ঢাকা আলিয়া লাইব্রেরিতে বইটি আমি পড়েছি। আমি সেখান থেকে রেফারেন্স করেছি। আমি তাকে ফাঁকি দেইনি- এজন্য তিনি খুব খুশি হলেন। সেদিন থেকে আমার প্রতি তার বিশেষ একটা টান আমি অনুভব করতে লাগলাম।

তিনি টিউটরিয়ালে একটি বিন্দু, দাড়ি কমাও সংশোধন করে দিতেন লাল কালিতে। আর পিএইচডি তিনি এমনি ছেড়ে দেবেন- এটা তার কাছে কল্পনাও করা যায় না। একটি করে হরফ না শোনা পর্যন্ত তিনি সামনে অগ্রসর হতে দিতেন না।

একবার তিনি আমাকে আট দিন আটকে রেখেছিলেন। সেজন্যই হয়তো আমার পিএইচডি থিসিস আরবি প্রবাদ সাহিত্য রিঃযড়ঁঃ ধহু পড়ৎৎবপঃরড়হ ইসলামিক ফাউন্ডেশন দু’দুবার প্রকাশ করে ২০০২ ও ২০০৫ সালে।

নিজের গবেষণার শেষ এবার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার পালা। বিভাগে এমফিল, পিএইচডির বিজ্ঞপ্তি হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সিরিয়ালি পাঁচজন ফার্স্ট বয় আমার কাছে চলে আসে গবেষণার জন্য। আমি স্যারের কাছে চলে যাই তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার এজাজত নিতে। তিনি আমাকে এজাজত দেন। তারপরে এসে আমি তত্ত্বাবধানের কাজ শুরু করি।

আমার ডিগ্রি হয় ১৯৯৯ সালে আর স্যার মারা যান ২০১৪ সালে। এ ১৫ বছরে যখনই ঢাকায় গিয়েছি স্যারের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি। একান্ত না যেতে পারলে ফোনে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।

আমরা অনেক গবেষকই তত্ত্বাবধায়কের খোঁজখবর রাখি না। জীবনে কোনোদিন একটি ফোনও করি না। গবেষক তত্ত্বাবধায়কের সম্পর্ক আত্মিক। গবেষক তত্ত্বাবধায়কের একজন পারিবারিক সদস্য। তাই সব গবেষকের উচিত তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে আমৃত্যু সম্পর্ক বজায় রাখা। আলহামদুলিল্লাহ আমার তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট ছিল।

স্যার একবার বিভাগের কাজে এসেছিলেন কুষ্টিয়ায়। বাস অনেক লেট করায় স্যার শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ড. ফারুক ঢাকা থেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। স্বভাবতই তিনি তার বাসায় ওঠেন। আমি স্যারকে আনতে গেলাম। কিন্তু ড. ফারুক বাধা দিলেন। তিনি বললেন, তুমি কি বলো আমি ওর বাসায় যাব না! তিনি ৫/৬ কেজি আঙুর-আপেল নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন।

স্যারের পিএইচডি না থাকায় তিনি ১৭ বছর নিয়মিত চাকরিতে প্রফেসর হতে পারেননি, এটা হয়তো তার কষ্ট ছিল। তাই তার গবেষকের পিএইচডি হওয়ার পর পদোন্নতি হবে না- এটা মানতে পারেননি। প্রফেসর পদের জন্য আবেদন করে আমি ১৬ মাস বসে থাকি। কেন দেরি হয়েছে তৎকালীন প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।

এটা নিয়ে আমি খুব একটা দুশ্চিন্তা করতাম না। কিন্তু স্যার খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতেন ধৈর্যধারণ করতে বলতেন। আমি বলতাম স্যার! আপনি অ্যাসোসিয়েট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। আমি আপনার ফেলো। আমি আজীবন অ্যাসোসিয়েট থাকলে আমার কোনো আফসোস নেই। আপনার কাছে আমি পিএইচডি ডিগ্রি করতে পেরেছি, এটিই আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। আমার জীবনে আর কিছুই চাই না।

তিনি ছিলেন দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, এলাকা-ইজম থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এমন নির্লোভ, নিরহংকার শিক্ষক আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়ই অভাব। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম নসিব করুন। আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত