ভোগের রাজ্যে পাতানো জাল

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বা’য মুরগী ফাউকে দীওয়ারী নেশস্ত

দীদে সূয়ে দা’নেয়ে দামী বেবস্ত

একটি পাখি বসেছিল নিঃসঙ্গ এক দেয়ালের ওপর

অপলকে দেখছিল ছড়ানো খাবার জালের ভেতর।

য়্যক নযর উ সূয়ে সাহরা’ মী কুনাদ

য়্যক নযর হেরচাশ বে সাহরা’ মী কশদ

একবার দেখে উন্মুক্ত মাঠ বিছানো সবুজের চাদর

খাবারের লোভ একবার টানে পাতানো ফাঁদের ভেতর।

ইন নযর বা’ আ’ন নযর চা’লীশ কর্দ

না’গাহা’নী আয খেরাদ খা’লীশ কর্দ

এদিকে একবার ওদিকে আবার দৃষ্টির মাঝে ঝগড়া

হলো পরাজয় লোভের কাছে হঠাৎ তার দূরদর্শিতা।

মাঠের ধারে একটি দেয়ালের ওপর বসেছিল একটি পাখি। সে একবার তাকাচ্ছিল দূরে উন্মুক্ত মাঠের দিকে। আরেকবার দেখছিল সামনে শিকারির জালে ছড়ানো খাবারের পানে। তার বিবেক, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ডাকছিল তাকে মুক্ত মাঠের পানে। ওদিকে ভেতরের লোভ টানছিল মাঠে বিছানো খাবারের দস্তরখানে। এভাবে তার দুই দৃষ্টির মাঝে ঝগড়া ও লড়াই চলছিল ক্ষণে ক্ষণে। সেই লড়াইয়ে তার জ্ঞান প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা হঠাৎ হার মানে লোভের কাছে। তখন সে উড়াল দিয়ে ছড়ানো খাবারে বসে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার পা আটকে যায় শিকারির পাতানো ফাঁদে।

প্রত্যেক মানুষের ভেতরের সত্তায় ভালো ও মন্দ দুটি শক্তির দ্বন্দ্ব চিরন্তন। একদিকে বিবেক তাকে ক্ষণস্থায়ী ভোগবিলাসিতা ও কামনা-বাসনার আকর্ষণ ত্যাগ করতে পরামর্শ দেয়। অন্যদিকে তার নফস ও কুপ্রবৃত্তি কামনা-বাসনার গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে এবং ভোগের রাজ্যে হারিয়ে যেতে প্ররোচণা দেয়। কিন্তু যারা বিবেকবান ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তার বর্মে যারা সজ্জিত, তারা ধ্বংসাত্মক কামনা বাসনার কাছে নিজেকে সঁপে দেয় না। ভোগের লিপ্সা প্রতারণার ফাঁদকে অতি সতর্কতায় অতিক্রম করে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যায়। যারা দুর্বল মনের লোভাতুর, তারা নফসের কাছে ধরা খায়। নৈতিক দেউলিয়াত্বে উচ্ছন্নে যায়। মানব সত্তার অভ্যন্তরে বিরাজিত ভালো ও মন্দের এই টানাপড়েন ও দ্বেেন্দ্বর চিত্রটি এঁকেছেন মওলানা রুমি এই গল্পে। তিনি বলেন-

বা’য মুরগী কা’ন তরদ্দুদ রা’ গুযাশত

যা’ন নযর বরকন্দ ও বর সাহরা’ গুমা’শত

আরেকটি পাখি ঝেড়ে দোটানা সংশয় অন্তর্দৃষ্টি মেলে

ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে উড়াল দেয় মুক্ত মাঠের পানে।

শাদ পররো বা’লে উ বাখখা লাহু

তা’ ইমা’মে জুমলা আ’যা’দা’ন শুদো

সাবাস পাখি! সাবাস তোমার ডানা-পালক, উড়াল দেয়া

তুমি কীর্তিমান সবার নেতা আরও যারা স্বাধীনচেতা।

যারা সাধনার পাখি তাদের অবস্থাও এরূপ। তারা দুনিয়াবি স্বাদ ভোগ-লালসার আকর্ষণ পরিহার করে আত্মিক উন্নতি ও পূর্ণতার উচ্চতার প্রতি তাকায়। ইবাদত বন্দেগি ও কৃচ্ছ্রতার বাহনে জৈবিক কামনা-বাসনার আকর্ষণ বর্জন করে ইরফানের আকাশে উড়াল দেয়। এভাবে শুধু নিজেই মুক্তির রাজপথ জয় করে না, অন্য স্বাধীনচেতা আধ্যাত্মিক মানুষের নেতৃত্বে সে বরিত হয়, আত্মিক নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার মাকামে অধিষ্ঠিত হয়। কারণ, এমন দূরদর্শী লোকের আত্মা স্বাধীনচেতা মানুষের শিরোমণি ও দিশারিতে পরিণত হয়। এ সব সাথি তার সঙ্গে মারেফতের ফুলবন ও হেকমতের সবুজ বনানীর নিঃসর্গে প্রবেশ করে।

এমন স্তরে পৌঁছেই দূরদর্শিতার মালিক রাজি হন সেই দূরদর্শীর ওপর। আর দূরদর্শীও সন্তুষ্টচিত্ত হয় আপন মনিবের প্রতি। কাজেই তোমার মধ্যে যদি দূরদর্শিতার কিছু থাকে, নিজের জীবনকে এভাবে গঠন কর। নিজেকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ কর। তোমার জন্য সুসংবাদ আছে কোরআন মাজিদে। বলা হয়েছে-

‘আল্লাহ তাদের প্রতি রাজি আর তারা আল্লাহর প্রতি রাজি, এ পুরস্কার তাদের জন্য, যারা আপন প্রভুকে ভয় করে চলে (দূরদর্শী সতর্ক জীবনযাপন করে।) (সুরা বাইয়েনা : ৮)।

মওলানা রুমি (রহ.) মানব মনকে সম্বোধন করে বলছেন,

বা’রহা’ দর দা’মে হেরচ উফতা’দেয়ী

হলকে খোদ রা’ দর বুরীদান দাদেয়ী

বহুবার তুমি আটকে পড়েছিলে লোভের ফাঁদে

তোমার গর্দান এগিয়ে দিয়েছ ধারালো ছুরির সম্মুখে।

জীবনে বহুবার দূরদর্শিতা ও সতর্কতার অভাবে লোভের ফাঁদে আটকা পড়েছ। জবাই হওয়ার মতো অপরাধ নিয়ে তোমার কণ্ঠনালি বহুবার ধারালো ছুরির সম্মুখে এগিয়ে দিয়েছ। এত কিছুর পরও তওবা কবুলকারী আল্লাহর ফজল ও দয়া তোমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে, তোমাকে বাঁধনমুক্ত করেছে। তোমার তওবা কবুল করে তোমার হৃদয়ে আনন্দ বিলিয়েছে। মওলানা আরবিতে রচিত কবিতায় বলেন,

গোফত ইন উদতুম কাযা’ উদনা কাযা’

নাহনু যাউওয়াজনাল ফেআলা বিল জাযা’

বলেন, যদি পুনরায় এরূপ কর আমি করব তা

মানুষের কাজে জুড়ে দিয়েছি প্রাপ্য প্রতিফল যা।

আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘আশা করা যায় যে, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি রহম করবেন। যদি তোমরা তোমাদের অপছন্দনীয় কাজগুলো পুনরায় কর, তবে আমিও তোমাদের শাস্তি পুনরায় প্রয়োগ করব। আর আমি জাহান্নামকে কাফেরদের জন্য কারাগার বানিয়েছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৮)।

তার মানে, তোমরা মন্দ কাজ করলে মন্দের প্রতিফল অবশ্যই পাবে। এটিই আল্লাহর শাশ্বত নিয়ম। কিন্তু তুমি বারবার এই নিয়ম লঙ্ঘন করেছ। এর পরও দয়াময় তোমার সমস্যার সমাধান করেছেন। তোমার তওবা কবুল করেছেন। শয়তানের পাতানো ফাঁদ হতে উদ্ধার করেছেন। তাছাড়া সাবধান করে বলেছেন, সতর্ক হও, পালিয়ে যাও। শয়তানের পাতানো ফাঁদের দিকে আর এসো না। কিন্তু আবারো তুমি ভুলে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিয়েছ আগুনের মাঝে। মওলানা উপদেশ দিচ্ছেন, ওহে পতঙ্গ! তুমি ভুলে যাওয়ার আর সংশয়ের মাত্রা কমাও। আগে যে তোমার পালক বারবার পুড়েছে সে কারণ খতিয়ে দেখ।

সাবধানী জীবন লাভের জন্য আত্মণ্ডউপলব্ধি আসতে হবে। আর আত্ম-উপলব্ধির জন্য দুটি স্বভাব পরিহার করতে হবে। একটি হচ্ছে ভুলে যাওয়া। যদি তুমি নিজের কথা চিন্তা কর, ভুলে গিয়ে মন্দের আগুনে পুড়ে তোমার বিবেক ও তাকওয়ার পালক কতবার পুড়েছে তা যদি ভেবে দেখ, তাহলে সাবধানী চেতনার উন্মেষ ঘটবে। দ্বিতীয়ত, মনে কখনও দোটানা অবস্থার স্থান দিয়ো না। শয়তান তার কবজায় নেয়ার জন্য প্রথমে মনে নানা সন্দেহ সংশয় ঢুকিয়ে দেয়। ধর্মকর্ম পালনের নিয়ম নিয়েও নানা ফতোয়া দেয়, দ্বীনদার লোকদের মনে অহেতুক সন্দেহের বীজ ঢুকায়।

হ্যাঁ, যদি তুমি কামনার আগুন আর অবহেলা ও ভুলের শিকার হওয়ার কালো ধোঁয়া থেকে মুক্তি পাও, তবে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় কর। এ শোকর আদায়ের ধরন হবে, শয়তানের পাতানো মারপ্যাঁচের জালের দিকে একদম যাবে না।

তা তোরা’ চোন শোকর গূয়ী বখশদ উ

রূযীয়ে বী দা’ম ও বী খাউফে আদু

তুমি শোকর করলে তিনি আরও দেবেন তোমায়

এমন রুজি যেখানে ফাঁদ নেই, শত্রুর ভয় নেই।

আল্লাহ যে তোমাকে শয়তানের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করেছেন তার শুকারিয়া তোমার আদায় করতে হবে। এর জন্য আল্লাহর নেয়ামতের কথা বারবার স্মরণ করতে হবে। কিন্তু তোমার অবস্থা তো অন্যরকম।

চন্দ আন্দর রাঞ্জহা’ ও দর বলা’

গোফতী আয দা’মাম রহা’ দে আই খোদা’

কতবার তুমি দুঃখণ্ডদুর্দশায় পড়ে বলেছ এ কথা

শয়তাননের ফাঁদ থেকে আমায় রেহাই দাও, খোদা!

তাহলে তোমার ইবাদতে অটল থাকব। শয়তানের মুখে ছাই দিয়ে এগিয়ে যাব। কিন্তু শুধু বলাই সার হয়েছে। অলসতায় তুমি বেঘোরে ঘুমাও। তোমার অবস্থার সঙ্গে তুলনা হতে পারে সেই কুকুরের অলসতা। যার কাহিনি এমন-

নিঃস্ব এক কুকুর শীতকালে প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে শুকিয়ে হয়েছিল হাড্ডিসার। মনের সঙ্গে সে বলল, শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য গ্রীষ্মকালে একটি ঘর অবশ্যই নির্মাণ করব। কিন্তু যখন কনকনে শীতের হিমেল সেনারা চলে গেল, উঞ্চতার অনুকূল হাওয়া প্রবাহিত হলো, তখন তার গায়ের হাড়গোড় ফুলে উঠল। তার বিবেক তাকে বলল, এই গ্রীষ্মে একটি ঘর বেঁধে নাও। বৃষ্টিতে ভেজা শীতে জবুথবু হওয়া আর কত সইব। কুকুর তখন তার মনকে বলে, আমার এত বড় শরীর কি কোনো ঘরে ধরবে, জায়গা হবে। সে তার আগের সংকল্পের কথা বেমালুম ভুলে যায়। অলসতায় গা ভাসিয়ে দেয়। মানুষ যখন বিপদ মুসিবতে পতিত হয়, তখন আল্লাহকে ডাকে। আল্লাহর নেয়ামতের শোকরগোজারি করে। কিন্তু বিপদ কেটে গেলে নেয়ামতের মধ্যে ডুবে শোকর করার কথা ভুলে যায়। অথচ শোকর এমন সম্পদ, যা নেয়ামতের চেয়েও বড়।

শোকরে নে’মাত খোশতার আয নে‘মাত বুয়াদ

শোকর বা’রে কাই সূয়ে নে‘মাত রওয়াদ

নেয়মতের শোকর সে উত্তম নেয়ামতের চেয়ে

শোকর যার স্বভাব সে যায় না নেয়ামতের পেছনে?

নেয়ামতের চেয়ে নেয়ামতের শুকরিয়া উত্তম। কারণ কী? কারণ যে ব্যক্তি আত্মিক পূূর্ণতা ও চারিত্রিক সৌন্দর্যের উচ্চতায় পৌঁছেছে সেই নেয়ামতের শোকরিয়া করে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। তাছাড়া নেয়ামত বান্দার পরীক্ষার জন্য হতে পারে। কাউকে তার যোগ্যতার কারণে নেয়ামত দেয়া হয়- এমন নয়। নেয়ামত অলসতা আনে আর শোকর অন্তরকে জাগায়। কাজেই বাদশাহর প্রতি শোকরের ফাঁদ বসিয়ে তার নেয়ামত শিকার কর। আল্লাহ পাক বলেছেন-

‘তোমরা যদি আমার শোকর আদায় কর, আমি তোমাদের আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হও জেনে রেখ যে, আমার আজাব অত্যন্ত কঠোর। (সুরা ইবরাহীম : ৭)।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৩খ. বয়েত-২৮৬২-২৮৯৯) মসনবি শরিফের ওপর ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর নিয়মিত আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI