ঢাকা ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবন-মৃত্যুর রহস্য সন্ধানে

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
জীবন-মৃত্যুর রহস্য সন্ধানে

মৃত্যু। জীবনের অমোঘ সত্য। এ সত্যকে কোনো নাস্তিকও অস্বীকার করতে পারে না, করে না। মৃত্যুর মহাসত্য সাক্ষ্য দেয় আরেক মহাসত্যের, যার নাম জন্ম। জন্ম আছে বলেই তো মৃত্যু। ইতিহাসের সাক্ষ্য হলো, প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে যেটুকু সময় হয় তার নাম জীবন। এর নামই পৃথিবীর আলো বাতাসে, সমাজ সংসারে বসবাস। ইহজীবন। জন্ম আর মৃত্যু পরম সত্য হলেও মৃত্যুর বিষয়টি একেবারে চাক্ষুস। আমরা কীভাবে জন্মেছি, চোখে দেখিনি। অন্যের জন্ম দেখে নিজের ব্যাপারে বিশ্বাস করেছি। মায়ের কাছে, প্রতিবেশীর সাক্ষ্য শুনে বিশ্বাস করেছি, কার কোলে জন্মগ্রহণ করেছি বা আমার মা-বাবা কে। বাবার বিষয়টি তো একেবারে মায়ের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের অভিজ্ঞতায় জন্মের পর আসে মরণ। কোরআন মাজিদে কিন্তু জীবনের আগে মরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে :

‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, এই মর্মে যে, তোমাদের মধ্যে কে তার কর্মকাণ্ডে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক : আয়াত-২)।

মরণ ও জীবন উভয়কে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এক ধরনের নাস্তিক আছেন, তাদের দাবি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ ‘মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়তে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’ তারা মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, জীবন ও মরণের একজন স্রষ্টা আছেন, যার হাত থেকে কারও রক্ষা নেই। নচেত তাদের মতো লোকেরা তো মৃত্যুবরণ করতে চান না। নিজের জীবন-যৌবন নিয়ন্ত্রণ করা বা মৃত্যুকে ঠেকানোর শক্তি কি তাদের আছে?

আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন, জীবন কি শুধু এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কয়েকদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ? জন্মের আগে বা মরণের পরে কি কোনো জীবনের অস্তিত্ব আছে? সৃষ্টির আদি থেকে আমরা এক জগতে ছিলাম। এর পারিভাষিক নাম ‘আলমে আরওয়াহ’ রুহের জগৎ। সেই জগতের কোনো কথা আমাদের মনে নেই। সেখান থেকে মায়ের গর্ভে এসেছি। কমবেশি ১০ মাস ১০ দিন কাটিয়েছি। মাতৃগর্ভের জগতে বেঁচে থাকা এবং সেখান থেকে পৃথিবীর নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়ে শৈশবে মায়ের কোলে দুধ পানের সময়টির কথাও আমাদের মনে নেই।

মরণের পরের একটি জীবন আছে, অনেকটা মাতৃগর্ভের প্রকোষ্ঠের মতো। যার নাম কবরজগৎ। এই প্রকোষ্ঠে থাকতে হবে কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ে পৃথিবী লন্ডভন্ড ধ্বংস হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। এরপর আরেকটি জীবন। তা আগের রুহের জগতের মতো অনন্তকালের। সেখানে পৃথিবীতে প্রত্যেকের ভালোমন্দ কাজের হিসাব নেয়া হবে। বিচারের পর নেককারদের বেহেশতের চিরসুখে নিবাস দেয়া হবে। যাদের দুনিয়ার জীবন অসৎ কর্মে কলুষিত তারা চরম শস্তি মাথায় নিয়ে দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে। জন্মের আগে মায়ের পেটে আসার ৪ মাস পর সন্তানের নড়াচড়া দেখি বলে আমরা মাতৃগর্ভের জীবনের অস্তিত্বের কথা বিশ্বাস করি। আমাদের মনে না থাকা সত্ত্বেও মাতৃগর্ভের জীবনের বাস্তবতা আর মায়ের কোলে দুধ খাওয়ার কথা পরের মুখে শুনে যদি বিশ্বাস করি, মায়ের সাক্ষ্যে পিতার পরিচয় আর পড়শিদের কথায় মায়ের পরিচয়ে অগাধ ভক্তি-বিশ্বাসের ভিত রচনা করি, তাহলে যুগে যুগে পরম সত্যবাদী মহাপুরুষ নবী-রাসুলরা, মানব জীবনের প্রথম অধ্যায় রুহের জগৎ ও মৃত্যুর পরের চতুর্থ অধ্যায় কবর জগৎ ও পঞ্চম বা শেষ অধ্যায় পরজগৎ সম্বন্ধে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করব না কোন যুক্তিতে?

মসনবি শরিফ প্রথম খণ্ডে ‘আসহাবুল উখদুদ’ এর ঘটনায় অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত কোলের শিশু তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা! আমি যখন তোমার গর্ভে ছিলাম, মনে করতাম তোমার উদরই একমাত্র দুনিয়া। ফেরেশতারা বলেছিল, হে শিশু! মায়ের উদর তোমার আসল বাসস্থান নয়; কয়েকদিন পর এমন এক জগতে যাবে, যে জগতের আয়তন মায়ের পেটের তুলনায় কোটি কোটি গুণ বড়, প্রশস্ত। সে জগৎ এখনকার মতো বদ্ধ নয়, সেখানে আলো আছে, বাতাস আছে, খাল-নদী-সাগর-মহাসাগর আছে, পাখির কুজন আছে। তোমার ছেলেমেয়ে খিলবিল করবে, সংসার আছে, আরও কতকিছু। কিন্তু সে কথা সহজে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই জন্মের সময় কেঁদেছিলাম। কিন্তু জন্মের পর দেখেছি, দুনিয়া ঠিকই মায়ের পেটের চাইতে কোটি কোটি অজুত-নিজুত গুণ বড়। এখনও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুর পারাপার পার হয়ে যে জগতে পা রেখেছি তা দুনিয়ার জগতের তুলনায় লক্ষ অজুত কোটি গুণ প্রশস্ত।

মওলানা রুমি মানব মনে ইসলামের মৌলিক আকিদা পরকালে বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করে দিতে চান। মসনবি তৃতীয় খণ্ড থেকে আমরা যেভাবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করছি তার ধারাবহিকতায় মওলানা রুমি একটি ঘটনার অবতারণা করেন। ঘটনা ছিল আল্লাহর একজন নবী হজরত উযাইর (আ.) গাধার বাহনে চড়ে পরিত্যক্ত এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে ছিল পথের সম্বল সামান্য পানি ও খাবার। মৃত জনপদ, লাশের কঙ্কাল আর ছড়ানো ছিটানো হাড়গোড়। গায়ে ছমছম করা প্রচণ্ড ভীতিকর পরিবেশ দেখে তিনি স্বগতোক্তি করেন। তার এই স্বগতোক্তি অস্বীকার অর্থে ছিল না। বরং আল্লাহর অপার রহস্য সম্বন্ধে কৌতূহল ছিল তার মনে। ঘটনার বর্ণনা আমরা সরাসরি কোরআনুল করিম থেকে জানার চেষ্টা করি :

‘অথবা তুমি সেই ব্যক্তিকে দেখনি, যে এমন এক নগরে উপনীত হয়েছিল, যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সে বলল, মৃত্যুর পর কীরূপে আল্লাহ একে জীবিত করবেন? অতপর আল্লাহ তাকে ১০০ বছর মৃত রাখলেন। পরে তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ বললেন, তুমি কতকাল অবস্থান করলে?

সে বলল, একদিন অথবা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি। তিনি বললেন, না, বরং তুমি ১০০ বছর অবস্থান করেছ। তোমার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য কর, তা অবিকৃত রয়েছে এবং তোমার গর্দভটির প্রতি লক্ষ্য করো, কারণ তোমাকে মানবজাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ করব। আর অস্থিগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর; কীভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই। যখন তা তার কাছে স্পষ্ট হলো, তখন সে বলে উঠল, আমি জানি যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সুরা বাকারা : আয়াত-২৫৯)।

মওলার রুমি বলেন, হজরত উযাইর (আ.)-কে বলা হলো, তুমি দেখ, তোমার গাধার অস্থি মাংসশুদ্ধ পচেগলে অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। তোমার সামনেই এর পাগুলো জোড়া লাগাচ্ছি। লেজ, কান, পা সব জোড়া লাগছে। দৃশ্যত কোনো হাত কাজ করছে না। কিন্তু এসবের স্রষ্টা, জীবনদাতা যিনি, তিনি সুই-সুতা বিনে সৃজন বয়নশিল্পে কত নিপুণ হুদয়ঙ্গম করো।

চশম বগুশা হাশর রা’ পয়দা’ বেবীন

তা নমানদ শোবহেআত দর ইয়াউমে দীন

চোখ খোলে দেখ হাশরের পুনরুজ্জীবন কীভাবে হবে

হাশর দিনে তোমার যেন সন্দেহের লেশমাত্র না থাকে। ৩খ. ব-১৭৬৮

তা’ বেবীনী জামেঈয়াম রা’ তামা’ম

তা’ নলরযী ওয়াক্তে মুর্দান যেহ্তেমা’ম

আমার জড়ো করার শিল্প দেখলে জাগবে হৃদয়ে প্রতীতি

মৃত্যুকালে চিন্তায় আতঙ্কে কাঁপবে না বুকের ছাতি। ৩খ. ব-১৭৬৯

মওলানা রুমির জীবন দর্শনের মূলকথা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সত্য। কাল সকালে সূর্যোদয় হবে- এ কথা যেভাবে আমরা বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকেও সেভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তখন মৃত্যুভয় থাকবে না। মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারলে জীবনে ন্যায়ের পথে চলতে ভয়ভীতির পরোয়া থাকবে না। জীবন-মরণ, ইহকাল-পরকালের বিষয় তখন একাকার হয়ে যাবে। মওলানার ভাষায় তখন মনের অবস্থা হবে:

হামচোনা’নকে ওয়াক্তে খোফতান আয়মানি

আয ফওয়াতে জুমলা হেসহা’য়ে তনী

দিনমান শেষে যখন তুমি ঘুমিয়ে পড় নির্ভাবনায় নিরালায়

চেতনা রহিত ইন্দ্রিয় বিকল তবু নির্ভার আরামের বিছানায়। ৩খ. ব-১৭৭০

তুমি জানো যে, নিদ্রাকালে তোমার চেতনাশক্তি রহিত হয়ে যায়। ইন্দ্রিয়গুলো সম্পূর্ণ বিকল ও অসাড় পড়ে থাকে। এর পরও তুমি ঘুমানোর সময় ভয় পাও না। কারণ তোমার বিশ্বাস ঘুমের পর ক্লান্তি কেটে নতুন জীবনে আবার জেগে উঠবে। মৃত্যুর পর পরকালীন জীবনে পুনর্জীবন লাভের ব্যাপারটিও অনুরূপ। হাদিসে বর্ণিত ঘুমের সময়ের একটি দোয়া প্রণিধানযোগ্য।

‘আল্লাহুম্মা বিইসমিকা আমূতু ওয়া আহয়া’ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নামেই মৃত্যুবরণ করি এবং তোমার নামেই জীবন লাভ করি।’ ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে পড়ার দোয়া : ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আহয়ানি বা‘দা মা’ আমাতনি ওয়া ইলাইহিন নুশুর’ ‘সমস্ত প্রশংসা সেই সত্তার জন্য, যিনি আমাকে মরণ দেয়ার পর পুনরায় জীবন দান করেছেন। আর তার কাছেই সবাইকে উপস্থিত হতে হবে।’ দুটি দোয়ার দর্শন ও তাৎপর্য সত্যিই অসাধারণ।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ

তৃতীয় খণ্ড, বয়েত : ১৭৬৩-১৭৭১)

[ইউটিউবে মসনবি পাঠের আসরে আপনাকে স্বাগতম। নিয়মিত আলোচনা শোনার জন্য ভিজিট করুন : CHAYAPATH PROKASHONI]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত