ঢাকা ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোরআন মজিদের সঙ্গে পরিচয়

মো. শাহীদুল্লাহ যুবাইর
কোরআন মজিদের সঙ্গে পরিচয়

পরিচয় থেকেই সম্পর্ক হয়। সম্পর্ক থেকে বন্ধুত্ব হয়। আবার সম্পর্ক ও পরিচয় উভয়ই নির্ভর করে একটি বিষয়ের ওপর। তা হলো কথা বলা। আর লোকটি যদি বিদেশি হয়, তার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সহজ পথ হবে, তার ভাষায় কথা বলা। আমি যদি তার সামনে লোকটির সামনে কোনো বক্তব্য বা লেখা হুবহু উচ্চারণ করে শোনাতে পারি, নিশ্চিতই তার মনের মাঝে স্থান করে নিতে পারব। এটি দুনিয়ার রীতি। দুনিয়ার বাইরের যে জগৎ, যেখানে থেকে আমরা এসেছি এবং মৃত্যুর পারাপার, পার হয়ে যেখানে যাব সেখানকার রীতিও এর ব্যতিক্রম নয়।

যিনি আমাদের জীবন ও জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রণকারী তার সঙ্গে সম্পর্ক করার সবচেয়ে সহজ পথও হচ্ছে, তার সঙ্গে কথা বলা। আমরা যে ইবাদত-বন্দেগি করি তার মর্মার্থও তাই। ‘নামাজ মানে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা’। এ জন্য নামাজরত কারও সামনে দিয়ে হাঁটাচলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কারণ, সে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলছে। রোজার সময় ধ্যানে-জ্ঞানে-মনে, রাতে ও দিনে কথা বলা হয় আল্লাহর সনে। নামাজে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার ভাষা আল্লাহর কালাম কোরআন মজিদ। হাদিস শরিফে বর্ণিত ‘কোরআন হচ্ছে এমন রশি যার এক প্রান্তে আছেন আল্লাহতায়ালা আরেক প্রান্তে বান্দা।’

কোরআন মজিদ নাজিল হয়েছে মক্কা ও মদিনার জমিনে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। নাজিল মানে অবতরণ ঊর্ধ্বে কোথাও থেকে নিচে নেমে আসা। সৃষ্টির সেরা আল্লাহর পেয়ারা হাবিব হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে এ কোরআন নিয়ে আসেন আল্লাহর সম্মানিত ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)। কাজেই সাধারণ অর্থে আমরা কিতাব, বই বা গ্রন্থ বলতে যেমন বুঝি, কোরআন তেমন কোনো গ্রন্থ নয়। এটি সুরক্ষিত আছে ঊর্ধ্ব জগতের ‘লওহে মাহফুজ’-এ। কতদিন থেকে আছে তার উল্লেখ আছে হাদিস শরিফে। বর্ণিত আছে, জগৎ সৃষ্টির ১ হাজার বছর আগে আল্লাহতায়ালা কোরআনের তোয়াহা ও ইয়াসিন সুরা পাঠ করেন। আল্লাহ পাক যখন থেকে আছেন, এই কোরআনও তখন থেকেই আছে। কারণ এটি আল্লাহর কালাম অর্থাৎ কথা। অন্যান্য সৃষ্টির মতো কোনো নবসৃষ্ট বিষয় নয়। এ কারণে যতদিন এই সৃষ্টিলোক আছে ততদিন এই কিতাব অবিকল অবিকৃত ও সুরক্ষিত থাকবে।

কোরআন মজিদের মূলকপি ‘লওহে মাহফুজ’-এ সুরক্ষিত আছে। দুনিয়াতেও অবিকল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন মহান রাব্বুল আলামিন। জাহেলি যুগে আরবরা কাব্য-সাহিত্যে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল, যা এখনকার বিশ্বসাহিত্যের জন্যও বিস্ময়। সেই সমাজে কোরআন নাজিল হলে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হয় ‘কোরআন মানুষের বানানো-সাজানো সাহিত্য বলে তোমরা যে দাবি করছ, তাতে তোমরা সত্যবাদী হলে এসো এই কোরআনের ছোট্ট একটি সুরার মতো কোনো বাক্যমালা সবাই মিলে রচনা কর। এই চ্যালেঞ্জ এখনও বলবৎ আছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, আরবের কবি-সাহিত্যিকরা সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তখন করতে পারেনি, পরেও কখনও পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। কারণ, তা আল্লাহরই কালাম।’

লওহে মাহফুজে কোরআন হেফাজতের সংরক্ষিত ব্যবস্থাপনার মতো এ জগতেও কোরআন কালচক্রের যে কোনো দুর্বিপাক থেকে সুরক্ষিত। কোরআন মজিদের হাফেজরা পরম মমতায় তাদের বুকে আল্লাহর কালামকে হেফাজত করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। সেই হেফজ সঠিক আছে কি-না তার হাজিরা হয়, পরীক্ষা ও অনুশীলন হয় রমজানে তারাবিহ নামাজে। ফলে কোরআনের একটি বাক্য, শব্দ বা অক্ষরেরও হেরফের হয়নি ১৪০০ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমায়। পৃথিবীর বুকে কোনো জালিম শাসক যদি কোরআনের সব কপি ধ্বংস করে কোরআন নিশ্চিহ্ন করতে চায়, পারবে না। কারণ, কোরআন যে হাফেজদের হৃদয়ের গোপান মণিকোঠায় সুরক্ষিত।

কোরআনই পৃথিবীতে একমাত্র গ্রন্থ, যা মানুষ সম্পূর্ণ কণ্ঠস্থ করে এবং হুবহু মুখস্থ রাখতে পারে। অন্য কোনো গ্রন্থের এভাবে মুখস্থ করার নজির পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয়টি নেই। কোরআন ছাড়া অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের হাফেজও তাই নেই। এর কারণ, কোরআন ছাড়া অন্য কোনো আসমানি গ্রন্থ অবিকৃত নেই। হিন্দু-বৌদ্ধ-সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গ্রন্থ তো ইশ্বরের বাণী বলে তারা নিজেরাও দাবি করে না। মুসলিম উম্মাহর জন্য এই কোরআন নিশ্চয়ই আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান।

আগুন আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি শব্দ। তবে আগুন বলতে যা বোঝায় তার হাকিকত এই শব্দের মধ্যে নিহিত নেই। তাই কাগজের বুকে আগুন শব্দ লিখলে আগুন ধরে যায় না। উচ্চারণ করলে আমাদের মুখে ফোসকা পড়ে না; কিন্তু কোরআন মজিদের ভাষা ও বর্ণে তার হাকিকত নিহিত। তার প্রতিটি আয়াতের ভাবার্থ ধারণ করার যে ভাষা তাও আল্লাহর। এ কারণে যখন নবীজির ওপর কোরআন নাজিল হত, তখন প্রচণ্ড শীতের দিনেও তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে যেতেন। বিন্দু বিন্দু স্বেদ তার পবিত্র চেহারা থেকে টপকে পড়ত। প্রিয়নবী একবার তার এক প্রিয় সাহাবির কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলেন। তখনই ওহি নাজিল আরম্ভ হয়। সাহাবি বলেন, ওহির ভারে মনে হলো আমার ঝানু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। প্রধান ওহি লেখক সাহাবি হজরত যায়দ ইবনে সাবেত (রা.) বলেন, ওহি লিপিবদ্ধ করার পর আমার নিজেরও মনে হতো ওহির ভারে আমার চলতশক্তি রহিত হয়ে গেছে।

এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই কেউ অর্থ না বুঝেও ভক্তিভরে কোরআন পাঠ করলে প্রতিটি অক্ষরে ১০টি করে সওয়াব আল্লাহপাক দান করবেন। আর যারা বুঝে পড়বে ও তার ওপর আমল করবে তাদের সওয়াব ও মর্যাদা তো অকল্পনীয়। কোরআন এসেছে মানব জাতির হেদায়তের জন্য। এ হেদায়ত লাভ করতে হলে একে বুঝতে হবে। বোঝার জন্য ভাসা ভাসা অধ্যয়ন যথেষ্ট নয়। আমরা যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক চোখ বুলিয়ে পড়ে যাই, কোরআন সেভাবে চোখ বুলানোর গ্রন্থ নয়; বরং অনুচ্চ স্বরে মনের মাধুরী মিশিয়ে পড়তে হবে, যাকে বলে তেলাওয়াত। তারপর আল্লাহপাক বান্দাকে কি বলেছেন, কি পয়গাম দিয়েছেন তা অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই হাকিকতে কোরআনের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে। বর্তমানে কোরআন মজিদের তরজমা ও তাফসিরের বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে অডিও-ভিডিও ও প্রিন্টের আকারে। এগুলোর সহায়তা নেয়া ও উপকৃত হওয়ার জন্য মনের প্রস্তুতি চাই। পবিত্র মাহে রমজান আমাদের সামনে কোরআন মজিদ নিয়ে চর্চা ও গবেষণার সুবর্ণ সুযোগ। এমনকি বলা যায়, কোরআন মজিদের চর্চার জন্যই রমজানুল মোবারকের বিশাল আধ্যাত্মিক আয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত