মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৩৬০)

ধৈর্যই সৌভাগ্যের জিয়নকাঠি

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

লোকমান আগেকার দিনের একজন জ্ঞানী পণ্ডিতের নাম। তিনি লোকমান হাকিম নামে প্রসিদ্ধ। হাকিম মানে জ্ঞানী, পণ্ডিত, প্রাজ্ঞ, মনীষী। তিনি ছিলেন দাউদ (আ.)-এর সমসাময়িক। দাউদ (আ.) একাধারে নবী ও বাদশাহ ছিলেন। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। নিজ হাতে যুদ্ধের সরঞ্জাম, লোহার বর্ম বানাতেন। লোকমান (আ.) নবী ছিলেন না, তবে নবীর মর্যাদায় আল্লাহর প্রশংসিত জ্ঞানী ছিলেন। তার আলোচনা ও উপদেশমালা বিধৃত হয়েছে কোরআন মাজিদে। কোরআন মাজিদের ১১৪ সুরার মধ্যে একটির নাম সুরা লোকমান। সুরা রুমের পর ৩১ নং সুরা লোকমানের আয়াত সংখ্যা ৩৪টি।

লোকমান (আ.) ও দাউদ (আ.)-এর একটি ঘটনা নিয়ে মওলানা রুমি মানবজাতির জন্য একটি বড় উপদেশ পেশ করেছেন। তা হলো- ধৈর্যের মহিমা। ধৈর্য একটি চারিত্রিক গুণ। আমরা দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলি, অস্থির হয়ে পড়ি। চেষ্টা-সাধনা ত্যাগ করে হতাশায় ভুগি কিংবা হঠাৎ চটে যাই। অথচ ধৈর্যই সবচেয়ে বড় শক্তি। জীবনে স্বার্থকতা, সাফল্যের জিয়নকাঠি ও হাতিয়ার সবর। যে ব্যক্তি যত বড় ধৈর্যশীল, সে তত বড় ও অজেয়।

একদিন দাউদ (আ.) যুদ্ধের হাতিয়ার ও লোহার বর্ম তৈরি করছিলেন। তিনি বর্ম নির্মাণে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আল্লাহতায়ালা শক্ত ইস্পাতকে দাউদ (আ.)-এর জন্য নরম করে দিয়েছিলেন। শক্ত লোহা তার হাতের ছোঁয়ায় গলিত মোমের মতো নরম হয়ে যেত। লোকমান হাকিম একদিন দাউদ (আ.)-এর সাক্ষাতে যান। তিনি তখন বর্ম তৈরিতে মশগুল। কম বয়সি লোকমান (আ.) চিনতেন না বর্ম কি? তাই সহজ সরল মনে তাকিয়ে দেখছিলেন।

রাফত্ লোকমান সূয়ে দাউদে সাফা

দীদ কূ মীকর্দ যা’হান হাল্কাহা।

একবার লোকমান গেলেন স্বচ্ছ-হৃদয় দাউদের কাছে

দেখলেন, তিনি বানান লোহার আংটা কীসের কাজে!

একটার পর একটা আংটা বানাচ্ছেন। আবার এক আংটার সঙ্গে অন্য আংটা জোড়া দিচ্ছেন। এত বড় বাদশাহ, আল্লাহর নবী এমন করছেন কেন? এ প্রশ্ন লোকমান (আ.)-এর মনে ঘুরপাক খায়। কারণ, তিনি বর্ম নির্মাণশিল্প এর আগে কখনও দেখেননি। তিনি ভাবেন, কী হতে পারে এসব লোহার আংটা দিয়ে! যাক, ভালো হয় তার কাছেই জিজ্ঞেস করি, একটার ভেতর আরেকটা আংটা ঢুুকিয়ে তিনি এমন করছেন কেন? কিন্তু না, পরক্ষণে চিন্তা করেন, জিজ্ঞেস না করে বরং সবর করব। কারণ, ধৈর্য ধারণই তো সবচেয়ে উত্তম। ধৈর্যই তো মানুষকে সবচেয়ে দ্রুত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দেয়। জিজ্ঞেস না করে বরং চিন্তা করতে থাকি। তাহলেই রহস্য তাড়াতাড়ি উদ্ঘাটিত হবে। ধৈর্যের পাখি সব পাখির চেয়ে অধিক ক্ষিপ্রতায় ওড়ে। সন্ধানীকে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। আর যদি জিজ্ঞেস করি, তাড়াহুড়ো করি, তাহলে লক্ষ্য অর্জিত হবে বিলম্বে। সহজ জিনিসটা অধৈর্যের কারণে কঠিন হয়ে যেতে পারে।

নানা চিন্তা করে লোকমান (আ.) ধৈর্য ধরলেন। চুপ রইলেন। দেখতে থাকলেন। এরই মধ্যে দাউদ (আ.) লোকমান (আ.)-এর সামনে বর্মটির নির্মাণ শেষ করলেন। এবার দাউদ (আ.) বর্মটি গায়ে জড়ালেন। হয়ে গেল লোহার জামা বর্ম, যুদ্ধাস্ত্র। বুঝিয়ে বললেন, দেখ বাছা! এই জামা পরলে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর ধারালো তরবারির আঘাত গায়ে লাগে না। এটি বিপদ ও শত্রুর মোকাবিলায় বড় শক্ত যুদ্ধাস্ত্র।

গোফত লোকমান সবর হাম নেকূ দামীস্ত

কে পানাহ ও দাফেয়ে হারজা গামীস্ত

লোকমান বললেন, ধৈর্যও তো প্রাণ সঞ্জীবক শক্ত

কারণ, ধৈর্য সর্বত্র দুঃখ-দুশ্চিন্তা রোধে বর্ম ও দুর্গ।

বর্ম শত্রুর বাইরের আঘাত প্রতিহত করে; কিন্তু ধৈর্য ভেতরের শত্রু দুঃখণ্ডদুশ্চিন্তা ও হতাশা দমন করে। ভেতরের ও বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনে সবর।

সব্র রা’ বা’ হক কারীন কর্দ আই ফোলা’ন

আ’খেরে ওয়াল আস্র রা’ আ’গা’হ বখা’ন।

সত্য যেখানে ধৈর্য সেখানে, দেখ আল্লাহর বিধনে এ যে!

সুরা আসরের শেষটায় পড় সচেতনভাবে।

সত্য আর ধৈর্য সহগামী, অন্তরঙ্গ সঙ্গী। আল্লাহতায়ালাই এমনটি করেছেন। এ সত্য জানতে হলে পড়ে দেখ সুরা আসরের শেষ দুই বাক্য- ‘তোমরা সত্যের জন্য পরস্পরকে উপদেশ দাও এবং ধৈর্যের জন্য উপদেশ দাও একে অপরকে।’ (সুরা আসর : ৩-৪)। কাজেই সত্যের পথে চলতে হলে ধৈর্য থাকতে হবে। আর ধৈর্যধারণ করলেই সত্যের পথ পাবে, সত্যের পথে চলা সহজ হবে।

শত সহস্র পরশমণি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তবে

ধৈর্যের মতো পরশমণি দেখেনি মানুষ বিশ্বলোকে।

সত্যিই আল্লাহতায়ালা জগতে হাজারো লক্ষ-কোটি রাসায়নিক পদার্থ ও শক্ত পাথর সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু ধৈর্যের চেয়ে উত্তম পরশ পাথর মানুষ আর দেখেনি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল : ৪৬)। গভীরভাবে লক্ষ্যণীয় হলো, আল্লাহতায়ালা বলেননি যে, তিনি ধৈর্যশীলকে ভালোবাসেন বা ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহর রহমত নামবে কিংবা আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারবে; বরং এসব কিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন।’

(মসনবি শরিফ : ৩য় খণ্ড, বয়েত : ১৮৪২-১৮৫৪)