তোমার ভেতরে বিরাজে আবেহায়াত

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বনের ধারে পাহাড়ের ঝরনাবাহিত একটি কুয়া। পিপাসার্ত পশুপাখিরা সেই পুকুরের পানি পান করে প্রাণ জুড়ায়, জীবন বাঁচায়। কিছুদিন থেকে বন্যহাতির উপদ্রবে কুয়াটি শ্রীহীন, নিরাপত্তাহীন। হাতিরা দল বেঁধে কুয়ায় নামে, পানি পান করে, শূড়ে পানি নিয়ে জলকেলি করে। মন চাইলে ডেরা পাতে, গায়ে কাদা মাখে, গড়াগড়ি দেয়। সেই কুয়া ব্যবহার করতে পারে না অন্য প্রাণীরা। তারা হাতির পালের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়, আতঙ্কে দিন কাটে পিপাসায়। অবস্থা বেগতিক দেখে এক খরগোশের মাথায় বুদ্ধি খেলে। একদিন টিলার চূড়ায় এসে সে ডাক দিয়ে বলে, ওহে হাতির দল! আমার একটি কথা শোন বলি তোমাদের। আমি হলাম আসমানি বাদশাহর দূত। তোমাদের প্রতি একটি বার্তা নিয়ে এসেছি চাঁদ বাদশাহর কাছ থেকে। আকাশের বাদশাহ একটি বার্তা পাঠিয়েছেন তোমাদের বলার জন্য। খরগোশের কথা শুনে হাতির সর্দার শূড় তুলে তাকায়। জানতে চায়, কী সেই আসমানি বার্তা! খরগোশ বলে, এই জলাধারের মালিকানা আমার। বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া তালুকে তোমরা উৎপাত করছ, এ জন্য তিনি ভীষণ রেগে আছেন। হাতিরা জানতে চায়। কেমন রাগ, কীভাবে বুঝব তা! খরগোশ বলে, তোমরা যখনই পানিতে নামো, বাদশাহ রাগে টগবগ করেন, কাঁপতে থাকেন। যে কোনো সময় তোমাদের তিনি শাস্তি দেবেন।

হাতিরা শংকিত হয় এমন কথা শুনে। খরগোশ বলে, চতুর্দশী পূর্ণিমা রাতে তোমাদের শাস্তির দিন অবধারিত। তারপর থেকে হাতিরা সতর্ক। একদিন পূর্ণিমার জোছনা রাতে তারা বেরিয়ে আসে বিনোদনে। কুয়ার ধারে এসে মনে পড়ে যায় আসমানি দূত খরগোশের সতর্কবাণী। হাতির সর্দার পরীক্ষা করতে এগিয়ে যায়। পানিতে শূড় দিয়ে নাড়া দেয়। তখনই আকাশের বাদশাহ রূপসী চাঁদনি কেঁপে ওঠে, টলমলে তার চাহনি। অমনি আতঙ্কে সর্দার দিল ভোঁ-দৌড়। সর্দারের পেছনে অন্য হাতিরাও দেয় ছুট, মুহূর্তে লাপাত্তা।

ভারতীয় গ্রন্থ কালিলা ও দিমনা হতে এ গল্প মসনবিতে চয়ন করেছেন মওলানা রুমি (রহ.)। আল্লাহর নবী-রাসুল (আ.) নেককারদের সঙ্গে নাফরমানদের বিতর্কের নমুনা এই উপমা। যুগে যুগে নবী-রাসুলরা পথহারা মানুষকে সত্য, সুন্দর, সঠিক ও সাফল্যের পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু নাফরমানরা তাদের উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তোমরা হলে হাতিকে ভয় দেখানো সেই খরগোশ। আমরা হাতির পালের মতো আহম্মক নই যে, চাঁদ রাগ করেছে শুনে ভয়ে পালাব? আল্লাহ কি তোমাদের মতো মামুলি লোকদের পেয়েছেন তার বার্তা শোনানোর জন্য! তোমরা আল্লাহর কাছের কেউ হলে নিশ্চয় তার সঙ্গে সাদৃশ্য থাকত তোমাদের মাঝে। তোমরা তো আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। তোমাদের কথা বিশ্বাস করব, মানব কেন আমরা? পয়গম্বরগণ তাদের এমন আচরণে আফসোস করে বলেন-

আম্বিয়া গোফতান্দ আওয়াহ পন্দে জা’ন

সখত তর কর্দ আই সফীহা’ন বন্দে তা’ন

নবীরা বলেন, আহ! প্রাণ উজাড় করা উপদেশ

তোমাদের জন্য এনেছে অন্ধত্ব, দুর্ভাগ্য অশেষ।

আমরা তোমাদের সামনে হেদায়াতের আলো জ্বালিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে আলোয় আলোকিত হওয়ার পরিবর্তে তোমাদের চোখ ঝলসে গেছে। বেয়াদবির কারণে তোমাদের চোখে-কানে বুঝি আল্লাহতায়ালা পর্দা ঢেকে দিয়েছেন, তোমাদের গর্দানে পরিয়ে দিয়েছেন গোমরাহির জিঞ্জির বেড়ি। ফলে তোমাদের জ্ঞানবুদ্ধি ও বিবেক বিকল হয়ে গেছে। প্রাণটা উজাড় করে তোমাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও উন্নত চিন্তার কথা বলছি, এরপরও তোমরা বল যে, আমরা আল্লাহর কাছের লোক, তাঁর প্রেরিত পুরুষ হতে পারি না, সেই যোগ্যতা আমাদের নেই। অথচ পাথর ও মাটির তৈরি মূর্তিকে বল যে, এরা আল্লাহর সমকক্ষ হতে পারে। সেই বিশ্বাসে ওদের পূজা দাও, উপকার-অপকার সাধনের ক্ষমতা আরোপ কর।

চোন বুতে সঙ্গীন শুমা’ রা’ কেবলা শুদ

লা‘নত ও কূরী শোমা’ রা’ যুল্লা শুদ

পাথরের মূর্তিতে পূজা দাও আপন উপাস্য জ্ঞানে

আল্লাহর অভিশাপ অন্ধত্ব লেগেছে তোমাদের পেছনে।

মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী পবিত্রাত্মাদের তোমরা উপহাস কর। অথচ হাতের তৈরি মূর্তির সামনে প্রণতি জানাও। আল্লাহর লানতের শিকার হওয়ার কারণেই আত্মপ্রঞ্চনায় কথার ফুলঝুরিতে এসব কর, উপমা সাজাও, গল্প বানাও। মওলানা (রহ.) আরও বলেন, কোনো জিনিসের সঙ্গে উপমা দিতে বা তুলনা করতে হলে প্রথমে সেই জিনিসের হাকিকত ও আদ্যোপান্ত জানতে হবে। নইলে নিজে বিভ্রান্তির শিকার হবে, অন্যদেরও বিভ্রান্ত করবে। বিশেষত আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে, আত্মিক জগতের সারথীদের ব্যাপারে কথা বলতে সাবধান হওয়া চাই। হাকিকত না জেনে বাহ্যিক অবয়ব দেখে তাদের বিচার করা যাবে না। এর প্রমাণ দেখ নবী-রাসুলদের জীবনে।

হাতের লাঠিকে মুসা (আ.) মনে করেছিলেন নিছক লাঠি বলে। আল্লাহতায়ালা যখন তুর পর্বতে মুসা (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে মুসা! তোমার হাতে ওটা কী? তিনি বললেন, এটি লাঠি, এর ওপর ভর দিয়ে চলি। ছাগলকে পাতা পেড়ে খাওয়াই। তখনও পর্যন্ত লাঠির হাকিকত মুসা (আ.)-এর কাছে উদ্ভাসিত হয়নি, যা একমাত্র আল্লাহতায়ালাই জানতেন। সেই হাকিকত ছিল মুসা (আ.)-এর হাতের লাঠি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আজদাহা। পরবর্তী সময়ে জাদুকরদের সাপরূপী রশিগুলো গিলে ফেলার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল তা। আল্লাহর হাকিকতের ভান্ডারের জ্ঞানের স্বরূপ জানতে মুসা (আ.)-এর মতো পয়গম্বরের যেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, সেখানে তোমরা কীভাবে কথার ফুলঝুরি আর মুখরোচক গল্পের অবতারণা করে আল্লাহর পুরুষ আম্বিয়া-আউলিয়াদের অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখাও!

মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, এ ধরনের বেখাপ্পা তুলনা করতে গিয়ে শয়তানও বিভ্রাটের সম্মুখীন হয়েছিল। আদম (আ.)-এর বাহ্যিক অবয়ব দেখে সে আল্লাহর সঙ্গে তর্ক করেছিল, তুমি আদমকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে। মাটির ধর্ম নিম্নমুখিতা। আর আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে। আগুনের ধর্ম ঊর্ধ্বমুখিতা। কাজেই আমি আদমকে নিম্নমুখী হয়ে সেজদা করতে পারি না। তোমার এমন অযৌক্তিক নির্দেশ আমি মানতে পারি না। এমন বেয়াদবির পরিণতিতে সে চির অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে। নুহ (আ.)-এর কওমও শুকনো মাটির ওপর জাহাজ বানাতে দেখে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেছিল। শেষ পর্যন্ত প্রলয়ঙ্করি প্লাবনে কাফেররা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। কাজেই সাবধান! নিজেকে অতি বুদ্ধিমান মনে করে প্রতারিত হও না।

মওলানা (রহ.) বলেন, আমি যে খরগোশ ও চাঁদের উপমা দিয়েছি, সে রহস্য এখন খুলে বলছি-

সিররে আ’ন খরগুশ দা’ন দীওয়ে ফযুল

কে বে পীশে নফসে তো আ’মদ রাসুল

সেই খরগোশের রহস্য বলি, সে ফালতু দৈত্য শয়তান

তোমার নফসের কাছে এসেছে সে দূত হয়ে, সাবধান!

তার আগমনের উদ্দেশ্য আরও খুলে বলছি তোমার জ্ঞাতার্থে-

তা কে নফসে গূ-ল রা’ মাহরূম কর্দ

যা’বে হাওয়ানী কে আয ওয়াই খিজর খোর্দ

তোমার দৈত্যরূপী নফসকে মাহরুম করেছে সে

সেই অমৃত হতে যা পান করেছিল খিজির নিজে।

বর্ণিত আছে, খিজির (আ.) আবেহায়াত বা অমৃত সুধা পান করেছিলেন, যার ফলে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনি এখনও জলে-স্থলে পথভোলা মানুষকে পথ দেখান। বস্তুত খরগোশতুল্য দৈত্য শয়তান তোমার নফসকে সেই আবেহায়াত পান করা থেকে বঞ্চিত করেছে। সেই আবেহায়াত কী? আবেহায়াত হলো- জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর মহব্বতে একাকার হয়ে যাওয়া। এগুলো অন্তর থেকে উৎসারিত হওয়ার সম্ভাবনা ও যোগ্যতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে লুকায়িত আছে। কবি বলেন, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। তবে ইলম, হেকমত ও আল্লাহর মহব্বত উৎসারিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো, নফস শয়তানের কাছে প্রতারিত হতে পারবে না। কামনা-বাসনার অনুকরণে মন ও চিন্তাকে কলুষিত করতে পারবে না। এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর ভালোবাসার প্রান্তরে বিচরণ করতে হবে। যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি, সে পথে অগ্রসর হতে হবে। এ ধরনের লোকের অন্তরেই প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞানের অমৃত সুধার প্রস্রবন উৎসারিত হয়। নইলে আবেহায়াত বলতে আমজনতা যেভাবে বিশ্বাস করে, কুহ কাহফের অন্ধকারে নিদিষ্ট স্থানে রক্ষিত কোনো পানির নাম আবেহায়াত নয়।

আল্লাহর নবীরা (আ.) বলেন, হে নাফরমানরা! যে উপমা আমাদের বেলায় দিয়েছ, আসলে তা তোমরা উল্টো প্রয়োগ করেছ। উদর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েছ। উপমার সেই গল্পে তোমাদের চিত্রই ভেসে উঠেছে। এখন যেহেতু আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বন করেছ, সেহেতু আল্লাহর আজাবের শিকার হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর।

সেই চাঁদের কথা বলছি, পানিতে যার প্রতিচ্ছবি টলমলে থাকে, তিনি তো সেই চাঁদ, আমণ্ডখাস সৃষ্টির সবকিছু যার সামনে সমর্পিত থাকে। কারণ, তার তাজাল্লি ভালোমন্দ সব সৃষ্টির ওপর অবারিত। তার রহমতের পরশে সবাই প্রতিপালিত। তিনি কি চাঁদ নাকি আসমান কিংবা সূর্য? কীসের সঙ্গে তুলনা হবে তার। তিনি তো তার চেয়ে আরও বড়, সূর্যের সূর্যের সূর্য। মওলানা (রহ.) বলেন, আসলে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা মস্তবড় ভুল। কারণ, তিনি তো উপমা বা ধারণা কল্পনার ঊর্ধ্বে। তাকে বোঝানোর মতো উপমা মানুষের চিন্তা ও কল্পনার বাইরে। এমন পরাক্রমশালী বাদশা, যার ক্রোধের শিকার হয়ে বহু জনপদ বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোরআন মাজিদে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি বহু শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছি। আমার শাস্তি এমন সময় তাদের পাকড়াও করেছিল, যখন তারা রাতের ঘুমে বা দিনের সুখণ্ডনিদ্রায় বিভোর ছিল।’ (সুরা আরাফ : ৪)।

(মসনবি শরিফ : ৩য় খণ্ড, বয়েত : ২৭৩৮-২৮১৪)