ঢাকা ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যখন যেভাবে নাজিল হয় কোরআন

মো. শহীদুল্লাহ যুবাইর
যখন যেভাবে নাজিল হয় কোরআন

জাহেলি যুগে অজ্ঞানতার নিকষ অন্ধকারে আলোর বিস্ফোরণ হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর বয়স তখন ৪০ বছর। তার কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে ওহি নিয়ে আসেন সম্মানিত ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)। সেই ওহি ছিল মানবজাতির মুক্তির মহাসনদ কোরআন মাজিদের সূচনা বাণী ইকরা। মক্কার উপকণ্ঠে হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় তিনি ধ্যানমগ্ন ছিলেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির অনন্ত রহস্য নিয়ে। রমজান মাসের শেষ দশকে সোমবার রাতের শেষ প্রহর। সে রাত ছিল মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর। জগৎ সৃষ্টির শুরু থেকে যে সম্মানিত ফেরেশতা দুনিয়াতে আল্লাহর রহমতের সওগাত বয়ে আনেন, নবী-রাসুলদের কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে আসেন, তিনি আভির্ভূত হন মানবজাতির হেদায়াতের আলোকবর্তিকা কোরআন মাজিদের বাণী নিয়ে। ওহি নাজিলের এ অবিস্মরণীয় ঘটনার বিবরণ রয়েছে হাদিস ও সিরাতের গ্রন্থগুলোতে।

পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের অঙ্গীকার

মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স যখন ৪০ বছর হলো, আল্লাহ তাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণা স্বরূপ পাঠালেন এবং গোটা মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে প্রেরণ করলেন। এর আগে পৃথিবীতে যত নবী রাসুল (আ.) এসেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছে থেকে আল্লাহতায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিলেন যে, তারা শেষ নবীর ওপর ঈমান আনবেন, তাকে সমর্থন করবেন এবং তার বিরোধীদের মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করবেন, তদুপরি তাদের ওপর যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদেরও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সেই অঙ্গীকার অনুসারে নবী-রাসুলরা (আ.) স্বীয় অনুসারীদের মুহাম্মদ (সা.)-কে মেনে নেয়া ও তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান। (সীরাতে ইবনে হিশাম)। নবী রাসুলদের প্রতি আল্লাহতায়ালার উপরোক্ত নির্দেশনার বর্ণনা কোরআন মজিদে এভাবে এসেছে- আর যখন আল্লাহতায়ালা প্রতিশ্রুতি নিলেন নবীদের কাছ থেকে এই মর্মে যে, আমি যা কিছু তোমাদের কিতাব ও জ্ঞান দান করি, অতঃপর তোমাদের কাছে কোনো নবী আসেন- যিনি তোমাদের কাছে (আসমানি কিতাব ও হেদায়তের) যা কিছু আছে তার সত্যতা প্রতিপাদনকারী হন, তখন তোমরা অবশ্যই রাসুলের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং তার সাহায্য করবে। (আল্লাহ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি স্বীকার করে নিলে এবং এ বিষয়ে আমার প্রতিশ্রুতি (নির্দেশ) মাথা পেতে নিলে? তারা (নবীরা) বললেন, আমরা স্বীকার করে নিলাম। (আল্লাহ) বললেন, তাহলে তোমরা সাক্ষী থেকো এবং এ ব্যাপারে আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত রইলাম। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৮১)। বস্তুত সেই প্রতিশ্রুত রাসুলের আবির্ভাব হয়েছিল আরবের মরু সাহারায়। তিনি লাভ করেন সেই ওহী, যার সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল যুগে যুগে। বিশ্বমানবতা যার অপেক্ষায় তৃষিত চাতকের মতো চেয়ে রয়েছিল আকাশ পানে, আল্লাহর রহমতের বারি বর্ষণে মানবিক মূল্যবোধের ক্ষরাকবলিত মানব জমিন সিক্ত হওয়ার আশায়।

ওহির সূচনা ছিল প্রভাতের মতো সত্যস্বপ্ন দেখা

যুহরীর বর্ণনায় আয়েশা (রা.) বলেন : আল্লাহতায়ালা যখন রাসুল (সা.)-কে সম্মানিত করতে ও তার দ্বারা মানব জাতির প্রতি অনুগ্রহ করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা,) নবুয়তের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যেই স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের মতোই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এসময় আল্লাহতায়ালা তাকে র্নিজনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তার কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে) (সিরাতে ইবনে হিশাম)।

গাছপালা, পাথর, পর্বত সালাম জানায়

আব্দুল মালিক ইবনে উবাইদুল্লাহ বর্ণনা করেন : আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে সম্মানিত মর্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলে নবুয়তের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোনো প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতেন। তখন যে কোনো পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ওই পাথর বা গাছ বলে উঠত : আস্ সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ! (হে আল্লাহর রাসুল! আপনার প্রতি সালাম)। এ কথা শোনা মাত্রই রাসুলুল্লাহ (সা.) আশপাশে, ডানে বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিন্তু গাছ ও পাথর ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না। কিছু দিন এভাবে কেটে গেল আর রাসুলুল্লাহ (সা) এভাবে শুনতে ও দেখতে থাকলেন। অতঃপর, রমজান মাসে তিনি যখন হেরা গুহায় অবস্থান করছিলেন, তখন তার কাছে আল্লাহর তরফ থেকে পরম সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক বাণী বহন করে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এলেন।

হেরা গুহায় নির্জন সাধনায়

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর ১ মাস হেরা গুহায় কাটাতেন। এ সময় তার কাছে যত দরিদ্র লোকই থাকত, তাদের তিনি খাবার দিতেন। এক মাসের এই নির্জনবাস সমাপ্ত করে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে সর্বপ্রথম কাবা শরিফে গিয়ে ৭ বার বা ততোধিকবার তাওয়াফ করতেন এবং এ কাজ করার পরই শুধু বাড়িতে ফিরে যেতেন। অতঃপর আল্লাহ কর্তৃক তাকে পরম সম্মানে ভূষিত করার মাসটি অর্থাৎ নবুয়ত প্রাপ্তির বছরের রমজান মাস সমাগত হলে তিনি যথারীতি হেরায় অবস্থানের জন্য রওনা হলেন। অবশেষে সেই মহান রাতটি এলো, যে রাতে আল্লাহ তাআলা তাকে রিসালাত দিয়ে গৌরবান্বিত করেন। এই সময় আল্লাহর নির্দেশে জিবরাইল (আ.) তার কাছে এলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/২০৮)।

হেরা গুহার অবস্থান

মক্কার চারপাশে অনেকগুলো পাথুরে পাহাড়। আরবরা বলে জাবাল। একটি পাহাড়ের নাম ‘নাবীর’। বলা হয়, এর পাদদেশেই ইবরাহিম (আ.) তার সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর হুকুমে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। পরে পাহাড় থেকে নেমে আসা বেহেশতি দুম্বাকে জিবরাইল (আ.) এর ইঙ্গিতে ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানি দেন। এটি খাড়া এবং উচ্চ পাহাড়। তার বিপরীত দিকের পাহাড়টির নাম জাবালে নূর (জ্যোতির্ময় পাহাড়)। মক্কা থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে খাড়া এই পাহাড় মক্কা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বে। উচ্চতা সমতল থেকে ২০০ গজ। সটান পাথর আর কাঁটাগুল্মের পাহাড়টিতে ওঠা কষ্টসাধ্য। আরোহণের জন্য কোনো সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল না। নিচ থেকে ওপরে উঠতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। পাথরের সরু পথ দিয়ে ওপরে উঠার পর একটি সমতল স্থান। আয়তন প্রায় ৪০ গজ, সেখান থেকে মসজিদুল হারাম ও মক্কার ঘরবাড়ি দেখা যায়। মনে হবে সমতল ভূমির বুকে পাহাড়টি দ্বীপের মতো, যা আকাশের নীলিমায় ভাসছে। সমতল স্থলের দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় পাহাড়ের চূড়া। পর্বত চূড়া থেকে নিম্নমুখি ৫০ গজ দূরত্বে একটি গুহা, এর নামই হেরা গুহা। প্রবেশপথ উত্তরমুখি। গুহার নিকটে দুটি বড় পাথর পরস্পর যুক্ত হয়ে আছে। এর ফাঁক দিয়ে খুব কষ্ট করে যাওয়া যায়। ওপর থেকে কয়েকটি পাথরখণ্ড ভেঙে পড়ে গুহাটি সৃষ্টি হয়েছে। গুহা পাহাড়ের ভেতর নয়; বরং পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা তাঁবুর মতো। গুহার ছাদ ও দেওয়াল পাথরের এবং মসৃণ। ভেতরের উচ্চতা ৫-৬ ফুট, একজন মাঝারি ধরনের মানুষের উচ্চতার সমান। মেঝে ছাদ ও দেওয়ালগাত্রের তুলনায় মসৃণ এবং সোনালি রঙের বালু বিছানো। দৈর্ঘ্য ৪ গজ এবং প্রস্থ পৌনে দুই গজ। ভেতরের আয়তন কোনোমতে একজন লোক শোয়ার কিংবা একসঙ্গে ৫ জন লোক বসার মতো। গুহার অবস্থান এমন যে, সারাদিন সূর্যের আলো সরাসরি প্রবেশ করতে পারে না, তবে কেউ শুয়ে বা বসে থাকলে অনায়সে কাবাঘর দেখা যায়। হেরা গুহার তিনটি বিশেষত্ব ছিল নির্জন সাধনা, ধ্যানমগ্ন ইবাদত ও কাবাঘরকে দেখার মতো সুযোগ ও পরিবেশ, যা আত্মিক উন্নতি, চিন্তার বিকাশ ও অপার্থিব জ্ঞানের গভীরতায় ডুব দেয়ার সহায়ক। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ : ২/৩১৯)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত