জীবন মানে মরুভূমির সফর

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নিশি রাতে এক বাড়ির দেওয়ালে সিঁদ কাটছিল চোর। কিসের ধুকধুক শব্দে ঘুম ভাঙে গৃহস্থের। গৃহস্থ ছাদের ওপর উঠে, তার দুই চোখে তখনো ঘুমের ঘোর। তাছাড়া বেশ কয়েক দিন থেকে অসুখে ভুগছিল সে। ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে দেখে এক লোক বসে কি যেন করছে ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে। জিজ্ঞাসা করে, কী বাবা! এত রাতে কী করো এখানে? তোমার বাড়ি কই? বলে, আমি একজন ঢোলক। অসুস্থ বাড়িওয়ালা ঢুলোঢুলো চাহনিতে আবারো জানতে চায়,

দর ছে কারি গোফতমীকূবম দুহুল

গোফত কূ বাঙ্গে দুহল এই বুসুবুল

কী করছ তুমি? বলে আমি ঢোল বাজাইছি এখানে

বলল, কই ঢোলের আওয়াজ যে আসে না কানে?

গোফতফরদা বেশনভী ইন বাঙ্গ রা’

না’রায়ে ইয়াহাসরতা ওয়াওয়াইলাতা

বলল, তুমি শুনবে ঢোলের এই আওয়াজ আগামীকাল

আর্তনাদ উঠবে, সব গেল, হায় পোড়া কপাল।

হ্যাঁ, এই ঢোলের বাড়ির আওয়াজ কাল শোনা যাবে। বাড়ির সব মালামাল চোরে নিয়ে গেছে, জীবনের সব সঞ্চয় নিঃশেষ, হায় আমার পোড়া কপাল বলে যখন কান্নার রোল পড়ে যাবে।

মওলানা রুমি বলেন, এই গল্প মিথ্যা, বানোয়াট, কল্পিত হলেও এর অন্তর্নিহিত আবেদন তুমি উপলব্ধি করতে পারছ না দুনিয়া নিয়ে বেঘোর থাকার ফলে। দুনিয়ার সব খোঁজখবর তুমি রাখ, ইতিহাসের ভালো-মন্দ লোকের পরিণতির কথা তুমি জান। আন্বিয়া (আ.) ও আউলিয়াদের ইতিহাস তোমার সামনে। কিন্তু তা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করনি। শুনেও না শোনার, দেখেও না দেখার ভান করে জীবনযাপন করছ। হ্যাঁ, যখন তোমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে যাবে, মৃত্যু যখন হানা দেবে তখন ঠিকই বুঝবে, তোমার অন্তরের চোখ তখন খুলে যাবে, সব দেখতে পাবে। এখন দেখছ না, কারণ তুমি অন্ধ। একটা কথা চিন্তা করো-

গির আলম পুর বুয়াদ খোরশিদ ও নূর

চো নরওয়ী দর যুলমতীমানন্দে গূর

মনে কর, এ বিশ্ব ভরপুর সূর্য ও তার আলোয়

তুমি যদি আঁধার কবরে গিয়ে নাও আশ্রয়।

বী নসীব আয়ী আযআ’ন নূরে আজিম

বাস্তেয় রওযনবাশী আয মাহে করিম

সেই উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হতে হবে বঞ্চিত

হৃদয়ের জানালায় ঢুকবে না জোসনা অবারিত।

কারণ তুমি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কুয়ার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছ। এখন যদি এ দুনিয়া তোমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে যায়, কবরের গহ্বরে ঢুকে যদি সূর্যের আলোর দেখা না পাও, দুনিয়ায় সবার জন্য অবারিত অথৈ জোসনা প্লাবন যদি তোমার বদ্ধ হৃদয়ের জানালায় ঢুকতে না পারে তাহলে বল,

দোষটা কি এই দুনিয়ার, নাকি তোমার?

লাহনে দাউদী বে সঙ্গ ও কুহ রসীদ

গূশে আ’ন সঙ্গীন দিলানশ কম শেনীদ

দাউদের কণ্ঠস্বর শুনেছে ঠিক পর্বত ও পাথর

কিন্তু পাষাণ-হৃদয়রা শোনেনি সেই কণ্ঠস্বর।

বর্ণিত আছে, আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর কণ্ঠস্বর এতই মধুর ও মোহনীয় ছিল যে, পাষাণ পর্বত ও পশুপক্ষি পর্যন্ত মুগ্ধ বিমোহিত হয়ে যেত, তার কণ্ঠে যবুর কিতাবের তেলাওয়াত শোনার জন্য সাগরের মাছেরাও কূলের ধারে ভিড় করত; অথচ তার জমানার পাষাণ হৃদয় কাফেররা তার আহ্বান হেদায়েতের হৃদয় নিংড়ানো আকুতি শোনেনি। মওলানা রুমি (রহ.) সাবা নগরীর অধিবাসী কাফের সম্প্রদায়ের প্রতি আম্বিয়াদের দরদমাখা উপদেশের বিবরণ দেয়ার পর মানবজাতির উদ্দেশে একটি প্রস্তাব রাখেন।

ইয়া বেহা’লে আউয়ালীনান বেনগরীদ

ইয়া সূয়ে আখের বেহাযমী দর পরীদ

হয় আগের লোকের ইতিহাস পর্যালোচনা করো

নচেৎ ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দূরদর্শিতার পথ ধর।

জীবন সাধনায় সাফল্যের বিজয়মাল্য কেড়ে আনার জন্য মওলানা রুমির প্রস্তাবিত দুটি পথ। একটি হলো, আগেকার দিনে যারা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে তাদের ইতিহাস ও শেষ পরিণতি দেখে জীবন চলার গতিপথ নির্ণয় করা, অথবা নিজের চিন্তা, সতর্কতা ও দূরদর্র্শিতা কাজে লাগিয়ে জীবনের দ্রুতযান এগিয়ে নেয়া।

দূরদর্শিতার বিষয়টির গুরুত্ব নির্ণয় করে মওলানা আরেকটি উপমার আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, তুমি কোনো মরুবিয়াবানের মধ্য দিয়ে সফরে যাবে। এ কথা শুনে একজন বলল, সাবধান, এখন থেকে সাত দিনরাত হাঁটার আগে তুমি পানির দেখা পাবে না। কাজেই সঙ্গে পানি নাও। আরেকজন বলল, না ওসব মিথ্যা। সফরে দিন শেষে প্রতি রাতে তুমি দেখবে যে, তোমার পাশ দিয়ে ঝরনা প্রবহমান। প্রথম প্রস্তাবটি আল্লাহর নবীদের ও ওলিদের। তারা বলছেন যে, আখেরাতের সফরের জন্য তোমাকে নৈতিক সম্বল ও মালসামানা জোগাড় করতে হবে, নচেৎ মরুভূমিতে পানির অভাবে মৃত্যুর মারাত্মক সংকটে পড়তে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবের প্রবক্তা শয়তান। সে মানুষের মনের কানে বলে যায়, ‘দুনিয়া কা মজা লে লও দুনিয়া তোমারি হ্যায়।’ ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূন্য থাক।’ নবী-ওলিদের ওসব কথা শুনলে জীবনের সুখ সম্ভোগ থেকে বঞ্চিত হবে। আখেরাতে কী হবে না হবে, এসব ভয় দেখানো মিথ্যা প্রলাপ। ‘দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে মাঝখানে তোর বেজায় ফাঁক।’ এই দুটি বক্তব্য; দুটি দর্শন মানবসমাজে আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। মওলানা রুমি বলেন, মরুভূমির সফরে ৭ দিন পর পানি পাওয়া যাবে, কাজেই সঙ্গে পানি নিয়ে যেতে হবে, এই প্রস্তাব আল্লাহর নবী, ওলিদের। তার বিপরীতে এই সফরে প্রতি রাতে তোমার শিয়রে পানি উপস্থিত হবে, সঙ্গে পানি নিতে হবে না, এ বক্তব্য শয়তান ও তার দোসরদের। এখন তুমি কোন প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে।

হাযমঅ’নবা’শদ কে বরগীরী তোআ’ব

তা’রহীআযতরসোবা’ শীবরসওয়া’ব

দূরদর্শিতা হলো অবশ্যই সঙ্গে নিয়ে যাবে পানি

থাকবে আশঙ্কামুক্ত হবে সরল পথে অগ্রণী।

সফরে পানি না থাকলে এই পানি ব্যবহার করবে, আর যদি সেখানে পানির অভাব না থাকে, তাহলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া পানি ফেলে দেবে। সহজ হিসাব।

গর বুয়াদ দররা’হ আব ইন রা’ বেরীয

ওয়ারনবা’শদ ওয়াইবর মর্দে সেতীয

যদি পথে পানি থাকে সঙ্গের পানি ফেলে দেবে

আর যদি না থাকে পানি, অবাধ্য ধ্বংস হবে।

কাজেই এই জগতে যদি নেক আমলের সঞ্চয় গড়ে সঙ্গে নিয়ে যাও, তাহলে দুটি অবস্থার ব্যতিক্রম হবে না। একটি অবস্থা হলো মনে করো, পরকালের ধারণা ভিত্তিহীন, দোজখণ্ডবেহেশত বলতে কিছু নেই, তাহলেও তো দুনিয়াতে সৎ কাজের সঞ্চয় গড়াতে তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয় অবস্থায় যদি পরকালের ধারণা সত্য হয়, বেহেশত-দোজখের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে তো দুনিয়ার সৎ কাজের প্রতিদান সেখানে পেয়ে যাবে, তুমি লাভবান হবে। অথচ তখন পরকাল অস্বীকারকারিরা বড় ধরনের সংকটে পতিত হবে।

আইখলিফা যাদেগা’ন দা’দীকুনীদ

হাযম বাহরে রোজেমী আদীকুনীদ

ওহে খলিফার সন্তানরা ইনসাফ করো

প্রতিশ্রুত পরকালের জন্য সঞ্চয় গড়।

সুরা বাকারার ৩০তম আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী আদম (আ.) পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। সেই সুবাদে মানবসন্তান আল্লাহর খালিফার সন্তান। কাজেই তোমাদের উচিত, প্রতিশ্রুত পরকালের জন্য সঞ্চয় গড়ে তোলা। মনে রেখো যে, তোমার বাবা সুউচ্চ উল্লিয়িন মাকামে ছিলেন, সেখান থেকে তাকে মাটির জিন্দানখানায় নিয়ে এসেছে। মারেফাতের জ্ঞানে তিনি জগৎ সেরা ছিলেন, যার জ্ঞানের সামনে ফেরেশতারা সিজদা করেছে। সেই মহাজ্ঞানীকে দেখেছ দুশমন শয়তান কীভাবে নাজেহাল করেছে।

‘অতঃপর শয়তান সেখানে থেকে তাদের পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান হতে তাদের বহিষ্কৃত করল। আমি বললাম, তোমরা একে অন্যের শত্রু হয়ে যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’ (সুরা বাকারা : ৩৬)।

মা’দর ও বা’বা’য়েমা’রা’অ’নহাসুদ

তা’জ ও পীরায়ে বে চা’লা’কীরুবুদ

দেখ দূরাচারী কী করেছে আমাদের মাবাবার

অতিচাতুর্যে কেড়ে নিয়েছে মুকুট ও বস্ত্র তার।

কর্দেশা’নঅ’ঞ্জা বেরেহনেযা’ রোখা’র

সা’লহা বেগরীস্তআ’দমযা রেযা’র

সেখানে তাদের করেছে বিবস্ত্র লজ্জিত

বহু বছর কেঁদেছে আদম লাজ জর্জরিত।

বর্ণিত আছে, বেহেশত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আদম (আ.) লজ্জায় ৩০ বছর আসমানের দিকে মাথা তুলে তাকাননি। কাজেই আদমের সন্তান হয়ে তোমরা শয়তানের ষড়যন্ত্র জালকে হালকা মনে করো না।

‘হে বনি আদম! শয়তান যেন তোমাদের কিছুতেই প্রলুব্ধ না করে- যেভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত হতে বহিষ্কৃত করেছিল, তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদের এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদের দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।’ (সুরা আরাফ : ২৬)।

হে আদম সন্তান! তুমি শয়তানের চক্রান্তজাল সম্পর্কে একটু চিন্তা করো যে, দ্বীনের সরদার, জ্ঞানের ভাণ্ডার আল্লাহর খলিফা আদমকে শয়তানের চক্রান্তজালে নাজেহাল হতে হয়েছে।

আলহাযারআই গেলপরস্তা’নআযশরশ

তীগেলাহাওলাযনীদ আন্দরসরশ

সাবধান! হে দেহপূজারিরা তার দূরাচার থেকে

তার মাথা ভাঙো লাহওলার তরবারি আঘাতে।

হাদিসে বর্ণিত আছে, কেউ যদি স্বচ্ছ অন্তরে ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম’ দোয়াটি পড়ে, তাহলে মনের শয়তানি কুমন্ত্রণা থেকে সে রক্ষা পাবে। এ সাবধানতার প্রয়োজন এ জন্য যে, শয়তান শুধুই দানা ছড়ায় শিকার করতে। ছড়ানো দানা দেখা যায় বটে; কিন্তু তার প্রতারণা ও বিছানো ফাঁদ দেখা যায় না। কাজেই-

হারকুজা’ দা’না বেদীদী আলহাযর

তা’ নবন্দদ দা’মবর তোবা’ল ও পর

সাবধান থেকো যখন কোথাও দেখবে দানা

যেন সে বেঁধে না ফেলে তোমার হাত-পা-ডানা।

দানা দেখলে, দুনিয়াবী সুখ সম্ভোগের সুযোগ দেখলে সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়বে না। কারণ দানার মাঝে শয়তানের বিছানো ফাঁদ পাতা থাকে। হয়তো মনে প্রশ্ন জাগবে, এমন বাছবিচার করে চললে হয়তো অনাহারে থাকতে হবে। মওলানা বলেন,

যাঙ্কে মুরগী কূ বে তরকে দানে কর্দ

দা’নেআয সাহরা’য়ে বী তযবীর কর্দ

খাঁচায় বন্দি পাখি যখন তার দানাপানি ছাড়ে

প্রান্তরে বিহার, নিখাদ খাবার সে জোগাড় করে।

হাম বেদা’নকা’নে‘ শুদ ও আয দাম জাসত

হীচ দামীপররওবা’লশ রা নবস্ত

সেখানে সে অল্পে তুষ্ট আর শিকারির ফাঁদ হতে মুক্ত

কোনো ফাঁদ করে না বন্দি তার ডানা ও পালক গুচ্ছ।

খাঁচায় বন্দি পাখি যখন দানা পানি ত্যাগ করে, তাকে খাঁচার বাইরে মুক্ত হাওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। তদ্রুপ শয়তানি কামনাবাসনা ও ভোগলিপ্সা যে ত্যাগ করে, সে হাকিকত ও মারেফাতের প্রান্তরে বিচরণ করতে পারে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ

৩খ. বয়েত-২৭৯৯-২৮৬১)