যেভাবে ওহি নাজিলের সূচনা হয়েছিল

শাহীদুল্লাহ যুবাইর

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কোরআন মজিদ নবী করিম (সা.) কে দেয়া সবচেয়ে বড় ও চিরন্তন মোজেজা। মক্কার উপকণ্ঠে গারে হেরায় নবীজির ধ্যানরত অবস্থায় যেভাবে কোরআন নাজিলের সূচনা হয়, সেটাও ছিল সম্পূর্ণ অলৌকিক, বিস্ময়কর মোজেজা। বোখারি শরিফে বর্ণিত হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বিষয়টির বিবরণ এসেছে এভাবে (জিবরাইল) ফেরেশতা সেখানে এসে তাকে (নবী করিম (সা.) কে বললেন, পড়ুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তো পড়তে পারি না। তিনি বলেন, ফেরেশতা তখন আমাকে ধরে এত জোরে আলিঙ্গন করলেন যে, এতে আমি চরম কষ্ট অনুভব করলাম। এরপর ফেরেশতা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন। আমি বললাম, আমি পড়তে পারি না। তখন তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে ধরে খুব জোরে আলিঙ্গন করলেন। তাতে আমার অত্যন্ত কষ্টবোধ হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে পড়তে বললেন। আমি বললাম, আমি পড়তে পারি না। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন ফেরেশতা আমাকে ধরলেন এবং তৃতীয়বার আমাকে আলিঙ্গন করলেন। এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন : ‘আপনার প্রতিপালকের নামে পড়ুন। যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। আর আপনার প্রতিপালক অতিশয় সম্মানিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না। (সুরা আলাক, আয়াত : ১-৫)।

ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহকে যখন পড়তে বলেন, তখন সামনে কিছু ছিল কি-না। না হয় হুজুর (সা.) কেন বললেন, ‘মা আনা বেকারিইন’ ‘আমি পড়তে পারি না।’ এ সম্পর্কে ¯পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় সিরাতে ইবনে হিশামের এক বর্ণনায়। হজরত নবী করীম (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসের ২৪ তারিখ (দিবাগত) রাতে আমি ঘুমিয়েছিলাম। এ অবস্থায় জিবরাইল আগমন করলেন। তখন তার কছে এক খণ্ড রেশমি কাপড়ে মোড়ানো একটি লিপি ছিল। তিনি লিপিটি বের করে আমাকে দিলেন এবং বললেন পড়ুন।’ (সিরাতে ইবনে হিসাম, ফারসি অনুবাদ, ১/২০৮)।

প্রথম ওহি লাভের পর কম্পিত দেহে নবীজি

আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে জিবরাইল মারফত প্রথম ওহি লাভের ফলে হজরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামমের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার নিখুঁত বর্ণনাও আছে হাদিস ও সিরাত গ্রন্থগুলোতে। বোখারি শরিফের বর্ণনা-

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাঁর হৃদয় তখন ভয়ে কাঁপছিল। তিনি স্ত্রী খাদিজা বিনতে খোয়াইলাদণ্ডএর কাছে এসে বললেন, ‘তোমরা আমাকে চাদর দিয়ে ডেকে দাও। তোমরা আমাকে চাদর ঢেকে দাও।’ তিনি তাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। পরে তার ভয় চলে গেলে তিনি খাদিজা (রা.)-এর কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, আল্লাহর কসম! আমি আমার নিজের জীবন সম্পর্কে আশঙ্কাবোধ করছি।’

জিবরাইল (আ.)-এর এই পাঠ নকশার মতো অঙ্কিত হয়ে যায় হজরতের হৃদয়ে। প্রথম ওহি লাভ করার পর নবীজি এভাবে শংকিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করেছেন ইবনে হিশাম। তাতে বাড়ি ফেরার আগে আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ আছে।

আসল আকৃতিতে জিবরাইলকে দেখা

রাসুলে পাক (সা.) বলেন, (ওহি লাভ করার পর) আমি গুহা থেকে বেরিয়ে আসলাম। পাহাড়ের মাঝামাঝি এসে আকাশ থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম। বলছিল যে, হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসুল আর আমি জিবরাইল। এই আওয়াজ শুনে আমি উপরের দিকে মাথা তুললাম। তখন দেখলাম যে, এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান। তার উভয় পা আকাশের দিগন্তে প্রোথিত। একটি পশ্চিম প্রান্তে, একটি পূর্বপ্রান্তজুড়ে। আর আমাকে বলছে-

‘হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসুল আর আমি জিবরাইল।’

আমি তখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। অপলকে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এক পা সামনেও যাচ্ছি না, এক পা পেছনেও না। এমতাবস্থায়, তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আাকাশের যে দিকেই তাকালাম, সর্বত্র তাকে দেখছিলাম। তিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। আর তার দুই পা দিগন্তকালে প্রোথিত। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে গেল। আমি এভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। আর অপলকে দেখেছিলাম। এদিকে বাড়ি ফিরতে বিলম্ব হওয়াতে খাদিজা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। আমার খোঁজে চারদিকে লোক পাঠাল। মক্কার উচ্চভূমি পর্যন্ত তালাশ করে আমাকে না পেয়ে তারা তার কাছে ফিরে গিয়েছিল। বেশকিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর জিবরাইল আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর আমি খাদিজার কাছে ফিরে গেলাম। খাদিজা বলল, মুহাম্মদ! আপনি কোথায় ছিলেন। আপনার জন্য আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু খাদিজা দেখল যে, আমার অবস্থা তার কাছ থেকে যে অবস্থায় গিয়েছিলাম সেরূপ নয়। জিজ্ঞেস করল, মুহাম্মদ! আপনার কি হয়েছে? এমন কেন হলেন? আপনি কি তাহলে ভয় পেয়েছেন? তখন আমি আমার অবস্থার বিবরণ দিলাম। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ফারসি অনুবাদ, ১/২১০)।

ওহির বাহক জিবরাইল (আ.)-কে তার আসল আকৃতিতে দেখার ইঙ্গিত রয়েছে কোরআন মজিদে।

‘তিনি তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন।’ (সুরা আত-তাকভির, আয়াত : ২৩)।

বোখারি শরিফের বর্ণনায় জিবরাইলকে আসল আকৃতিতে দেখার এই ঘটনা ছিল পরবর্তী আরেক সময়ে। মাঝখানে হঠাৎ ওহি নাজিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরের ঘটনা। যেমন-

ইবনে শিহাব যুহরী বলেন, আবু সালমা ইবনে আব্দুর রহমান বর্ণনা করেছেন, জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী ওহির বিরতি প্রসঙ্গে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদিসে বলেছেন : আমি পথ চলাকালে আসমান থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম। তখন আমি উপরে তাকিয়ে দেখি, হেরা গুহায় যিনি আমার কাছে এসেছিলেন সেই ফেরেশতা আসমান জমিনের মাঝখানে একটি কুরসিতে বসে আছেন। এতে আমি ভীত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম এবং আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে বললাম। তখন আল্লাহতায়ালা নাজিল করলেন :

‘হে চাদর জড়ানো ব্যক্তি! উঠুন, আর সতর্ক করতে থাকুন। আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আপনার কাপড় পবিত্র করুন এবং অপবিত্রতা ত্যাগ করুন।’ (সুরা আল-মুদ্দাস্সির, আয়াত ১-৪)।

‘এরপর থেকে ওহি পুরোদমে একের পর এক নাজিল হতে লাগল।’ (বোখারি শরিফ, বদউল ওয়াহ্য়, হাদিস নং-৪)।

বর্ণিত আছে, ফেরেশতা জিবরাইলের ৬০০ কিংবা ৬০০০ ডানা আছে। সবগুলো ডানা প্রসারিত হয়েছিল, সেদিন নবীজির সম্মুখে মক্কার দিগন্তে। এমন দৃশ্যে যে কেউ মূর্ছা যাওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু নবীজি ছিলেন অচঞ্চল। পরিস্থিতি বুঝে উঠার প্রচণ্ড শক্তি কাজ করছিল তার ভেতর।