অতি চালাকের গলায় দড়ি

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হজরত মুসা (আ.) এর জামানার কথা। এক যুবকের মনে বাসনা জাগল, পশুপাখির ভাষা শিখবে। আল্লাহর নবীর কাছে গিয়ে সে আবদার করল, দয়া করে আমাকে পশুপাখির ভাষা শিখিয়ে দিন। ধর্মের দোহাই দিয়ে সে যুক্তি দেখাল, আমি পশুপাখির ভাষা সৎজীবনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই। তাতে আমার ঈমান মজবুত হবে, আল্লাহর দিকে আগ্রহ বাড়বে, সৎকাজে প্রেরণা পাব। আমি মানুষের প্রতি বিরক্ত। সবাই শুধু কীভাবে খাবে, আরও কত পাবে, তা নিয়ে ব্যস্ত। কথায় কাজে ভ-ামি। তাই তারা যত সুন্দর কথাই বলুক, আমার অন্তরে কোনো প্রভাব পড়ে না। হজরত! আমি পশুপাখির বুলি শিখতে চাই। ধর্মের পথে চলার অনুপ্রেরণা নিতে চাই। মৃত্যুচিন্তা থেকেই আমার মনের এই আগ্রহ। মানুষ মরণশীল, পশুপাখিও মরণশীল। মৃত্যুর সময় পশুপাখির এমন কোনো অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, যা মানুষের চেয়ে ভিন্ন এবং আমাকে সচেতন করবে। ইনিয়ে বিনিয়ে আল্লাহর নবীকে রাজি করানোর জন্য সে অনেক কথা বলল। মুসা (আ.) দেখলেন, আজব ব্যাপার! তাকে তিনি বুঝিয়ে বললেন, তোমার মাথা থেকে এই পাগলামি ঝেড়ে ফেল। কারণ এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। তুমি যদি হেদায়েত চাও, সৎপথের দিশা চাও, শিক্ষা গ্রহণ করতে চাও, সরাসরি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করো। তিনিই তোমাকে পথ দেখাবেন।

মুসা (আ.)-এর নিষেধ শুনে যুবকের আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। কারণ, এমনিতেই কোনো বিষয়ে নিষেধ করা হলে তার প্রতি লোভ আরও প্রবল হয়। যুবক মুসা (আ.)-কে নানাভাবে যুক্তির মারপ্যাঁচে রাজি করানোর চেষ্টা শুরু করল। বলল, বর্তমান জগতে আপনিই আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর নূরের প্রতিফলন আপনার মাধ্যমে। কাজেই আমার মতো অসহায় যুবককে আপনার স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না। তাহলে আমি নিরাশ হয়ে পড়ব। আল্লাহ তো বান্দাকে নিরাশ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। পশুপাখির বুলি না শিখালে প্রকারান্তরে আমাকে আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ করা হবে। মুসা (আ.) দেখলেন, যুবক নাছোড়বান্দা। তিনি ফরিয়াদ জানালেন আল্লাহর দরবারে। প্রভু হে! এই ছেলেটাকে তো শয়তান কাবু করেছে। আমি যদি তাকে পশুপাখির বুলি শেখাই, তার জন্য ভয়ানক হবে। আর যদি না শেখাই সে কি-না নিরাশ হয়ে পড়বে। তার মনটা খারাপ হবে। এখন কী উপায়?

আল্লাহপাক বললেন, মুসা! তুমি তাকে ওদের জবান শিখিয়ে দাও। কারণ, আমি দয়াশীল। মানুষের দোয়া অবশ্যই কবুল করি। কাউকে কখনও নিরাশ করি না। মুসা (আ.) আফসোস করলেন, ইয়া আল্লাহ! সে তো পরে পস্তাবে। ক্ষমতা সবার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে না, ক্ষমতা চর্চা করার যোগ্যতা সবার থাকে না। তাই ক্ষমতার লোভের চেয়ে অসহায় হয়ে থাকাই নিরাপদ। সম্পদশালী হওয়ার চেয়ে গরিবীর মধ্যেই নিরাপত্তা ও হেকমত, হেফাজত। কেননা, দারিদ্র্যের শেষ ওসিলা তাকওয়া। দরিদ্র ব্যক্তি বাধ্য হয়ে হলেও তাকওয়া অবলম্বন করে। আর সম্পদ ও ক্ষমতাবান হলে উদ্ধত হয়ে যায়।

আ’দমী রা’ ইজয ও ফাকর আ’মদ আমা’ন

আয বলায়ে নফসে পুর হেরচ ও গমা’ন

মানুষের অসহায়ত্ব ও দারিদ্র্য বড় নিরাপত্তা

লোভ ও দুশ্চিন্তা তাড়িত নফসের বিপদণ্ডত্রাতা। (৩খ. ব-৩২৮৩)

আ’ গম আ’মদ যে আরযুহা’য়ে ফযূল

কে বেদা’ন খো করদে আস্ত আ’ন সাইদে গূল

অযথা অতিআশা থেকেই যত দুশ্চিন্তা জন্মায়

শয়তান প্রতারিতরা অভ্যস্ত অমূলক আশায়। (৩খ. ব-৩২৮৪)

যুবকের জন্য মুসা (আ.)-এর আফসোস দেখে আল্লাহ ওহি পাঠালেন তার কাছে। বললেন, তুমি যুবকটিকে যা চাচ্ছে দিয়ে দাও। তাকে কোনো কিছুর জন্য বাধ্য করো না। কারণ, জগতের পুরো ব্যবস্থাপনা এখতেয়ার বা ইচ্ছার স্বাধীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ স্বরূপ, সমগ্র জাহান আল্লাহর তাসবিহ পড়ে। কিন্তু তাসবিহ বা আল্লাহর পবিত্রতার গুণগান বাধ্য হয়ে পড়লে তাতে সওয়াব নেই। স্বেচ্ছায় সাগ্রহে পড়লেই সওয়াব। তরবারিটা তুমি তার হাতে তুলে দাও। চায় সে ধর্মের পথে লড়াকু যোদ্ধা গাজী হোক, কিংবা পথেঘাটে ডাকাত সাজুক, এটা তার ব্যাপার। তারপরও মুসা (আ.) যুবককে বুঝিয়ে বললেন, দেখ! শয়তান তোমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য এসব কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। ‘তোমরা এমন কিছু প্রার্থনা করো না, যা প্রকাশ করা হলে তোমাদের লজ্জা ও অপমানের কারণ হবে।’ (সুরা মায়িদা : আয়াত-১০১)। যুবক এবার দাবির মাত্রা কমিয়ে দিয়ে বলল, আপনি যখন সব পশুপাখির ভাষা শিখাতে চান না, অন্তত দুটি প্রাণীর ভাষা আমাকে শিখিয়ে দিন। একটি কুকুর, আপরটি মোরগ। এরা তো আমার ঘরের দরোজায় ঘুরঘুর করে। অন্তত তাদের বুলির অর্থ বুঝলে আমি সতর্ক জীবন লাভ করতে পারব।

মুসা (আ.) বললেন, শুনো যুবক! এটা তোমার ইচ্ছা। আমি দোয়া করে দিচ্ছি। আজ থেকে এই দুটি প্রাণীর ভাষা তুমি বুঝতে পারবে। তবে এর দায়দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তাবে।

পরদিন ভোরবেলা যুবক নিজের বিদ্যার পরীক্ষা নিতে বাড়ির দরোজায় অপেক্ষায় রইল। খাদেমরা নাশতা পরিবেশন করল। যুবকের উচ্ছিষ্ট নাশতার এক টুকরা রুটি মাটিতে পড়ে গেল। বাড়ির মোরগটি ছোঁ মেরে রুটির টুকরাটি তুলে নিল। পাশে কুকুর বলল, তুমি আমার প্রতি বড় জুলুম করেছ। মাটিতে ছড়ানো ছিটানো দানা ও খাবার তুমি টুকিয়ে খেতে পার। আল্লাহ আমাকে সেই ক্ষমতা দেননি। রুটির আস্ত টুকরাটা আমি খেতে পারতাম। তুমি আমার মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে জঘন্য কাজটি করলে।

মোরগ কুকুরকে বলল, চুপ করো তো, চিন্তা করো না। আল্লাহ তোমাকে অন্য খাবারও দিতে পারেন, দেবেন।

আমার মনিব (যুবক)-এর ঘোড়াটি কালকে মারা যাবে। তখন পাড়ায় কুকুরদের উৎসব হবে। বিনাশ্রমে চেষ্টা তদবির ছাড়াই তোমার উদরপূর্তি হবে। মোরগ আর কুকুরের বোলচাল শুনে যুবক খুশিতে আটখানা। পশুর ভাষা শিখতে পারায় বিপদের কথাটি আগাম জানতে পারল। তড়িঘড়ি সে ঘোড়াটি বিক্রি করে আসল বাজারে। ভবিষ্যদ্বাণী করে মোরগ পড়শি কুকুরটির কাছে লজ্জিত হলো। পরদিনও মোরগ রুটির টুকরাটি ছিনিয়ে নিল কুকুরের সামনে থেকে। যুবক এ দৃশ্য দেখে অপেক্ষায় রইল কুকুর কী বলে শোনার জন্য। কুকুর এবার কড়া ভাষায় মোরগকে বলল, ওহে মিথ্যুক! কাল কী বলেছিলে মনে কি আছে? একে তো জালেম, তারপরে মিথ্যাবাদী, অন্তরটাই কেমন কালো। কাল যে বলেছিলে, ঘোড়া মারা যাবে, কই? নিজে অন্ধ, তারপরে জ্যোতিষী-গণকের মতো ভবষ্যিৎ নিয়ে মন্তব্য কর।

মোরগ কিন্তু জানত আসল ব্যাপার। কুকুরকে সে বলল, ঘোড়া আসলে মারা গেছে। তবে অন্যত্র। আমার মনিব কালকে ঘোড়াটি বিক্রি করে দিয়েছে। নিজে লোকসান থেকে বেঁচে গেছে। সেই লোকসান চাপিয়ে দিয়েছে ক্রেতার ওপর। তবে চিন্তা করো না। কাল তার খচ্চরটি মারা যাবে। তার গোশত শুধু কুকুররাই খাবে। কুকুরদের বড় জেয়াফত হবে। আলাপটি শুনে যুবক আর দেরি করেনি। খচ্চরটি একদামে বিক্রি করে দিল বাজারে। দুশ্চিন্তা আর লোকসান থেকে রেহাই পেল ভাষাজ্ঞানের জোরে।

তৃতীয় দিন কুকুর বলল মোরগকে, ওহে মিথ্যার সর্দার! ঘেউ ঘেউ ঢোল পিটিয়ে মিথ্যা বলার তোমার মতো যোগ্যতা আছে আর কার? মোরগ কৈফিয়তের সুরে বলল, মনিব তো কাল ওকে বিক্রি করে দিয়েছেন। সে ওখানে মারা গেছে। ক্ষতি যা হবার ক্রেতার হয়েছে। ঠিক আছে, কাল তার গোলামটি দুর্ঘটনায় মারা যাবে। তার মৃত্যুতে আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে মেজবানের ব্যবস্থা করা হবে। কুকুর, গরিব-দুঃখী কেউ বাদ থাকবে না সেই আয়োজনে। এ কথা শুনেই যুবক তার গোলামটা বিক্রি করে দিল দাস বাজারে নিয়ে। বিরাট লোকসান থেকে বেঁচে গেল। চেহারায় তার আনন্দের ঝিলিক। মনে মনে ভীষণ আনন্দিত যে, অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনটি দুর্ঘটনা সামাল দিয়েছি। যখন থেকে পশুপাখির ভাষাটা আয়ত্ত করেছি, ভাগ্যের অশুভ পরিণতির চোখ সেলাই করতে সক্ষম হয়েছি।

পরের দিন কুকুর মোরগকে বলল, ওহে চিৎকারকারী, মিথ্যাবাদী! তুমি এ পর্যন্ত যত ভবিষ্যদ্বাণী করলে তার সত্যতা কোথায়? একটিও তো ফলেনি! আর কতকাল এভাবে মিথ্যার বেসাতি বিলাবে। মিথ্যা প্রতারণা ছাড়া তো কিছু নেই তোমার চরিত্রে? মোরগ বলল, সুবাহানাল্লাহ! আমার মুখ দিয়ে, কষ্মিনকালেও মিথ্যা বেরোতে পারে না। কারণ, মিথ্যাচার দিয়ে আমাদের পরীক্ষার সম্মুখীন করা হবে না। কেননা, আমার সৃষ্টি স্বভাবের মধ্যেই মিথ্যা নেই।

মা খরুসা’ন চোন মুয়াযযিন রাস্তগূয়

হাম রকীবে আ’ফেতা’ব ও ওয়াক্ত জূয়

আমরা মোরগরা মুয়াজ্জিনের মতো সত্যবাদী

সূর্যোদয়ের পর্যবেক্ষক সময় নির্ণয়ে পারদর্শী।( ৩খ. ব-৩৩৩১)।

হাদিস শরিফে বর্ণিত, ‘যায়দ ইবনে খালেদ আল জুহানী (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, তোমরা মোরগকে গালি দিও না। কেননা, মোরগ নামাজের জন্য জাগিয়ে দেয়।’ (আহমদ, আবু দাউদ, ইবন মাজা)। মোরগ বলল, আমরা সূর্যোদয়ের পাহারাদার। স্বহজাতভাবেই আমরা জানি, কখন সূর্যোদয় হবে। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আটকা থাকলেও সূর্যোদয়ের সময় আমারা জেনে যাই। মওলানা রুমি বলেন, মানব সমাজে আউলিয়ায়ে কেরামের ভূমিকা মোরগের মতো। তারা হাকিকতের সূর্যোদয়ের সংবাদ জানিয়ে দেন। তারা মানুষের মাঝে বসবাস করেন বটে; কিন্তু খোদায়ি রহস্যজ্ঞান তারা অবগত। তারা মানুষকে জাগাতে চান। কিন্তু গাফেল লোকেরা কোনো তোয়াক্কা করে না।

(দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি আগামী সপ্তাহে) (মওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প, ৩খ. বয়েত-৩২৬৬-৩৩৩১)।

মসনবি শরিফের ওপর ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর নিয়মিত আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI