বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের সারসংক্ষেপ

ড. খোন্দকার আলমগীর

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদিকাল থেকেই এখানে মুসলিম স্থাপত্যের সূচনা হয়। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি প্রথম থেকেই তাঁর অধিকৃত সমগ্র এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সুলতানরাও তাঁর অনুসরণে অসংখ্য ইমারত নির্মাণ করেন। বাংলায় সুলতানি স্থাপত্যের কয়েকটি প্রধান কেন্দ্র পাওয়া যায়, যেমন- ছোট পা-ুয়া, ত্রিবেণী (হুগলি), গৌড়, হজরত পা-ুয়া (মালদা), সোনারগাঁও, বারবাজার ও বাগেরহাট।

মুসলমানরা যখন বাংলা জয় করে তখন বিশ্বের অন্যত্র মুসলিম স্থাপত্যের খুব বেশি উন্নতি হয়েছিল এবং মুসলিম স্থাপত্যের চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল। আহমদ হাসান দানি বলেন,

‘The Muslims had come to Bengal with their developed civilization of Islam as their heritage, and they meant to settle down in the country in order to establish a new home for themselves. The carriers of this civilization, who were mostly Turks, had themselves been uprooted from their homeland in Central Asia, and they came here as squatters to make a bid for a new career in their life’.

এ দেশে আগমনের সময় মুসলমানরা তাঁদের সঙ্গে বহু স্থপতি, শিল্পী ও কারিগর এনেছিল। স্থাপত্যের ইতিহাসের দেশীয় এতিহ্যও ছিল। অর্থাৎ এ সময়টি ছিল দেশীয় ও বহির্দেশীয় শিল্প বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণের যুগ। দেশীয় বেশিষ্ট্য হলো : স্থাপত্যের ট্রাবিয়েট (trabeate) রীতি, বক্র ছাদ কিনারা (curved cornices of buildings) গাঁথুনির মসলা হিসেবে কাদা-মাটির (mud mortar) ব্যবহার, পোড়ামাটির অলঙ্করণ, পুরাকীর্তির সঙ্গে দিঘি, কুড়েঘর আকৃতির আচ্ছাদন (hut shaped roofs) ইত্যাদি। বহির্দেশীয় উপকরণ হলো : স্থাপত্যের খিলান রীতি (arcuate system of construction), রঙিন টালির ব্যবহার (glazed tiles), ইমারতের গাত্রে শিলালিপির ব্যবহার, ইমারতের গাত্রে জ্যামিতিক ও পুষ্প অলঙ্করণ। বাংলায় মসজিদ ও সমাধি নির্মাণও বহির্দেশীয় উপকরণ। বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের বিভিন্ন কেন্দ্র নিম্নে আলোচনা করা যায় :

ত্রিবেণী, হুগলি ও সাতগাঁওয়ের পুরাকীর্তিগুলো এ দেশে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন (ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধ্ব)। বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসে হুগলি জেলার ছোট পা-ুয়ার ত্রিবেণীতে অবস্থিত জাফর খান গাজীর মসজিদ (৬৯৬/১২৯৬-৯৭) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাফর খানের মসজিদ বাংলায় বিদ্যমান মুসলিম পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। ত্রিবেণীর এই বন্দর-নগরীতে মুসলিম স্থাপত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন নিদর্শন বিদ্যমান। জাফর খান গাজীর মসজিদের বৃহদাকার স্তম্ভগুলো দেশীয় উপকরণের নিদর্শন। এই ধরনের স্তম্ভ পশ্চিম বাংলার মালদা জেলার হজরত পা-ুয়ার আদিনা মসজিদ (৭৭৬/১৩৭৪-৭৫), বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গৌড়ের দারাসবাড়ি মসজিদ (৮৮৪/১৪৭৯-৮০), পশ্চিম বাংলার গৌড়ের গুনমন্ত মসজিদ (৮৮৯/১৪৮৪-৮৫) এবং পশ্চিম বাংলার গৌড়ের কদম রসুল ইমারতে (৯৩৭/১৫৩১) দেখা যায়। এ ধরনের স্তম্ভ শুধু বাংলায় দেখা যায়। উপমহাদেশের অন্য কোথাও এ ধরনের বৃহদাকার স্তম্ভ দেখা যায় না। জাফর খান গাজীর সমাধিও পূর্ববর্তী হিন্দু ইমারত থেকে আহরিত মাল-মসলা দ্বারা নির্মিত। জাফর খানের মসজিদ প্রথমে পাঠদান কার্যে ব্যবহৃত হয় এবং পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসার জন্য একটি পৃথক ইমারত নির্মাণ করা হয়। কিন্তু জাফর খানের মৃত্যুর পর তাঁকে মাদ্রাসা ভবনে সমাধিস্থ করা হয়।

সুলতানি আমলে গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী তাদের শাসন-কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। পূর্ববর্তী বৌদ্ধ ও হিন্দু আমলেও এ শহরটি তাঁদের শাসন-কেন্দ্র ছিল। এটি রাজা লক্ষ্মণ সেনেরও রাজধানী ছিল। লক্ষ্মণ সেন ১২০৪-৫ খ্রিষ্টাব্দে মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির কাছে পরাজিত হন। প্রথম থেকেই মুসলমানরা অনুধাবন করেন যে, শুধু অস্ত্রের জোরে বাংলায় তাদের শাসন সুসংহত করা সম্ভব নয়। তাই শান্তিপূর্ণ সময়ে একটি মুসলমান সমাজ গড়ে তোলার জন্য তারা মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। মোগলদের সময়ে এই শহরটি পরিত্যক্ত হয়। মহামারির কারণে ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এটি পরিত্যক্ত হয় এবং তার ফলে এটি জঙ্গলাবৃত হয়ে যায়। রাজকীয় মূল দুর্গ এলাকাটি ১৯৪৭ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং শহরতলি এলাকাটি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান) অন্তর্ভুক্ত হয়। এই এলাকাটি ফিরোজপুর নামেও পরিচিত। রজনীকান্ত চক্রবর্তী বলেন যে, কেতোয়ালি দরওয়াজা থেকে পুখুরিয়া পর্যন্ত এলাকাটি ফিরোজপুর নামে পরিচিত। দ্বিতীয় ফিরোজ শাহের নাম অনুসারে এটির নামকরণ করা হয় এবং এ শহরতলি এলাকাটি জনবহুল ছিল। এ এলাকায় অনেক রাস্তার চিহ্ন রয়েছে। গৌড় শহরে এ দেশের প্রাথমিক মুসলমান যুগের সবচেয়ে বেশি পুরাকীর্তি পাওয়া যায়। এ শহরটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় : দুর্গ এলাকা, প্রাকার বেষ্টিত শহর ও শহরতলি বা উপশহর। শহরের দক্ষিণ দিকের কোতোয়ালি দরওয়াজা দিয়ে এ শহরে প্রবেশ করা যায়। কোতোয়ালি দরওয়াজার দুই দিকে উচ্চ প্রাকার সংযুক্ত আছে। বড় সোনামসজিদ (১৫২৬) ও ছোট সোনামসজিদ (আনু. ১৫১০) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইমারত। ছোট সোনামসজিদটি অদ্যাবধি মোটামুটি ভালো অবস্থায় বিদ্যমান। অন্য মসজিদগুলো হলো : চামকাটি মসজিদ (১৪৭৮), দারাসবাড়ি মসজিদ (১৪৭৯), খানিয়াদিঘি মসজিদ (১৪৮০), ধানিচক মসজিদ (১৪৮০), লোটন মসজিদ (১৪৯৩-১৯) ইত্যাদি। সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৬-১৪৫৯) পাঁচ খিলানের সেতু, চাঁদ ও দাখিল দরওয়াজা, বাইশগজি দেওয়াল এবং গৌড়ের দুর্গ নির্মাণ করেন। সুলতান বরবক শাহ ১৪৬৬ খ্রিষ্টাব্দে নিম দরওয়াজা নির্মাণ করেন। সুলতান সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-৯০) গৌড়ের ফিরোজা মিনার নির্মাণ করেন।

পশ্চিম বাংলার মালদা জেলার হজরত পা-ুয়াতেও বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের চমৎকার কিছু নিদর্শন রয়েছে। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের (১৪৪২-৫৮) পুত্র সুলতান সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-৮৯) ঐতিহাসিক আদিনা মসজিদ (১৩৭৪-৭৫) নির্মাণ করেন। উপমহাদেশে এ যাবৎকালে নির্মিত মসজিদগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। সাহন ও রিউয়াকযুক্ত (courtyard type mosque) এ মসজিদটি দামেশক মসজিদ (অষ্টম শতাব্দী) ও ইবনে তুলুনের (নবম শতাব্দী) মসজিদের নকশা অনুসরণে নির্মিত। এ ধরনের মসজিদ পরবর্তী সময়ে বাংলায় আর নির্মিত হয়নি। বাংলায় নির্মিত পরবর্তী মসজিদগুলো আচ্ছাদনযুক্ত (covered type)। হজরত পা-ুয়ার একলাখি সমাধি (১৪১৫-৩৩) বাংলায় নির্মিত প্রাথমিক সমাধি স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এটি এ দেশের পরবর্তী স্থাপত্যকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। রাজা গণেশের পুত্র জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৫-৩৩) হজরত পা-ুয়া থেকে রাজধানী গৌড়ে স্থানান্তর করেন।

স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও ছিল সুলতানি স্থাপত্যের আরেকটি কেন্দ্র। এখানে বহু মসজিদ, সমাধি ও সেতু নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে এগুলোর মাত্র কয়েকটি অবশিষ্ট আছে। যেমন : হাজী বাবা সালেহ নির্মিত বন্দরের মসজিদ (১৪৮১-৮২), মোল্লা হিজবর আকবর খান নির্মিত গোয়ালদি মসজিদ (১৫১৯), ফিরোজ খান নির্মিত মহজমপুর মসজিদ (১৪৩২-৩৬)। সোনারগাঁওয়ে হজরত শরফউদ্দীন আবু তাওওয়ামা (১৩শ শতাব্দী) প্রতিষ্ঠিত একটি বৃহৎ মাদ্রাসা ছিল। তার সময়ে সোনারগাঁও একটি বৃহৎ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। সোনারগাঁওয়ের সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ (১৩৯৩-১৪১০) শিরাজের কবি হাফিজকে বাংলায় আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু হাফিজ বাংলায় আসতে পারেননি। পা-ুয়ার সুলতান সিকান্দার শাহের (১৩৫৮-৯৩) রাজত্বকালে সোনারগাঁও থেকে বিদ্রোহী পুত্র গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ একটি অসমাপ্ত কবিতার একটি চরণ এটি সম্পূর্ণ করার জন্য হাফিজের (মৃত্যু ১৩৮৮) কাছে শিরাজে প্রেরণ করেন। সাধারণভাবে বলা হয় যে, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ সোনারগাঁওয়ের মোগরাপাড়ায় সমাধিস্থ আছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি তাঁর পিতা সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধি বলে বর্তমান লেখক মনে করেন। (পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য)