তারাবি নামাজের হাফেজ নিয়োগ ও তাদের সম্মানি প্রসঙ্গ

মুফতি মো. আবদুল্লাহ্

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শরিয়া আইনে জায়েজ না জায়েজ নির্ধারণের জন্য একটি মৌলিক বিষয় মনে রাখতে হবে যে, শরিয়া আইন ও আইনবিষয়ক গ্রন্থাদিতে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয় :

(১) ‘কাযাআন’ বা ‘আইনগত’ বিবেচনা; (২) ‘দিয়ানাতান’ বা ‘নৈতিক বিবেচনা’। দ্বিতীয়টি আইনত জরুরি নয় বটে; কিন্তু মানবিক বিবেচনায় কাম্য। যে কারণে আইনসংশ্লিষ্ট কিতাবসমূহে বলা হয় - ‘আইন প্রয়োগযোগ্য বা প্রয়োগকেন্দ্রিক এবং নৈতিকতা বিবেককেন্দ্রিক।’

এ বিষয়টি অনেকের কাছে অস্পষ্ট থাকা বা না বোঝার কারণে, কোনো কোনো মুফতি/ইমাম/আলেম তারাবি নামাজের হাদিয়া/সম্মানী/পারিশ্রমিক প্রশ্নে বিতর্ক ও বাড়াবাড়ির জন্ম দেন।

শরিয়া আইনের আইনি বিবেচনা হচ্ছে, মজুরি-পারিশ্রমিক জ্ঞান করে তারাবির ইমামকে কোনো অর্থ না দেয়া বা দেয়া যাবে না। তার অর্থ এটা নয় যে, তাদের তারাবি নামাজ পড়ানোর বিনিময়ে কিছু দেয়া একেবারেই না-জায়েজ বা সম্মানী হিসেবেও তেমন কিছু দেয়া যাবে না। এ ধরনের কথা শরিয়তে বলা হয়নি।

শুধু তারাবি নামাজে কোরআন শুনিয়ে বা খতম করে তার বিনিময়ে পারিশ্রমিকজ্ঞান করে টাকাণ্ডপয়সা প্রদান বা গ্রহণ কোনোটি শরিয়া আইনে জায়েজ রাখা হয়নি। তবে পারিশ্রমিকজ্ঞান না করে সন্তুষ্টচিত্তে হাদিয়া বা সম্মানী মনে করে কম-বেশি যা-ই প্রদান করা হয়; তা প্রদান ও গ্রহণ উভয়টি জায়েজ, সমীচীন, নৈতিক দায়িত্ব, এমনকি উত্তমও বটে।

‘বিনিময়’ বা ‘পারিশ্রমিক’ শব্দ যেক্ষেত্রে বলা হবে সেক্ষেত্রে তা অবশ্যই পূর্ব নির্ধারিত হওয়া জরুরি। কিন্তু হাদিয়া বা সম্মানী শব্দ ব্যবহার করা হলে সেক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত হওয়াও জরুরি নয় এবং তা কমবেশি যে-কোনো অঙ্কই হতে পারে। সুতরাং তারাবি নামাজের ক্ষেত্রে ‘নিয়োগ’ বিষয়টি বলতে পারলেও ‘নির্ধারণ’ পর্যায়ে যাওয়া যাচ্ছে না।

এসব কারণে, বিংশ শতাব্দী ও একবিংশ শতাব্দীর গবেষক পর্যায়ের শরিয়া আইন বিশেষজ্ঞ মুফতিরা একটি সহজ সুরাহার পন্থা নিরূপণ করেছেন এভাবে যে-

“সংশ্লিষ্ট হাফেজ সাহেবকে এশার নামায বা অনুরূপ ১/২ ওয়াক্তের নামাজের ইমামতির দায়িত্ব ন্যস্ত করে বা ‘সানী ইমাম’ বা সহকারী ইমাম হিসেবে মাহে রমজানের জন্য নিয়োগদান করা যেতে পারে। যেন ‘পারিশ্রমিক’ নির্ধারণ বিষয়টি আইনত বৈধ হয়ে যায়।”

এতে আরও সুবিধা হচ্ছে, পারিশ্রমিক বাবদ উল্লেখযোগ্য একটি অঙ্ক ধার্য করা যায় এবং তা মুসুল্লিদের থেকে আদায় না হলে বা আদায় না করে, পুরো বা আংশিক মসজিদ তহবিল থেকেও প্রদান করা যায়।

সুতরাং তারাবির উদ্দেশ্যে দু’ভাবেই হাফেজ নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যথা :

(ক) সংশ্লিষ্ট হাফেযকে বলে দেয়া যে, ‘আপনি সম্পূর্ণ সওয়াবের নিয়তে আমাদের এখানে/মসজিদে তারাবি পড়াতে সম্মত আছেন তো? আমরা আপনাকে কোনো বেতন/পারিশ্রমিক দেব না। আপনার থাকাণ্ডখাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করব এবং মুসল্লিরা খুশিমনে হাদিয়া-সম্মানী প্রদান করলে, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।’

(খ) ‘আমরা আপনাকে মাহে রমজানের ২৭/৩০ দিনের জন্য সহকারী ইমাম হিসাবে এত টাকা বেতন বা সম্মানীতে নিয়োগ দিলাম। আপনি অমুক ওয়াক্ত নামাজ বা ইমামের অবর্তমানে ইমামতির দায়িত্ব পালন করবেন এবং তার সঙ্গে আল্লাহর ওয়াস্তে তারাবি নামাজও পড়িয়ে দেবেন।’

মোটকথা, বিস্তারিত নির্দেশনার আলোকে এবং ৬নং ক্রমিকে উল্লেখকৃত যে-কোনো এক পদ্ধতিতে হাফেজ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

সূত্র : আদদুরুল মুখতার + শামী, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা ঃ ৭৬, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি, ভারত;২। আল-বাহরুর রায়িক, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫০৬, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি, ভারত; ৩। বাদায়েউছ ছানায়ে, খণ্ড-৪, পৃ-৪৩-৪৫, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি, ভারত; ৪। ইমদাদুল ফাতাওয়া : খণ্ড১, পৃ-৪৭১-৪৮৫; মাকতাবা দারুল উলুম, করাচি; ৫। ইমদাদুল আহকাম : খণ্ড২, পৃ-২৬৯, ২৭৮; যাকারিয়া বুক ডিপো ভারত; ৬। আহসানুল ফাতাওয়া : খণ্ড৭, পৃ-২৭৮, ২৮২ যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি, ভারত; ৭। ইমদাদুল মুফতিঈন, পৃষ্ঠা ঃ ৩৬৫, দারুল ইশাআত, করাচি; ৮। আযীযুল ফাতাওয়া : পৃ-৬৬৩ ; দারুল ইশাআত, করাচি; ৯। ফাতাওয়া ও মাসাইল : খণ্ড৩, পৃ-৪১৯; সম্পাদনা পরিষদ, ইফা, ঢাকা। ১০। ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়্যা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ঃ ৩৪৯, ইদারা দাওয়াতে ইসলাম, করাচি; ১১। ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়্যা, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা ঃ ৩৮৭-৩৮৮ ও ৩৯১, ইদারা দাওয়াতে ইসলাম, করাচি; ১২। ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-১৭০, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ. পি, ভারত)।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক

ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ