পর্দাহীনতার ক্ষতি

আশরাফ আলী থানবি (রহ.)

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বলা হয়, দৃষ্টি ফেরানো যায় না। কুদৃষ্টি থেকে বিরত থাকা যায় না। এটি ভুল কথা। নিঃসন্দেহে দৃষ্টি মানুষের ইচ্ছার অধীন একটি কাজ। আমি তো বলি, দৃষ্টি সংযত রাখার চেয়ে (না-মাহরম নারী বা হারাম দৃশ্যের প্রতি) দৃষ্টি নিবদ্ধ করার মাঝে কষ্ট বেশি। পরীক্ষা করে দেখ, দু-একবার দৃষ্টি সংযত করেই দেখ, অনুভব করতে পারবে, (নারী বা হারাম বস্তুর প্রতি) দৃষ্টিপাত করলে যে কষ্ট হয়, দৃষ্টি সংযত রাখলে তাতে সে কষ্ট কখনোই হয় না। হাদিসে আছে, দৃষ্টি হলো শয়তানের একটি তির। দৃষ্টি দ্বারা হৃদয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। আর দৃষ্টি সংযত রাখার দ্বারা সে আগুন নির্বাপিত হয়, যা দ্বারা কষ্ট ছিল অবশ্যম্ভাবী। দৃষ্টির হেফাজতের দ্বারা সে আগুন যেখানে যে অবস্থায় ছিল সেখানে সে অবস্থায়ই থেকে যায়। তা আর প্রজ্বলিত হয় না। বরং সে আগুন নিভে যায়। আর দৃষ্টির দ্বারা মৃত্যু পর্যন্ত অবকাশ থাকে আগুন জ্বলে ওঠার। কেননা, প্রতিটি কামুক দৃষ্টি চায় এর ফলাফল বিয়ে পর্যন্ত গড়াক। কিন্তু প্রতিটি দৃষ্টির পরই তো আর বিয়ে সম্ভব হচ্ছে না। তাই দৃষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় বারবার দৃষ্টিপাতের আগ্রহ ও তাকাজা জন্মায়। বারবার দৃষ্টিপাতের দ্বারাও যখন উদ্দেশ্য অর্জিত না হয়, তখন এ ধারা অব্যাহত থাকে। (আর হৃদয়ে এক ধরনের জৈবিক অস্থিরতা তৈরি হয়) ফলে দৃষ্টির ক্ষতি নির্মূল হয় না। পক্ষান্তরে দৃষ্টি সংযত রাখার কষ্ট ক্ষণিকের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়ে যায়।

দৃষ্টির পবিত্রতা

দৃষ্টিকেও পাক-পবিত্র রাখতে হয়। পবিত্র কোরআনে এর চমৎকার ও সূক্ষ্ম পয়েন্ট বর্ণিত হয়েছে। সুরা নুরের ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালার শব্দ প্রয়োগের ভঙ্গিতে দৃষ্টিকে পবিত্র রাখার বিশেষ গুরুত্ব ও উপকারিতার সূক্ষ্ম পয়েন্ট রয়েছে। আল্লাহতায়ালা আয়াতে মোমিন বান্দাদের প্রথমে দৃষ্টি নত রাখার ও পরে যৌনাঙ্গ হেফাজত রাখার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী, আপনি মোমিনদের বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি নত রাখে এবং নিজেদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে।’ (সুরা নুর : ৩০)। এ আয়াতে নিজেদের দৃষ্টি নত রাখা তথা কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার জন্য বলা হয়েছে। আয়াতে দৃষ্টি নত রাখার আদেশকে আগে আনা হয়েছে। আর ‘তারা যেন নিজেদের যৌনাঙ্গ হেফাজত করে’- এ অংশটি পরে আনা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, যৌনাঙ্গ হেফাজত করার তথা জেনা থেকে বেঁচে থাকার সহজ মাধ্যম হলো দৃষ্টি নত রাখা। চোখের হেফাজত করা। আর এ জন্যই আল্লাহতায়ালা পর্দার হুকুম দিয়েছেন। অনেকে বলে, পর্দার কী দরকার! পর্দা করা হোক বা না করা হোক জেনা থেকে দূরে থাকলেই তো হলো। আমি বলি, চোখের হেফাজত তথা পর্দা করার দ্বারা যদি জেনায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা যায়, সে তো উত্তম কথা। আর যেখানে পর্দা না করে যিনা থেকে বেঁচে থাকার আশা রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে আমি বলব, পর্দা কর এবং গায়রে মাহরম নারীর সঙ্গে (মন্দ) আলাপচারিতা থেকেও বিরত থাক। কেননা শয়তানের প্ররোচনায় কেউ যদি পর্দাহীনতাকে বেছে নেয় এবং পর্দা ছেড়ে দিয়ে জেনা থেকে বেঁচে থাকার আশা করে, সেটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা ও বোকামি। মূলত এ শ্রেণির লোকেরা শরিয়তের বিধিবিধানকে অমূলক মনে করে।

পর্দাহীনতার ক্ষতি

একটি আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, পর্দায়ই যদি জেনা থেকে বাঁচা সম্ভব হয়, তাহলে যারা স্বভাবগতভাবেই দুষ্ট প্রকৃতির, তাদের স্বভাবকে তো আর কোনোভাবেই ফেরানো যায় না। এ ছাড়া পর্দাশীলদের দ্বারা কি জেনা সংঘটিত হতে পারে না? তাদের দ্বারাও তো জেনা সংঘটিত হতে পারে? আমি এ আপত্তির জবাবে বলি, কখনো কোথাও যদি এমনটা ঘটে থাকে, তাহলে তা পর্দাহীনতার কারণেই ঘটে থাকে। যাদের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাদের পর্দাশীল বা পর্দানসীন বলা অনুচিত। যেখানে এমন ঘটনা ঘটে সেখানে দেখা যাবে, তারা চাচাতো ভাই-বোন, মামাতো ভাই বোন, দেবর, ভাশুরদের মাঝে পর্দা রক্ষা করে চলে না। আর এদের দ্বারা যখন জেনা হয়ে যায়, তখন তাদের পর্দাশীল বা পর্দানসীন বলা বিষয়টি এমন, কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি জুয়া খেলে বা মদপান করার দায়ে জেলে গেল আর কেউ বলতে লাগল সম্ভ্রান্ত লোকও জেলে যাচ্ছে। এটি ভুল কথা। কেননা সে বংশীয় বিবেচনায় সম্ভ্রান্ত হতে পারে; কিন্তু কর্মগুণে সম্ভ্রান্ত নয়। সম্মান তো কর্মের দ্বারা, আর সে সম্মান ইতোমধ্যে সে হারিয়ে ফেলেছে। এখন সম্মান আর রইল কই? ঠিক একইভাবে পর্দাশীল কেউ জেনা করেছে- এ কথার অর্থ হলো সে আগে পর্দা করত। এ বিবেচনায় সে পর্দাশীল। আর যখন জেনা করেছে তখন পর্দাহীনতার কারণেই করেছে। বা সে পর্দা ছিল প্রথাগত পর্দা। আসল পর্দা নয়।

(অনুবাদ : মুফতি দিদার শফিক, খুতুবাতে হাকমিুল উম্মত ১৮/ ১৮০-১৮২)