রমজানের তাৎপর্য ও বিশ্লেষণ

মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ খান

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হিজরি চান্দ্রবর্ষের নবম মাসের নাম রমজান। আরবি উচ্চারণ রমাদান। এর ধাতুমূল ‘রমিদা’ বা ‘রমাদা’। অর্থ প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। এ নামকরণের কারণ হিসেবে তিনটি মত পাওয়া যায় : এক. যেহেতু তখন রমাদান উষ্ণ মৌসুমে আবর্তিত হতো তাই এ নামে নামকরণ করা হয়েছে। দুুই. প্রথম রমাদান মাস পালিত হয়েছিল গ্রীষ্মে, তাই এ নামে নামকরণ করা হয়েছে। তিন. যখন রমাদান মাসটি হিজরিবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন রোজায় মানব স্বভাবের দিকে বিবেচনা করে শূন্য উদর বা খালি পেটের অবস্থাকে ‘রমদ’ বা আগুন-গরমের সঙ্গে তুলনায় রোজার মাসকে এই নাম দেয়া হয়েছে। (লিসানুল আরব)।

রোজা শব্দের বিশ্লেষণ

বাংলা ভাষায় সিয়াম ‘রোজা’ শব্দে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ শব্দটি মূলত ফার্সি শব্দ। আরবিতে এর প্রতিশব্দ সওম, আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ, যার অর্থ উপবাস। এই ইন্দো-ইরানীয় ধাতুমূল থেকে রোজা শব্দের উদ্ভব। রোচস অর্থ দিন বা আলো। যেহেতু আমলটি দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত পালন করা হয়। এদিক বিবেচনায় রোজা শব্দটি এসেছে। আরবি সিয়াম বা সওম শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। প্রিয় রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়; বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই হলো প্রকৃত সিয়াম। সুতরাং যদি তোমার সঙ্গে কেউ দুর্ব্যবহার করে অথবা তোমার প্রতি মূর্খতা দেখায়, তাহলে তুমি (তার প্রতিকার বা প্রতিশোধ না নিয়ে) তাকে বলো, ‘আমি সায়েম’, আমি রোজা রেখেছি, আমি রোজা রেখেছি।” (মুস্তাদরাকে হাকেম ও ইবনে হিব্বান)।

পূর্ববর্তী শরিয়তে রোজা

নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসার পর ইসলামের অনেক বিধান সম্পর্কেই ওহি নাজিল হয়েছে। আর কিছু বিধান এমন ছিল, যা পূর্ববর্তী নবীদের ওপর আবশ্যক ছিল; কিন্তু তখন পর্যন্ত নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ওই সব বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। তার মধ্যে রোজা বা সিয়াম ছিল অন্যতম। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগে আদি মানব তথা আদি পিতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে বিভিন্ন নবী রসুলের ওপর রোজা রাখা ফরজ ছিল; কিন্তু রোজার সংখ্যায় ভিন্নতা ছিল। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নাজিলের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদির ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। (দুররে মুখতার, ৩য় খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা)। আল্লাহ তায়ালা রোজা ফরজ হওয়া সম্পর্কে কোরআনে বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। আল্লাহ তায়ালা উম্মাতে মুহাম্মাদিকে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ রমজান মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

রোজার ফজিলত

রমজানের রোজার ফজিলত সম্পর্কে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘রোজা (দোজখ থেকে রক্ষার জন্য) ঢাল স্বরূপ।’ (বোখারি:২৫৪)।

রমজান কোরআন পাঠের মাস

রমজান মাসের ফজিলত অনেক। এই ফজিলত পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বহু জায়গায় উল্লেখ হয়েছে। এ মাস হলো কোরআন নাজিলের মাস। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ করেন, ‘রমজান হলো এমন মাস, যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। এ মাসে নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি কোরআন পাঠ করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘হজরত জিবরাইল (আ.) রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে প্রতি রাতেই সাক্ষাৎ করতেন। আর নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোরআন শুনাতেন।’ (বুখারি : ১৯০২)।

লাইলাতুল কদর

রমজান মাসেই রয়েছে মহিমান্বিত ও ফজিলতপূর্ণ রজনী ‘লাইলাতুল কদর’ বা ভাগ্যরজনী। যে রজনীতে ইবাদত করাকে আল্লাহ তায়ালা হাজার মাস ইবাদাত করা অপেক্ষা উত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর বা ভাগ্যরজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সুরা কদর : ৩)।

লাইলাতুল কদর কোন রজনী তা নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্ধারণ করে দেননি। এ সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।’ (বোখারি : ২০২০)।

রোজার পুরস্কার

রোজাদারের জন্য রয়েছে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তি ও বিরাট প্রতিদানের সুসংবাদ।

পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ ও রোজা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী, এদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।’ (সুরা আহজাব : ৩৫)।

আর এই মহাপুরস্কার কী হবে তা হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় : ১. ‘রমজানের রোজা আদায়ের মাধ্যমে গোনাহ মাফ হয়ে যায়।’

(মুসলিম : ৪৪০)। ২. ‘প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য মানুষকে আল্লাহতায়ালা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৬৪৩)।