মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৩৫৮)

ওলি আল্লাহ যারা শুভস্বপ্ন দেখেন

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ওলি আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে গত শনিবারের লেখায় আলোকপাত করেছি। আলোচনা ছিল সুরা ইউনুসের ৬৪ নম্বর আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে, তাফসিরে মাইবেদী অবলম্বনে। একই সূত্র থেকে বিষয়টি নিয়ে আমরা আরও আলোচনা করতে চাই। আলী (রহ.) বলেন, আল্লাহর ওলি এমন সম্প্রদায়, রাত জাগার কারণে যাদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। অশ্রু নির্গত হওয়ার কারণে যাদের চোখ শুকিয়ে যায়। ক্ষুধার্ত থাকার ফলে যাদের পেট শূন্য থাকে আর দুর্বলতাবশত যাদের ওষ্ঠ শুকনো থাকে।

তাসাউফ সাধনার যত সিলসিলা জগতে প্রচলিত, প্রত্যেকে একবাক্যে স্বীকার করেন যে, ইলমে মারেফাত নবী করিম (সা.) থেকে আলীর (রা.) সূত্রে সারা দুনিয়ার পীর-আউলিয়াদের মাঝে বিস্তৃত হয়েছে। কাজেই আলী (রা.)-এর উল্লেখিত বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে আমরা নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারি। ওলি বুজুর্গ বলতে কোরআন হাদিসে কোনো বিশেষ শ্রেণিকে বুঝানো হয়নি; সব ঈমানদারই আল্লাহর ওলি বা বন্ধু হতে পারে, তবে শর্ত হলো তাদের জীবন হতে হবে তাকওয়ার ওপর ভিত্তিশীল। যারা আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো কাজ করেন না।

ওলি আল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।’ (সুরা ইউনুস : ৬৩)। আল্লামা মাইবেদী বলেন, এই আয়াতকে আগের আয়াতের জের গণ্য করা যায়। তখন অর্থ হবে আল্লাহর ওলি ও বন্ধুজন তারা, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে। এই অর্থ গ্রহণ করলে ইয়াত্তাকুন এর ওপর ওয়াকফ করতে হবে। তখন বক্তব্য এখানেই শেষ বলে ধরে নিতে হবে। আর যদি চান, আগের আয়াতের লা ইয়াহযানুন (চিন্তিত হবে না) এর ওপর কথা শেষ করতে পারেন। তখন ‘যারা ঈমান এনেছে’ বলে নতুন বক্তব্য শুরু হবে। এমনটি হলে নতুন বাক্যের খবর বা বিধেয় ধরতে হবে ‘তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ’ বাক্যটি।

আল্লাহর এসব প্রিয়বান্দার জন্য সুসংবাদ রয়েছে। কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে, ‘তাদের (মোমিনদের) জন্য সুুসংবাদ রয়েছে ইহজগতে ও পরজগতে।’ (সুরা ইউনুস : ৬৪)। ইহজগতে সুসংবাদ অর্থ হলো, শুভস্বপ্ন। যে শুভস্বপ্ন তারা নিজেরা দেখে বা তাদের দেখানো হয়। আর পরজগতে সুসংবাদ মানে বেহেশত।

আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে আল্লাহতায়ালার বাণী ‘তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে’ সম্বন্ধে জানতে চাইলাম।

তিনি আরও বললেন, আখেরাতের সুসংবাদ কী হতে পারে তা আমরা মোটামুটি বুঝি। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে যে সুসংবাদের কথা বলা হয়েছে তার স্বরূপ কী? নবীজি বললেন, তা হলো, শুভস্বপ্ন, যা মানুষ দেখে বা তাকে দেখানো হয়। আর আখেরাতের বেলায় তা হলো জান্নাত। উবাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এর অর্থ সেই শুভস্বপ্ন, যা মোমিন নিজের জন্য দেখে অথবা তাকে দেখানো হয়। এই স্বপ্ন হলো, আল্লাহর কালাম, যার সাহায্যে নিদ্রায় তার প্রভু তার সঙ্গে কথা বলেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, আমার পরে নবুয়তের কোনো ধারাবাহিকতা অবশিষ্ট থাকবে না; তবে মুবাশশিরাত (সুসংবাদগুলো) অব্যাহত থাকবে। সাহাবায়ে-কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মুবাশশিরাত কী? তিনি বললেন, শুভস্বপ্ন, যা মানুষ দেখে বা তাকে দেখানো হয়।

আবু কাতাদা আনসারী হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, শুভস্বপ্ন হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। অতএব, কেউ যদি এমন স্বপ্ন দেখে যা তার অপছন্দ, সে যেন বাম দিকে তিনবার হালকা থুথু ছিটায়। আর আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে পানাহ চায়। তাহলে সে স্বপ্ন তার জন্য কোনো ক্ষতি বয়ে আনবে না। সেই স্বপ্নের কথা কারও কাছে বলবে না। আর যদি ভালো কোনো স্বপ্ন দেখে, তাহলে এমন লোকের কাছে স্বপ্নের কথাটি বলবে, যাকে সে ভালোবাসে।

নবী করিম (সা.) বলেন, স্বপ্ন তিনি প্রকার। এক প্রকার স্বপ্ন, আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে, যা শুভস্বপ্ন, এটি আল্লাহর পক্ষ হতে বুশরা বা সুসংবাদ। আরেক প্রকার স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ হতে হয়। আরেক প্রকার স্বপ্ন মনের কল্পনাপ্রসূত। নবীজি বলেন, তোমাদের মধ্যে যে স্বপ্ন বর্ণনায় অধিক সত্যবাদী সে কথাবার্তায়ও অধিক সত্যবাদী। আর মোমিনের স্বপ্ন নবুয়াতের ৬৬ ভাগের ১ ভাগ। এই হাদিসের দুটি অর্থ বলা হয়েছে। একটি হলো, নবীজির ৬৬টি মোজেজা ছিল। নবীজির স্বপ্ন ছিল এগুলোর মধ্যে অন্যতম। কারণ তিনি যা কিছু স্বপ্নে দেখতেন জাগ্রত হয়ে তা বাস্তবে যথাযথ পেয়ে যেতেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসুলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন। (সুরা ফাতহ : ২৭)।

আরেকটি অর্থ হচ্ছে, নবীজির বয়স যখন ৪০ বছর তখন তার কাছে ওহির অবতরণ শুরু হয়। তবে ওহি নিয়ে জিবরাইল (আ.) আসার আগে ৬ মাস তিনি স্বপ্নযোগে ওহি লাভ করেন। নবুয়ত ও ওহি নাজিলের সময়কাল ছিল ২৩ বছর। যদি ৪০ বছরের আগের ৬ মাসকে ২৩ বছরের সঙ্গে আনুপাতিক হিসাব করা হয়, তাহলে অনুপাত হয় আধা বছর। অর্থাৎ ২৩ বছর সমান ৬৬টি আধা বছর। এই হিসেবে নবী করিম (সা.) এর স্বপ্নযোগে ওহি লাভের ব্যাপারটি ৬৬ ভাগের ১ ভাগ গণ্য করা যায়। শুভস্বপ্নকে নবুয়তের ৬৬ ভাগের ১ ভাগ বলে উল্লেখ করার তাৎপর্য এটিই। (এ কথার অর্থ হল, নবী করিম (সা.) এর ওফাতের পর নবুয়াতের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যদি কেউ গায়েবিভাবে কিছু জানতে চায়, তার জন্য পথ খোলা রয়েছে শুভস্বপ্ন। হাদিস শরিফে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ফজর নামাজের পর সাহাবিদের ডেকে ডেকে গেল রাতে কে কি স্বপ্ন দেখেছেন, জানতে চাইতেন। বুঝা যায়, শুভস্বপ্ন মনের স্বচ্ছতা ও চিন্তার বিশুদ্ধতার প্রমাণ। যে ব্যক্তি জাগ্রত অবস্থায় মন ও চিন্তাকে কলুষমুক্ত রাখে আশা করা যায়, রাতের নিদ্রায় তার ভালোস্বপ্ন নসিব হবে।

আয়াতের আরেকটি তাফসির হলো, দুনিয়ার জীবনে তাদের জন্য বুশরা বা সুসংবাদ মানে মৃত্যুর সময় তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে রহমত ও সুসংবাদ নিয়ে ফেরেশতারা আসবেন। আর আল্লাহর দুশমনদের কাছে আসবেন দুঃসংবাদ ও রুক্ষতা নিয়ে। আর আখেরাতের বেলায় সুসংবাদ হল, মোমিনের জান বের হবার পর ফেরেশতারা তা নিয়ে আল্লাহর কাছে চলে যাবে, নববধূকে সাজিয়ে পাল্কিতে করে নিয়ে যাওয়ার মতো। তখন তাদের আল্লাহর সন্তুষ্টির সুসংবাদ দেয়া হবে। আল্লাহতায়ালা এ মর্মে বলেন, ‘ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় (শিরক থেকে মুক্ত ও) পবিত্র থাকা অবস্থায়, তাদের ফেরেশতারা বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তি)! তোমরা যা করতে তার প্রতিফল হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ কর।” (সুরা নাহল, আয়াত-৩২)।

ইবনে কায়সান বলেন, এটি আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে তাদের দুনিয়াতে কিতাব ও রাসুল মারফত দেয়া এই সুসংবাদ যে, তারা আল্লাহর বন্ধু। আর তাদের কবরে ও তাদের আমলনামায়ও এই সুসংবাদ দেয়া হয় যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল জুযেকী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু আহমদ আল হাফেযকে স্বপ্নেœ দেখলাম যে, তিনি একটি বাহনে আরোহন করে আছেন। তার গায়ে একটি শাল আর মাথায় পাগড়ি। তখন আমি তাকে সালাম করে বললাম! হে শাসক! আমরা এখনও আপনার কথা স্মরণ করি এবং আপনার গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করি। তখন তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং আমাকে বললেন, আমরা আপনাকে স্মরণ করি এবং আপনার গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবনে সুংসংবাদ। সুন্দর প্রশংসা, সুন্দর প্রশংসা। আর তিনি তার হাতের দিকে ইঙ্গিত করলেন। সহীহ হাদীসে বর্র্ণিত. আবু যার (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। কোনো ব্যক্তি তার নিজের জন্য আমল করে; অথচ মানুষ তাকে ভালোবাসে (কেমন ব্যাপার)! নবীজি বলেন, এটি হচ্ছ মোমিনদের জন্য আল্লাহর দেয়া

সুসংবাদের নগদ প্রাপ্তি।

(তাফসিরে মাইবেদী, সুরা ইউনুসের ৬২তম আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গ)