গোনাহ বর্জনে মোমিনের সৌন্দর্য

মুফতি শাহ আমিমুল ইহসান সিদ্দিকি

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গোনাহ মানে ময়লা; যা সৌন্দর্যকে মলিন করে। গোনাহ হৃদয়কে কলুষিত করে। মনকে অস্থির করে তোলে। গোনাহের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মানুষ হয় অধিকার বঞ্চিত। পরকালে স্থান হয় জাহান্নামে। তাই গোনাহ বর্জন করে চলা মোমিনের জন্য অতি আবশ্যক বিষয়। কবিরা গোনাহ বর্জন ও নেক কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে বস্তুত একজন মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়। প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য চাই একটি স্বচ্ছ মন, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-কে সন্তুষ্ট করার দৃঢ় মানসিকতা। তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতার মূল ভিত্তিই হলো, গোনাহ বর্জন করে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা হৃদয়ে সদা জাগ্রত রাখা। আর মোজাহাদার মাধ্যমে মন্দ গুণগুলো অন্তর থেকে দূর করে ভালো গুণের মাধ্যমে অন্তরকে সজ্জিত করা। হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, আমিত্ব, অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা, জীবে নির্দয়তা মন্দ গুণ। এগুলো হৃদয় থেকে দূর করার নিরন্তর প্রচেষ্টা তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতায় উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম মাধ্যম।

গোনাহ বর্জনে সওয়াব

নেক কাজ করলে যেমন সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি গোনাহের কাজ বর্জন করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। নামাজ-রোজা করলে যেমন আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী হওয়া যায়, তেমনি সুদণ্ডঘুষ, জুলুম, মিথ্যাচার, অন্যের অধিকার লুটে নেয়া থেকে বিরত থাকার মাধ্যমেও নেকি অর্জিত হয়। জুলুম করার শক্তি সামর্থ্য থাকার পরেও জুলুম না করা, জেনা-ব্যভিচার করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জেনা-ব্যভিচার থেকে বিরত থাকাটাই সওয়াবের কাজ। প্রকৃত মোমিন বান্দা প্রকাশ্য ও গোপনীয় ছোট-বড় সব ধরনের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় গোনাহ বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন গোনাহ পরিহার কর। নিশ্চয় যারা পাপ করেছে, তাদের শিগগির সেসব পাপের শাস্তি দেয়া হবে।’ (সুরা আনআম : ১২০)।

কবিরা গোনাহ পরিচিতি

কবিরা গোনাহ মানে বড় গোনাহ। যে গোনাহের কারণে বান্দাকে শাস্তি পেতে হয়। জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হয় কিংবা দুনিয়ার জীবনে রাষ্ট্রীয় কোনো শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। যে গোনাহ করলে কোরআন-হাদিসের কোনো বিধান লঙ্ঘিত হয় বা যা করা হলে কোনো ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়; এসব কাজকে ইসলামি শরিয়তে কবিরা গোনাহ বলে। কবিরা গোনাহ করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। কবিরা গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা কর। আশা করা যায়, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপগুলো মোচন করে দেবেন।’ (সুরা তাহরিম : ৮)।

১০টি বর্জনীয় কবিরা গোনাহ

১. সুদ : সুদদাতা, গ্রহীতা এবং সুদের কাজের সহযোগীরা (যেমন- সাক্ষী, দলিল লেখক সবাই) কবিরা গোনাহে লিপ্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে কল্যাণ অর্জন করতে পার।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩০)। আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদি কারবারের সাক্ষীদ্বয় ও লেখককে অভিশাপ দিয়েছেন। (সুনানে নাসায়ি : ৫১০৪, তিরমিজি : ১১১৯)।

২. অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা : অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ দখল করা বা হক মেরে দেয়া কবিরা গোনাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ কর না। জনগণের সম্পদের কিছু অংশ জেনেশুনে পাপপন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসন কর্তৃপক্ষের (বিচারকদের) হাতে তুলে দিও না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)।

৩. মিথ্যা কথা বলা : মিথ্যা কথা বলা কবিরা গোনাহ। মিথ্যা কথা না বলা সওয়াবের কাজ। কথায় আছে, একটি মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করতে দশটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য সত্য আঁকড়ে ধরা অপরিহার্য। কেননা, সত্য কল্যাণের পথ দেখায়। আর কল্যাণ পথ দেখায় জান্নাতের। যে লোক সর্বদা সত্য বলে এবং সত্য বলার প্রয়াসী হয়, একপর্যায়ে আল্লাহর কাছে তার নাম অতি সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। তোমরা মিথ্যা থেকে বিরত থাক। কেননা, মিথ্যা পাপের পথ দেখায়। আর পাপপথ দেখায় জাহান্নামের। যে লোক সর্বদা মিথ্যা বলে এবং মিথ্যা বলার প্রয়াসী হয়, একপর্যায়ে আল্লাহর কাছে তার নাম অতি মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়।’ (বোখারি : ৬০৯৪, মুসলিম : ২৬০৭)। মিথ্যা বললে আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করা হয়। আর মিথ্যা বর্জন করলে আল্লাহর আদেশ মানা হয়। মিথ্যা বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর।’ (সুরা হজ : ৩০)।

৪. মদ পান : মদ অপবিত্র। মদপান করা শয়তানি কাজ। আল্লাহর আদেশের অবাধ্যতা। আল্লাহতায়ালা মদকে অপবিত্র ঘোষণা করে বলেন, ‘হে মোমিনরা! নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদি ও জুয়ার তীর অপবিত্র, শয়তানি কাজ। সুতরাং তোমরা এসব পরিহার করে চল, যাতে কল্যাণপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘মদ হলো পাপের মূল এবং কবিরা গোনাহ। যে ব্যক্তি মদপান করল, সে তার মা, খালা বা ফুফুর সঙ্গে জিনা করার সমপর্যায়ের পাপ করল।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৫/৭০)।

৫. পিতামাতার অবাধ্যতা : আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর বিরোধিতা হয় না এমন সব কাজে পিতামাতার আদেশ মেনে চলা সন্তানের জন্য আবশ্যক। সন্তান পিতামাতার বাধ্য হওয়া সন্তানের সওয়াব ও সফলতা লাভের একটি শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। পিতামাতার বৈধ আদেশে সন্তানের অবাধ্যতা কবিরা গোনাহ। পিতামাতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা কবিরা গোনাহ। বার্ধক্যে তাদের সেবা না করা, খোঁজখবর না রাখা কবিরা গোনাহ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। পিতামাতার কোনো একজন বা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের উহ শব্দটিও বল না এবং তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) কবিরা গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে উত্তরে বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, মানুষ হত্যা করা ও মা-বাবার নাফরমানি করা।’ (বোখারি : ৫৫৫২)।

৬. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া : কোনো ঘটনাকে বাস্তবতার পরিপন্থি উপস্থাপন করাকে মিথ্যা সাক্ষ্য বলে। মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজে নানা বিপর্যয় সৃষ্টি করে। মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে ন্যায্য অধিকার ও সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয় বিচারপ্রার্থী। দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য কিংবা প্রকৃত ঘটনা না জেনে অনুমানে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবিরা গোনাহ। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের জঘন্য কবিরা গোনাহ সম্পর্কে অবগত করব না?’ এরপর বললেন, ‘তা হলো- মিথ্যা কথা বলা অথবা বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।’ (বোখারি : ৫৫৫২)।

৭. পর্দা না করা : পর্দা না করা কবিরা গোনাহ। নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর আল্লাহতায়ালা পর্দা ফরজ করেছেন। পর্দা মেনে চলা নারী ও পুরুষের জন্য কল্যাণকর। পর্দা নারীর নিরাপত্তাকে দৃঢ় ও মজবুত করে। পুরুষকে বাঁচায় হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে। পর্দা শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও ফরজ। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা জরুরি এ কথা বোঝাতে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুরা নুরে পাশাপাশি দুটো আয়াতে নারী ও পুরুষকে পৃথকভাবে সম্বোধন করেছেন। পুরুষদের পর্দার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে, আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’ (সুরা নুর : ৩০)। ঠিক এর পরের আয়াতেই আল্লাহতায়ালা নারীদের পর্দার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘মোমিন নারীদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।’ (সুরা নুর : ৩১)।

৮. অন্যের ক্ষতি করা : অন্যের ক্ষতি করা কবিরা গোনাহ। একজন মোমিন বান্দা অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। অন্যের উপকার করার চেষ্টা করা ও ভালো কাজে একে অপরের সহযোগী হওয়া মোমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যের সহযোগিতা করবে। গোনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চল। নিশ্চয় আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।’ ( সুরা মায়িদা : ২)।

৯. গিবত বা অন্যের দোষচর্চা : অন্যের মন্দ গুণ বা কৃত মন্দ কাজ তার পেছনে বলে বেড়ানোকে গিবত বলে। এটা কবিরা গোনাহ। গিবত খুবই মারাত্মক গোনাহ। গিবতকারী হাশরের মাঠে দুনিয়ায় যার গিবত করেছে, তাকে তার কষ্টার্জিত নেক আমল দিয়ে দিতে হবে। এটা গিবতের চরম খেসারত। গিবত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কিছু ধারণা গোনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পেছনে গিবত (নিন্দা) না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? এটাকে তো তোমরা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

১০. ধর্ষণ-জেনা-নারীর চরিত্র হরণ : নারীর চরিত্র হরণ করা কবিরা গোনাহ। বিয়ের সম্পর্ক ছাড়া কোনো নারীর সঙ্গে নারীর স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করা মারাত্মক অপরাধ। এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিণাম জাহান্নাম। জেনা না করাকে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং জিনা করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে, তাকে তার গোনাহের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।’ (সুরা ফোরকান : ৬৮)।

লেখক : ইমাম ও খতিব, মসজিদে বাইতুস সালাম, ত্রেভেজো, ইতালি